শ্রমজীবী তরুণের ভবিষ্যৎ কী

তরুণ শ্রমজীবীদেরকে দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা যায়নি। দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় বা রাজনৈতিক নিপীড়ন—কোনো আলোচনাতেই তাদের অংশগ্রহণের কোনো ব্যবস্থা নেই, সুযোগও নেই।

কাজের খোঁজে ঢাকায় উপচে পড়ছে কর্মহীন মানুষ, যাদের বেশিরভাগই তরুণ। এক দশকের তথাকথিত উন্নয়ন, একের পর এক মেগা প্রকল্প, আর জিডিপির আড়ম্বর দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এই তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

দেশের ২২ লাখ গ্রাজুয়েটের বাইরেও বিভিন্ন জেলা-উপজেলার স্কুল-কলেজ থেকে পাশ করাদের একটা বড় অংশ দীর্ঘদিন বসে থেকেও চাকরি পাচ্ছে না। স্কুল থেকে ঝরে পড়াদের একটা অংশ নানাভাবে ইনফরমাল অর্থনীতির মধ্যে ঢুকে গেছে।

গ্রামীণ অর্থনীতিও সংকুচিত হয়ে আসছে। গ্রামের তরুণরা ঢাকায় এসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছেন। কেউ হকার, কেউ কেরানীগঞ্জের দর্জি, কেউ গাউসিয়ার হেলপার, কেউ বাসাবাড়ির কাজের বুয়া, কেউ সিকিউরিটি গার্ড, কেউবা আবার বাস কন্ডাক্টর। আর হাজার হাজার তরুণ ঢুকেছে গার্মেন্টসে।

বাস্তবতা হলো, এই তরুণ শ্রমজীবীদেরকে দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা যায়নি। দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় বা রাজনৈতিক নিপীড়ন—কোনো আলোচনাতেই তাদের অংশগ্রহণের কোনো ব্যবস্থা নেই, সুযোগও নেই। এই দেশের বাজেটে তার ভাগ আছে, চাকরি পাওয়ার অধিকার আছে, কর্মক্ষেত্রে ইউনিয়ন করার অধিকার আছে, সুলভে হাউজিং ও মেডিকেল সেবা পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু রাজনীতি, অর্থনীতি, মৌলিক অধিকার? এসব তো অনেক বড় বড় কথা, সে তো চাল, ডাল, ডিমের জন্য জীবন সংগ্রাম করতে করতেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।

এই তরুণরা গত ১৫ বছর ধরে ভোট দিতে পারেনি। স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গেও যুক্ত হতে পারেনি। কলকারখানায় কাজ করা একজন তরুণ যে তার অর্থনৈতিক সংকটের কথা কোথাও বলবেন, সেই জায়গাটিও তার নেই। এমন এক পরিকল্পিত শোষণমূলক কাঠামোর ভেতরে তার অর্থনৈতিক জীবনকে বন্দি করে রাখা হয়েছে যে নিজেদেরকে দীর্ঘমেয়াদি সাংগঠনিক বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করতে না পারলে তার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে, এমন সম্ভাবনাও নেই।

বাংলাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী খাত হচ্ছে গার্মেন্টস। ১৮ থেকে ৩০ বছরের লাখো তরুণ নারী ও পুরুষ এই খাতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই খাতেই তরুণ শ্রমিকদের সাংগঠনিক শক্তি বিকাশের বিপুল সম্ভাবনা ছিল। শ্রমিকের সংগঠিত হওয়া, কর্মক্ষেত্রে অধিকারের 'প্র্যাকটিস' এবং সেই সুবাদে সামগ্রিকভাবে দেশের রাজনীতিতেও মৌলিক ভূমিকা রাখার সবধরনের সুযোগ ছিল। শুধুমাত্র বকেয়া পাওনা বা মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনই নয়, খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর আন্দোলন, রেশনের আন্দোলন, সুলভে গ্যাস-বিদ্যুৎ পাওয়ার আন্দোলন, গণপরিবহনের আন্দোলন, এই সব জীবন-জীবিকার প্রশ্নে এই তরুণ শ্রমিকদের নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল।

অথচ গার্মেন্টস শিল্পের একদম শুরু থেকেই খুব পরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রের মৌলিক অধিকারগুলোকে সংকুচিত করে রাখা হয়েছে, শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক সংগঠন যেন উঠে দাঁড়াতে না পারে, মালিকপক্ষ ও সরকার মিলেমিশেই সেই সম্ভাবনাকে দমন করেছে। শেষ পর্যন্ত গার্মেন্টসের তরুণ-শ্রমিকটির জন্য সামান্য অভিযোগ করার প্লাটফর্মটিই গড়ে উঠতে দেওয়া হয়নি, অধিকারের আন্দোলন তো দূরে থাকে।

অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়া একটি শক্তিশালী খাত লাখো তরুণের কর্মস্থল, অথচ এই তরুণরা কেন পারলো না একটা সংগঠিত শক্তি হয়ে উঠতে?

জাতীয় অর্থনীতিতে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পরেও তার অর্থনৈতিক বা সামাজিক সংকট নিয়ে কথা বলার মতো শক্তিশালী 'স্পেস' কেন তৈরি করা গেলো না?

'লেবার ইউনিয়ন'কে গণতন্ত্র বিকাশের অন্যতম সহায়ক শক্তি বলা হয়, 'অর্গানাইজড লেবার' একসময় ইউরোপের গণতন্ত্রের বিকাশে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে। অথচ কোটি কোটি তরুণ লেবারের বাংলাদেশে কলকারখানার শ্রমিকরা জাতীয় রাজনীতিতে বা সামগ্রিক গণতন্ত্রায়নের পথে কোনো শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারলো না কেন?

জাতীয় রাজনীতির যে দৈন্যদশা, সর্বত্র দমন পীড়নের যে সংস্কৃতি, বাংলাদেশের কলকারখানাগুলো তার বাইরে নয়। সামগ্রিকভাবেই দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। তার ওপর আবার কেউ যখন সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে, শুরুতেই তাকে দমন করা হচ্ছে। কখনো রাষ্ট্র তাকে দমন করছে, পুলিশ দিয়ে হয়রানি করছে, কখনো কারখানার মালিক করছে। তার ওপর আবার অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে দুর্বল ও সবচেয়ে অরক্ষিত অবস্থায় থাকে এই শ্রমজীবী তরুণ।

অথচ এতো বিশাল সংখ্যক তরুণ 'ম্যানুয়াল' লেবার কি আর কোনো দেশে আছে? এই তরুণদের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের মতো কোটি কোটি ম্যানুয়াল লেবারের দেশে একটা সামগ্রিক অর্থনৈতিক রূপান্তর ঘটাতে পারতো। শুধু মজুরির প্রশ্নই নয়, খাদ্যপণ্যের দাম, গ্যাস-বিদ্যুতের বিল, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা খরচ—এমন সব মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে এই তরুণ শ্রমিকদের যেকোনো সাংগঠনিক কাজ বাংলাদেশের অর্থনীতির মারাত্মক বৈষম্যমূলক কাঠামোটির ভীত নাড়িয়ে দিতে পারতো।

অথচ হয়েছে উল্টোটা। এই তরুণরা 'শক্তি' হিসেবে নয়, বরং বরাবরই ব্যবহৃত হয়েছে শোষণ করার 'টুল' হিসেবেই। সর্বশেষ আমরা দেখলাম, মজুরির দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে চারজন তরুণ শ্রমিককে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিতে হলো।

গার্মেন্টসের তরুণদের সংগঠিত হওয়ার পথে যত বাধা

বাংলাদেশের শ্রম আইনে ট্রেড ইউনিয়ন করার স্পষ্ট বিধান আছে। অথচ  প্রশাসনের পক্ষ থেকেই সবধরনের চেষ্টা চালানো হয় যেন শ্রমিকরা সংগঠিত হতে না পারে। নিয়ম হলো, ইউনিয়ন করতে হলে ওই কারখানার শতকরা ৩০ ভাগ শ্রমিকের সদস্যপদ থাকতে হয়। এ ছাড়া, সংগঠন করতে ইচ্ছুক শ্রমিকদের তালিকা লেবার অফিসে জমা দিতে হয়। অথচ তালিকা হাতে পাওয়া মাত্রই লেবার অফিস শ্রমিকদের নামধাম সরাসরি পাঠিয়ে দেয় খোদ মালিকের কাছেই। এরপর খুব স্বাভাবিকভাবেই কারখানার ম্যানেজমেন্ট তালিকা ধরে ছাঁটাই শুরু করে। আর একবার ছাঁটাই হলে ইউনিয়ন করার 'অপরাধে' অন্য কারখানায় চাকরি পাওয়া যায় না।

সম্প্রতি উত্তরার ৬টি কারখানায় শ্রমিকরা ইউনিয়ন করার উদ্যোগ নিলে প্রতি কারখানা থেকেই প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন করে তরুণকে ছাঁটাই করা হয়েছে।

এ ছাড়া, ট্রেড ইউনিয়ন করার জন্য শ্রমিকরা দরখাস্ত জমা দিলে সরকারি কর্মকর্তারা মোটা অংকের ঘুষ দাবি করে। অর্থাৎ এটা পরিষ্কার যে সরকার ইচ্ছা করেই শ্রমিকদের সংগঠন করার যেকোনো উদ্যোগকে শুরুতেই পণ্ড করে দেয়।

এই যে সংগঠন করতে গেলে প্রথমেই বাধা দেওয়া হয় এবং সরকার ও কারখানার ম্যানেজমেন্ট একজোট হয়ে শখানেক তরুণ শ্রমিকের একসঙ্গে 'ভোকাল' হওয়ার সবচেয়ে প্রথম উদ্যোগটিই নষ্ট করে দেয়—এই অগণতান্ত্রিক 'প্র্যাকটিস'টি বাংলাদেশের প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে শক্ত খুঁটি গেড়ে বসেছে। অর্থাৎ শ্রমিকদের সংগঠন করার এই মৌলিক অধিকারটির প্রতি প্রশাসনের এই বৈরী আচরণ একেবারেই কাঠামোগত। এখন এই কাঠামো ধরে ঝাঁকি দিতে না পারলে এই দেশে ভোট হবে, নির্বাচন হবে ঠিকই, কিন্তু কায়িক পরিশ্রম করা, মেশিন চালানো তরুণদের অবস্থার পরিবর্তন হবে কী করে?

প্রশাসনিক বাধা ছাড়াও তরুণ শ্রমিকের 'ভোকাল' হয়ে উঠতে না পারার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক দৈন্যদশা। গার্মেন্টসে কাজ করা একটি মেয়ের দৈনন্দিন জীবনের পুরো সময়টা নিয়ে নেয় কারখানা। একটু বাড়তি আয়ের জন্য একজন শ্রমিককে নূন্যতম ১০ ঘণ্টা খাটতেই হয় কারখানায়। সকাল ৭টায় যে শ্রমিক মেয়েটি কারখানায় ঢোকে, সন্ধ্যা ৭টার আগে তার বের হওয়ার উপায় থাকে না। ২৫ বছরের মেয়েটি বা ছেলেটির দিনের পুরোটা সময় কেটে যায় মেশিনের সঙ্গে। শ্রমিক মেয়েটি কারখানা থেকে বাজার করে ঘরে ফিরে রাঁধতে রাঁধতে ১০-১১টা বেজে যায়। পরদিন তাকে উঠতে হয় ভোর ৬টায়। শ্রমিক যে ইউনিয়ন করবে, সংগঠন করবে, তার দাবি-দাওয়া নিয়ে মিটিং-মিছিল করবে, সন্ধ্যার পর রাজনীতি করবে, লিফলেট বিলাবে—সেই সময়টুকু কই?

দ্বিতীয়ত, শ্রমিকের খাদ্য তালিকা এমনভাবে সংকুচিত হয়েছে, তার প্লেট থেকে সবধরনের আমিষের সোর্স এমনভাবে হারিয়ে গেছে যে সংগঠিত হওয়ার মতো শারীরিক সক্ষমতা, মনের জোর বা আত্মবিশ্বাস—কোনোটাই তার অবশিষ্ট নেই। বাসস্থান, বাসা ভাড়া, পানি-বিদ্যুতের বিল তাকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। আশুলিয়া, সাভার বা গাজীপুর এলাকায় ৮ ফিট বাই ৬ ফিট ঘরের ভাড়া কোথাও ৪ হাজার টাকার নিচে না। বাংলাদেশের সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, সবচেয়ে বেশি ঘর ভাড়া দিয়ে, সবচেয়ে কম খেয়ে তাকে টিকে থাকতে হয়। যে ২৫ বছরের ছেলে বা মেয়েটির শরীর চলে না, যার বাসাবাড়িতে সর্বক্ষণ গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যা, যার পর্যাপ্ত ঘুমের সময় নেই, তার ইউনিয়ন করার 'স্পিরিট' আর বাঁচে কীভাবে!

এরপরেও গার্মেন্টস খাতে আন্দোলন যে হয় না তা না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তরুণ নারী শ্রমিকেরাই আন্দোলনের সামনের ভাগে থাকেন। কিন্তু এসব আন্দোলনের পরিণতি হয় মারাত্মক। স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের এক পর্যায়ে পুলিশ বা মালিকপক্ষ থেকে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। কখনো কারখানার মালামাল চুরির অভিযোগে লেবার কোর্টে মামলা করা হয়। আবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করলেও 'পাবলিক প্রপার্টি' ভাঙচুরের অভিযোগ এনেও ফৌজদারি মামলা করা হয়।

আবার শ্রমিক এলাকাগুলোতে সরকারি দলের প্রভাবশালীদের হুমকি-ধামকি চলতেই থাকে। মারধর বা ছাঁটাইয়ের ভয়ে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় তরুণটিও সভা-সমাবেশে যোগ দিতে ভয় পায়। ইউনিয়ন করতে গেলে চাকরি থাকবে না, মামলা হবে, এ ছাড়া সুপারভাইজারের কাছে নিয়মিত হয়রানি হতে হবে—প্রতিদিন এমন ভীতিকর পরিবেশের মধ্যে থাকতে হয় বলে গার্মেন্টসের তরুণদের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অংশটিও চুপচাপ থাকাটাকেই শ্রেয় মনে করে। অর্থাৎ কোথায় গণতন্ত্র, কোথায় ট্রেড ইউনিয়ন, কোথায় অধিকার—এই খাতের তরুণদের সংগঠন করা বা রাজনৈতিক হয়ে ওঠার সব সম্ভাবনাকে শুরুতেই শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা থাকে।

শ্রমজীবী তরুণদের ভবিষ্যৎ কী

ডিজিটাল বাংলাদেশ বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডে আমরা তরুণদের যে 'ইমেজ' দেখি, এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণের চেহারা, গায়ের রং বা বেশভূষা সেরকম নয়। এই দেশের বেশিরভাগ তরুণ কলকারখানায় কাজ করে, মেশিন চালায়, বাসাবাড়িতে ছুটা বুয়ার কাজ করে, ইজিবাইক বা নসিমন করিমন চালায় কিংবা ফুটপাতে পণ্য বিক্রি করার চেষ্টা করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই প্রতিটি খাতেই চলে লাগাতার পুলিশি নিপীড়ন।

ফুটপাথে বসতে গেলে পুলিশ বা লাইনম্যানের চাঁদাবাজি, রাস্তায় ইজিবাইক নিয়ে নামলে লাঠিপেটা আর জরিমানা আদায়—এসবই শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ  তরুণের জীবনের নিত্তনৈমত্তিক ঘটনা। গার্মেন্টস খাতে তাও তরুণদের সামষ্টিকভাবে আন্দোলন করার অনেক নজির আছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ইউনিয়ন করতে না পারলেও একই শ্রমিক পাড়ার বাসিন্দা এবং একই কর্মক্ষেত্রের কর্মী হওয়ায় নিজেদের চিন্তাভাবনা বা রাগ-ক্ষোভের আদান-প্রদানের সুযোগ আছে, কিন্তু ইনফরমাল অর্থনীতির তরুণরা এতটাই বিচ্ছিন্ন ও অরক্ষিত যে সংগঠিত হওয়া দূরে থাক, তার কর্মক্ষেত্রের সংকটগুলো নিয়ে কথা বলার একটি প্লাটফর্মও নেই।

দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে দুর্গতি, ফর্মাল প্রতিষ্ঠানগুলোই কাজ করে না, সেখানে ইনফরমাল অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই তরুণরা যে প্রশাসনের সঙ্গে 'ডায়ালগ' করবে, তার অরক্ষিত জীবিকার সুরক্ষা চাইবে, তার কোনো উপায়ই নেই।

গত এক দশকে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ইন্সটিটিউশনগুলোকে নষ্ট করা হয়েছে, জবাবদিহিতার কাঠামোগুলোকে দুর্বল করা হয়েছে, রাজনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণের প্রতিটি পথ দুরূহ করা হয়েছে—পুরো অর্থনৈতিক কাঠামোটাই তো নিপীড়নমূলক। অথচ এখানে ভোট দিয়ে সরকার পাল্টালেও শ্রমজীবী তরুণের দুর্দশার পরিবর্তন ঠিক কীভাবে হবে, সেই আলাপে কাউকে আগ্রহী মনে হয় না। সরকারের সঙ্গে, রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে দেনদরবার বা দর কষাকষির আনুষ্ঠানিক কোনো প্রক্রিয়াই আর কাজ করছে না। নিজেদের অত্যন্ত 'বেসিক' অধিকারটুকু আদায়ের নূন্যতম কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া তৈরি হওয়ার পরিবেশটাকেই নষ্ট করা হয়েছে। এই অবস্থায় এই দেশের তরুণ শ্রমজীবীরা ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় তাদের অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে বের হতে পারবেন সেই আলোচনাটাও কোথাও প্রাধান্য পায় না।

সম্প্রতি দেশের ৪ কোটি 'ফার্স্ট টাইম' ভোটার নিয়ে প্রচুর আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। দেশের শখানেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও এবারই প্রথম ভোট দেওয়ার কথা ছিল। ১৫ বছর পর এ দেশের তরুণরা ঠিকঠাক ভোটটা দিতে পারবে—এমন আশাও তৈরি হয়েছিল। নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের মধ্যে আগ্রহ উদ্দীপনাও দেখা গিয়েছিল। ছাত্র সংগঠনগুলো সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করেছে, তরুণদেরকে রাজনীতিতে সক্রিয় করার উদ্দেশ্য নিয়ে গঠনমূলক প্লাটফর্মও তৈরি হয়েছে। কিছু সংস্থাকে দেখেছি মানবাধিকার, ক্রসফায়ার বা বাকস্বাধীনতার মতো সাহসী ইস্যুতে তরুণদের সংগঠিত করার চেষ্টা করে গেছে। সবমিলিয়ে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার—এইসব ইস্যুকে সামনে রেখে সবাই মিলেই একটা 'পজিটিভ' পরিবেশ তৈরি করেছিল।

কিন্তু মাসখানেক আগেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সেটাও এখন প্রায় শেষ। সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের তরুণদের সামনে কেমন রাজনীতি অপেক্ষা করছে, তা বলা মুশকিল। তবে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, এতো সব নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যেও তরুণ শ্রমজীবী তরুণ বরাবরই উপেক্ষিত ছিল। সে জায়গা পায়নি মিডিয়াতে, সে গুরুত্ব পায়নি জাতীয় রাজনীতির কোনো আলোচনাতেই।

আদতে এ ধরনের দমন-পীড়নের কালে শ্রমজীবী তরুণকে গঠনমূলক রাজনীতি বা সংগঠন করার প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা কঠিন। ভবিষ্যতের রাজনীতিতে তরুণদের এই শ্রমজীবী অংশটিকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্ত করতে হলে তাদের সংগঠিত হওয়ার পথকে সহজ করতে হবে, গণতান্ত্রিক চর্চার ইন্সটিটিউশনগুলোকে কার্যকর করতে হবে, সরকারকে কর্মসংস্থান তৈরিতে বিপুল উদ্যোগ ও বিনিয়োগ করতে হবে এবং সব ধরণের সরকারি দমন পীড়নের বিরুদ্ধে জবাবদিহিতার শক্ত সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই তরুণ শ্রমজীবী অংশটিকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।

মাহা মির্জা; গবেষক এবং খণ্ডকালীন শিক্ষক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
quota reform movement,

Govt publishes preliminary list of those killed in July-August protests

The interim government today published a preliminary list of the people who died during the student-led mass protests in July and August.

3h ago