ঈদযাত্রা: রেলের শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রির সুবিধা-অসুবিধা

গত ৯ মার্চ রাজধানীর বিদ্যুৎ ভবনে সড়ক ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সভাপতিত্বে আয়োজিত আন্তমন্ত্রণালয় সভায় জানানো হয়, এবার ঈদযাত্রায় শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি হবে।
আগামী ১ এপ্রিল পবিত্র ঈদুল ফিতর ধরে রেলের আন্তনগর ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি করা হবে। রেলওয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঈদের আগে আন্তনগর ট্রেনের ২৪ মার্চের টিকিট বিক্রি হবে ১৪ মার্চ; ২৫ মার্চের টিকিট বিক্রি হবে ১৫ মার্চ; ২৬ মার্চের টিকিট বিক্রি হবে ১৬ মার্চ; ২৭ মার্চের টিকিট বিক্রি হবে ১৭ মার্চ; ২৮ মার্চের টিকিট বিক্রি হবে ১৮ মার্চ; ২৯ মার্চের টিকিট বিক্রি হবে ১৯ মার্চ এবং ৩০ মার্চের টিকিট বিক্রি হবে ২০ মার্চ।
প্রতিটি আন্তনগর ট্রেনের আসনের অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ দাঁড়িয়ে ভ্রমণের (স্ট্যান্ডিং) টিকিট যাত্রা শুরুর আগে প্রারম্ভিক স্টেশন থেকে পাওয়া যাবে। ফিরতি যাত্রার অগ্রিম টিকিট একজন যাত্রী সর্বোচ্চ একবার কিনতে পারবেন এবং এ ক্ষেত্রে ৪টি আসন সংগ্রহ করতে পারবেন। ঈদযাত্রার টিকিট কেনার পর তা আর ফেরত নেওয়া হবে না।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালে আন্তনগর ট্রেনের ৬০ শতাংশ টিকিট অনলাইনে বিক্রি হয়। ওই বছর মোট তিন কোটি ৪৪ লাখ ৯২ হাজার ৪৩টি টিকিট বিক্রি করেছে রেলওয়ে। এর ৬০ শতাংশ দুই কোটি ৭ লাখ ২০ হাজার ৭৯৯টি টিকিট বিক্রি হয় অনলাইনে। বাকি এক কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ২৪৪টি টিকিট বিক্রি হয় কাউন্টার থেকে। তার আগের বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে ৩৮ শতাংশ টিকিট বিক্রি হয়েছিল অনলাইনে। (সমকাল, ৩১ জানুয়ারি ২০২৪)
অনলাইনে টিকিট বিক্রির হার এক বছরে ৩৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬০ শতাংশ হওয়ার মানে হলো, এই সময়ের মধ্যে অনলাইনে টিকিট বিক্রি বেড়েছে ২২ শতাংশ—যা আশাব্যঞ্জক। সেই ধারাবাহিকতায় সম্ভবত এ বছর ঈদে রেলের শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু এখানে কিছু বাস্তবতা ও তিক্ত অভিজ্ঞতাও বিবেচনায় রাখা দরকার।
ঈদ ছাড়া স্বাভাবিক সময়ে এখন অনলাইনে রেলের টিকিট ছাড়া হয় যাত্রার ১০ দিন আগে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কক্সবাজারসহ যেসব রুটে ট্রেনের সংখ্যা কম এবং যাত্রীর চাপ বেশি—সেসব রুটে এক সপ্তাহ আগেও মানুষ অনলাইনে টিকিট কাটতে পারেন না। বরং যেদিন টিকিট ছাড়া হয়, খুব ব্যতিক্রম না হলে সেদিন ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সব বিক্রি হয়ে যায়। তবে যেসব রুটে ট্রেনের সংখ্যা বেশি এবং যাত্রীর চাপ তুলনামূলক কম, সেসব রুটে অনেক সময় যাত্রার আগের দিনও টিকিট পাওয়া যায়।
এই বাস্তবতায় ঈদযাত্রায় রেলের শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রির সিদ্ধান্তটি যাত্রীদের জন্য কতটা সহায়ক হবে, তা বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। তবে এটা ঠিক, অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটার সুবিধা অনেক।
যেমন:
১. রাস্তার জ্যাম ঠেলে সময় ব্যয় করে কাউন্টারে না গিয়ে ঘরে বসেই টিকিট কেনা সম্ভব। অতীতে ঈদের সময় দেখা যেত, ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য ইফতারের পরে লাইনে দাঁড়িয়ে পরদিন সকাল পর্যন্ত অনেকে অপেক্ষা করেও টিকিট না পেয়ে মন খারাপ করে চলে গেছেন। তাছাড়া একসঙ্গে কাউন্টারে হাজার হাজার মানুষের ভিড় সেখানে বড় ধরনের অস্থিরতারও জন্ম দিতো। এই পরিস্থিতি এড়াতে অনলাইন টিকিট সবচেয়ে ভালো সমাধান।
২. অনলাইনে টিকিট কাটা গেলে ট্রেনের সময়সূচি, টিকিটের দাম, আসন ও অন্যান্য তথ্য সহজেই দেখা যায়।
৩. অনলাইনে সাধারণত দিনের যেকোনো সময় টিকিট কাটা যায়। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাউন্টার বন্ধ থাকার মতো সমস্যা এখানে নেই।
৪. অনলাইনে টিকিট কাটার আরেকটি সুবিধা হলো অনলাইনেই টাকা পরিশোধ। বিভিন্ন অনলাইন পেমেন্ট পদ্ধতি—যেমন: ব্যাংক ট্রান্সফার, ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিং—ব্যবহার করে টিকিটের দাম পরিশোধ করা যায়।
৫. অনলাইনে কিছু ক্ষেত্রে ডিসকাউন্ট বা বিশেষ অফার পাওয়া যায়, যা কাউন্টার থেকে পাওয়া যায় না।
এর বিপরীতে অনলাইন টিকিটিংয়ের কিছু অসুবিধাও আছে।
১. প্রধান সমস্যা হলো, টিকিটের বিপরীতে চাহিদা থাকে কয়েকশ গুণ বেশি এবং একসঙ্গে লাখো মানুষ অনলাইন সিস্টেমে প্রবেশ করায় পুরো সিস্টেম অনেক সময় স্থবির হয়ে যায়। ফলে অনলাইন টিকিটিংয়ের এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থাৎ কাউন্টারে মানুষের যে ভিড়, সেই ভিড় বা চাপ তৈরি হয় অনলাইন সার্ভারে।
২. অনেক সময় ইন্টারনেট সংযোগ বা সাইটের সমস্যা হতে পারে, যার কারণে বুকিং সম্পন্ন করা যায় না বা লেনদেন ব্যর্থ হতে পারে। অনেক সময় পুরো নিয়ম-কানুন অনুসরণ করার পরেও সবশেষে টাকা পরিশোধের সময় সার্ভার কাজ করে না। সেক্ষেত্রে পুরো কষ্টই মাটি হয়ে যেতে পারে।
৩. কিছু ভুয়া ওয়েবসাইট বা অ্যাপ্লিকেশন গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে। এ ক্ষেত্রে যাত্রীদের সতর্ক থাকার বিকল্প নেই। যে সাইট থেকে আপনি টিকিট কাটছেন, সেটি পরীক্ষিত কি না, যাচাই করে দেখা দরকার।
৪. অনলাইনে টিকিট পরিবর্তন বা বাতিল করার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম-কানুন আছে, যা কাউন্টার বুকিংয়ের তুলনায় জটিল।
৫. সাইট বা অ্যাপে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে টিকিটের সমস্যা বা পেমেন্টের সমস্যা হতে পারে।
তাহলে উপায় কী?
আধুনিক পৃথিবীতে মানুষ যখন ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ার দিকে হাঁটছে এবং ব্যস্ত জীবনে সময় ও কষ্ট কমাতে ঘরে বসেই নাগরিক জীবনের সব সেবা পেতে চায়; সরকারও রাষ্ট্রীয় সব সেবা অনলাইনে দেওয়ার মধ্য দিয়ে দুর্নীতি কমানো এবং সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে চায়—সেরকম বাস্তবতায় সবাই শতভাগ অনলাইনে টিকিট কাটবেন এবং কোনো ধরনের হয়রানির মধ্যে পড়বেন না, এটিই কাঙ্ক্ষিত।
সেজন্য টিকিট কাটতে সরকারিভাবে অনুমোদিত ওয়েবসাইট বা অ্যাপ—যেমন: বাংলাদেশ রেলওয়ের অফিসিয়াল সাইট—ব্যবহার করা; বুকিং প্রক্রিয়া বাধাহীনভাবে সম্পন্ন করার জন্য ভালো ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করা; বুকিং সম্পন্ন হওয়ার পর টিকিটের কনফার্মেশন ইমেইল বা এসএমএস ঠিকভাবে চেক করা; রেলের টিকিট বুকিং শুরু হওয়ার পর পর্যাপ্ত সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং আগেভাগে বুকিং করা; অনলাইন পেমেন্ট করার সময় সুরক্ষিত পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহার করা এবং ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করার সময় সতর্ক থাকা জরুরি। সেইসঙ্গে যদি টিকিট বাতিল বা পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে আগে থেকেই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নীতিমালা সম্পর্কে জেনে রাখা উচিত।
এই উপায়গুলো অনুসরণ করলে অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটার অভিজ্ঞতা আরও সহজ ও নিরাপদ হতে পারে। কিন্তু এটাও ঠিক, চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত ট্রেন এবং ঈদের সময় প্রতিটি ট্রেনে অতিরিক্ত বগি সংযোজন করা না গেলে প্রত্যাশিত যাত্রীর সামান্য সংখ্যকই অনলাইনে টিকিট কাটার সুযোগ পাবেন।
প্রতিটি রুটে ঈদের সময় যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। যদিও শতভাগ মানুষ ট্রেনে যেতে পারবেন না। যারা পারবেন না, তাদেরকে বাস ও অন্যান্য বিকল্প খুঁজতে হবে। কিন্তু এই ইন্টারনেটের দুনিয়ায় সব সেবা যে ধীরে ধীরে অনলাইন নির্ভর হয়ে যাবে—সেটার জন্য মানসিক প্রস্তুতিও থাকা দরকার।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক
Comments