রকির চাকরি ছেড়ে ট্যুরিস্ট গাইড হয়ে ওঠার গল্প
২০১৮ সালের কথা। মেহেদী হাসান রকি তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থী। সরস্বতী পূজার সময় আলোয় উদ্ভাসিত ক্যাম্পাসে একদিন দেখলেন একজন বাংলাদেশির সঙ্গে দুজন বিদেশি পর্যটক। তাদের ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন সেই স্বদেশি। সেখান থেকেই রকির আগ্রহী জন্মে কাজটির প্রতি। ভাবতে থাকেন, তিনিও এভাবে বিদেশিদের দেশ ঘুরিয়ে দেখাতে পারেন।
এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার এসব ভুলে যান। ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিজের লেখাপড়া নিয়ে। একদিন বন্ধুদের সঙ্গে আহসান মঞ্জিল ঘুরতে গিয়ে আবারও দেখা হয় কিছু বিদেশি পর্যটক ও একজন গাইডের সঙ্গে। এরপর আগ্রহ বেড়ে যায় তার।
রকি ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখতে থাকেন কীভাবে বিদেশি পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজ করা যায়। কিন্তু তেমন কোনো দিকনির্দেশনা পাননি তিনি। এরপর ঠিক করেন নিজেই নিজেকে গড়ে তুলবেন টুরিস্ট গাইড হিসেবে।
তার ভাষ্যে, 'শুরুটা করেছিলাম ঢাকা থেকেই। এক সপ্তাহে ঢাকার কিছু জনপ্রিয় পর্যটন স্থান ঘুরে এলাম। ইন্টারনেট থেকে ও বই পড়ে সেসব জায়গার ইতিহাস ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলাম। এরপর চলো বাংলাদেশ ট্যুরস নামে ফেসবুক পেজ, ফেসবুক গ্রুপ ও ওয়েবসাইট বানিয়ে কাজ শুরু করলাম।'
রকি শুরুটা করেছিলেন মাত্র ২ হাজার টাকায়। তবে তখনই পর্যটক পাননি। এজন্য করতে হয়েছে লম্বা সময়ের অপেক্ষা।
রকি বলেন, 'ভারতীয় এক পর্যটক প্রথম বুকিং করেছিলেন। তবে বাংলাদেশে আসার আগে তার মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি ভ্রমণ বাতিল করেন। পরে মালয়েশিয়া থেকে দুজন পর্যটক বুকিং করেছিলেন। অজ্ঞাত কারণে তাও বাতিল হয়ে যায়। একের পর এক বুকিং বাতিল হতে থাকায় একসময় একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিই।'
এরপর বিদেশি পর্যটকের আশা না করে দেশি পর্যটকদের সঙ্গেই নানান জায়গা ঘুরতে থাকি। এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়। এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল। প্রথম বিদেশি পর্যটক হিসেবে বাংলাদেশে রকির সঙ্গে দেখা করতে আসেন নেত্র। তিনি নেপালের মানুষ, তার দেশে নিজেও ট্যুর গাইড হিসেবে কাজ করেন। এক সপ্তাহজুড়ে চলে তাদের ভ্রমণ। ঢাকা, সোনারগাঁ, রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁ নেত্রকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান রকি। ট্যুর থেকে পেয়ে যান ৮৫০ ডলার।
রকি বলেন, 'সেই মাসেই নেত্রর মাধ্যমে পেয়ে যাই অস্ট্রেলিয়ার এক পর্যটককে। ধীরে ধীরে ব্যস্ততা বাড়ে।'
এরপর রকির স্মৃতিতে সঞ্চিত হয়েছে নানান অভিজ্ঞতা।
নরওয়ে থেকে আসা দুই পর্যটক হেইডি ও জানাকে নিয়ে ঝড়ের ভেতর নৌকাভ্রমণের শিহরণ জাগানিয়া অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার। তারা বুকিংয়ের সময়ই বলেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দাদের মতো ঘুরতে চান। ঢাকার কেরানীগঞ্জের নানান জায়গা রিকশায়, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় কিংবা হেঁটে তাদেরকে ঘুরিয়ে দেখান রকি। তাদের সঙ্গে নিয়ে যান কুমিল্লার একটি গ্রামেও।
তিনি বলেন, 'আমিই এই গ্রামের কথা তাদের বলেছিলাম। গ্রামটি মেঘনার ওপারের একটি চর। ভ্রমণের দিন ঘাটে গিয়ে দেখি আবহাওয়ার অবস্থা সুবিধার নয়। তবে পর্যটক দুজন নাছোড়বান্দা হওয়ায় তাদের নিয়ে নৌকায় উঠি। ঝুঁকি নিয়ে চরে পৌঁছাই। সেখানে স্থানীয়দের সঙ্গে আনন্দময় সময় কাটান তারা, ফুটবল খেলেন। ফেরার সময় ঘটে বিপত্তি। নদীর মাঝ বরাবর আসতেই ঝড়ের কবলে পড়ে নৌকা। রক্ত হিম করা পরিস্থিতির ভেতর দিয়েই কোনোমতে দুলতে দুলতে জেটির কাছে পৌঁছায় নৌকা। ঝড় থামা পর্যন্ত আমরা সেখানেই বসেছিলাম।'
এ বছরের ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখ আমেরিকা থেকে ঢাকা আসেন পর্যটক জেফ্রি ক্লাইন। ৭০ বছর বয়স্ক জেফ্রির নিত্যসঙ্গী হুইল চেয়ার। তবুও অদম্য ইচ্ছাকে সঙ্গী করে শতাধিক দেশ ঘুরেছেন তিনি।
বাংলাদেশের আরও কিছু ট্যুর অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাদের থেকে সাড়া পাননি তিনি। তবে চলো বাংলাদেশ ট্যুরস সাড়া দেয়। চার মাস আগে বুকিং করে ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পা রাখেন জেফ্রি ক্লাইন।
রকি বলেন, 'পরদিন সকালে আমরা পানামনগর ঘুরে দেখতে যাই। এরপর বড় সরদারবাড়ি। আমাদের পর্যটনের জায়গাগুলো হুইলচেয়ারে ঘুরে দেখার উপযোগী না হওয়ায় বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়।'
জেফ্রির সঙ্গে রকির ট্যুর ছিল চারদিনের। এতে নানান জায়গা ঘোরা ও অনন্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন তিনি।
বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবেই কাজটিকে গ্রহণ করেছেন মেহেদী হাসান রকি। কাজটিতে যেমন স্বাধীনতা আছে তেমনি আছে আনন্দও। তবে কোনো কোনো সময় তৈরি হতে পারে প্রতিকূল পরিস্থিতি। যেমন করোনার মতো মহামারি বা রাজনৈতিক পরিস্থিতি।
রকি বলেন, 'এমনিতে প্রতি মাসে ১০-১৫ জন অতিথি পেলেও করোনার সময়ে পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। সে সময় বেশ কয়েক মাস ধরেও তেমন পর্যটক পাওয়া সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া বর্তমানে চলা অবরোধের ফলেও বাইরের দেশগুলো থেকে ট্যুরিস্টরা আসার ব্যাপারে উৎসাহ পাচ্ছেন না। ফলে এখন ট্যুরের সংখ্যা অনেক কম।'
পেশা হিসেবে তরুণদের জন্য কেমন হতে পারে এই কাজ সে বিষয়ে রকি বললেন, 'কাজটা করে আনন্দ পাওয়া যায়। অর্থ উপার্জনও ভালো হয়। তবে শুরু করার পর ট্যুরিস্ট পেতে সময় লাগে। এজন্য তরুণরা অন্য কোনো কাজের পাশাপাশি এটা করতে পারেন। আমি সেভাবে করেছিলাম। ট্যুর এজেন্সি দাঁড়িয়ে গেলে তারপর এই কাজকেই পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে নেওয়া সম্ভব।'
রকি তার চাকরিজীবনের তুলনায় এখন কয়েকগুণ বেশি আয় করছেন। নিজের প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে আনন্দের সঙ্গে এগিয়ে যেতে চান আরও বহুদূর।
Comments