লোহিত সাগরে অচলাবস্থায় বাড়ছে পণ্য পরিবহন খরচ
আমদানি ও রপ্তানি পণ্য পরিবহনের অন্যতম রুট লোহিত সাগরে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। এতে বাংলাদেশি রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকদের যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে পণ্য পরিবহনে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। মূলত গত মাসে লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলার পর এই সংকট তৈরি হয়েছে।
বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান সমর্থিত হুথিরা এই হামলা করেছিল, যারা ইয়েমেনের বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়। তারা বলেছিল, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের হামলার জন্য তেলআবিবের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে এই হামলা চালানো হয়েছে।
এ হামলার ঘটনায় লোহিত সাগর ও সংলগ্ন সুয়েজ খালে পণ্য পরিবহন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল পরিবহন কোম্পানিগুলো। লোহিত সাগর ও সুয়েজ খালে মূলত আফ্রিকা ও এশিয়াকে সংযুক্ত করেছে।
বিশ্বের শিপিং কনটেইনার পরিবহনের ৩০ শতাংশসহ সব পণ্যের বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ এই রুটের মাধ্যমে হয়ে থাকে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া থেকে পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের কিছু অংশের সঙ্গে বাণিজ্য লোহিত সাগরের রুটের ওপর নির্ভর করে।
শিপিং এক্সিকিউটিভদের মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের ইস্ট কোস্ট ও কানাডার জন্য নির্ধারিত বাংলাদেশের রপ্তানিবোঝাই কনটেইনারের ৭০ শতাংশের বেশি লোহিত সাগর দিয়ে যায়। এদিকে দেশের মোট আমদানির ৮ থেকে ১০ শতাংশ আসে এ রুট দিয়ে।
শিপিং লাইনগুলো এখন আফ্রিকার কেপ অব গুড হোপের আশেপাশ ঘুরে দীর্ঘ রুট হয়ে চলে যাচ্ছে।
ড্যানিশ শিপিং কোম্পানি এপি মোলার-মারস্ক ২ জানুয়ারি বলেছে, 'এই ঘটনার তদন্ত চলছে এবং আমরা পরিস্থিতি আরও মূল্যায়নের সময় এ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে সব কার্গো চলাচল স্থগিত রাখব।'
তারা বিবৃতিতে বলেছে, 'যেসব ক্ষেত্রে আমাদের গ্রাহকদের জন্য সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে সেখানে জাহাজগুলো পুনরায় রুট করা হবে এবং কেপ অব গুড হোপের চারপাশ ঘুরে যাবে।'
সিএনবিসির তথ্য অনুযায়ী, বাণিজ্যিক জাহাজ রক্ষার চেষ্টা থাকলেও ঝুঁকি থেকে গেছে। মেরিনট্র্যাফিক নিশ্চিত করেছে যে, বাণিজ্যিক জাহাজগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে ভিন্ন পথ বেছে নিচ্ছে।
গ্লোবাল ট্রেড ডেটা প্রোভাইডার কেপলার জানিয়েছে, গত সপ্তাহে ৫৫টি এবং এক মাস আগে ১৮টি জাহাজি এই তালিকায় ছিল, কিন্তু এ সপ্তাহে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৪টিতে।
সিএনবিসি জানিয়েছে, অন্তত ৮০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের কার্গো ইতোমধ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যার মোট সক্ষমতা অনুমান করা হয়েছে ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন কনটেইনার, বা ২০ ফুট সমতুল্য ইউনিট (টিইইউ)।
ফ্রেইট কনসালটেন্সি এমডিএস ট্রান্সমোডালের মতে, সুয়েজের জন্য পাঠানো একটি কনটেইনারের মূল্য ৫০ হাজার মার্কিন ডলার।
সিএনবিসি জানিয়েছে, বৈরি পরিস্থিতির কারণে ২২৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া থেকে মালবাহী ভাড়া ৫০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
প্রধান শিপিং লাইনগুলো টিইইউ কনটেইনার প্রতি ৭০০ ডলার থেকে ১৫০০ ডলার পর্যন্ত অতিরিক্ত সারচার্জ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে।
এপি মোলার-মারস্ক পূর্ব এশিয়া থেকে উত্তর ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলের রুটের জন্য প্রতি ৪০ ফুট কনটেইনারে ৪০০ ডলারের 'ট্রানজিট ডিসট্রাকশন চার্জ' (টিডিএস) ঘোষণা করেছে।
গত ২১ ডিসেম্বর গ্রাহকদের জানানো হয়েছে, এই টিডিএস 'পানিতে' পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য
তারা আরও ঘোষণা দিয়েছে, ১ জানুয়ারি থেকে প্রতি ৪০ ফুট বক্সের জন্য ১ হাজার ডলার 'পিক সিজন সারচার্জ' (পিএসএস) চার্জ করা হবে।
ভূমধ্যসাগরীয় শিপিং কোম্পানি (এমএসসি) ১ জানুয়ারি থেকে প্রতি ২০ ফুট কনটেইনারে ১ হাজার ডলার এবং ৪০ ফুট কনটেইনারের জন্য ১ হাজার ৫০০ ডলার 'কন্টিজেন্সি অ্যাডজাস্টমেন্ট চার্জ' (সিএসি) ঘোষণা করেছে।
ভারতীয় উপমহাদেশ (ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা) ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপীয়, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, বাল্টিক ও ভূমধ্যসাগরীয় গন্তব্যের ক্ষেত্রে এই চার্জ প্রযোজ্য হবে।
ফরাসি কোম্পানি সিএমএ সিজিএম ১ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশসহ এশিয়ার সব বন্দর থেকে ইউরোপের সব বন্দরে প্রতি টিইইউতে ৫০০ ডলারের পিএসএস আরোপ করেছে।
জাপানের শিপিং কোম্পানি ওশান নেটওয়ার্ক এক্সপ্রেস গত ডিসেম্বরে ঘোষণা দিয়েছিল, তারা ১ জানুয়ারি থেকে এশিয়া-ইউরোপ বাণিজ্যে সব ধরনের কনটেইনারের জন্য ৫০০ ডলারের 'ইমার্জেন্সি পিএসএস' আরোপ করবে।
হ্যাপাগ-লয়েড ও এইচএমএম কোম্পানিও একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছে।
একটি বিদেশি শিপিং লাইনের একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী গতকাল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সংকট অব্যাহত থাকলে বেশিরভাগ শিপিং লাইন জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে আরও চার্জ আরোপের কথা বিবেচনা করছে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, সাধারণত বাংলাদেশি পণ্য নিয়ে শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরে লোহিত সাগর দিয়ে ইউরোপের গন্তব্যে পৌঁছাতে ৩০ থেকে ৩৫ দিন সময় লাগে।
তিনি বলেন, 'এখন আরও অন্তত ১০ দিন অতিরিক্ত সময় লাগবে।'
তিনি আরও বলেন, এতে পরিবহন খরচ বাড়বে, যা শেষ পর্যন্ত দেশীয় গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের বহন করতে হবে।
পোশাকের আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোর দেওয়া সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহে ব্যয়বহুল এয়ার শিপমেন্ট ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, আমদানিবোঝাই জাহাজের ক্ষেত্রে কইটেইনার প্রতি চার্জ ইতোমধ্যে ৭০০ থেকে ৮০০ ডলার বেড়েছে।
বিটিএমএ টেক্সটাইল মিলারদের একটি সংগঠন, যারা বছরে প্রায় ১০ মিলিয়ন বেল তুলা আমদানি করে। যার একটি বড় অংশ সুয়েজ খালের মাধ্যমে আসে।
Comments