ফজলে হাসান আবেদের উদ্যোগ

সীমানা ছাড়িয়ে আশার জয় 

আমরা যে পরিবেশে বেড়ে ওঠেছি, সেখানে ফজলে হাসান আবেদ, ড. ইউনূস, ডা. জাফরুল্লাহ সম্পর্কে খুব যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে শেখানো হয় না। বরং অনেক বেশি নেতিবাচকভাবে, এককথায় উড়িয়ে দেবার মধ্য দিয়ে আমরা বেড়ে ওঠেছি। যে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বেড়ে ওঠার মধ্যে যে লড়াই ও সংগ্রাম থাকে, দৈনন্দিন যে মোকাবিলার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে এগুতে হয়, এই সত্যটা বোঝার শক্তি আমরা অনেকেই অর্জন করতে ব্যর্থ হই।

ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বা এরকম প্রতিষ্ঠানের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক একটা চরিত্র তৈরি করেই আমরা তাদের দেখতে অভ্যস্ত হয়েছি। ফলে, প্রতিষ্ঠান তৈরির সংস্কৃতিহীন পরিবেশের অভিজ্ঞতার চোখ দিয়ে বেড়ে ওঠা আমাদের বিবেচনাবোধ দ্রুতই এসব প্রতিষ্ঠানকে এবং প্রতিষ্ঠানের ভেতরের মূল মানুষটাকে সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করতে অভ্যস্ত।

এর মধ্যে কিভাবে ব্র্যাক বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে গেলো, বিশেষ করে পৃথিবীর সবচাইতে বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিভাবে তৈরি হলো, কিভাবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে নতুন মোড়কে নিজেদের উপস্থাপন করলো সেটা সময়ের আগ্রহের বিষয়। ব্যক্তি ফজলে হাসান আবেদকে জানতে চেয়েছি তীব্রতর আকাঙ্ক্ষায়। সংবাদকর্মী হিসেবে নিজেও বারবার ফজলে হাসান আবেদের ইন্টার্ভিউ নিতে গেছি। তার জীবনকথা শুনতে চেয়েছি। যথাযথভাবে সেটা পাইনি।

সেই অভাব মোচনে সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজার লেখা, 'ফজলে হাসান আবেদ ও ব্র্যাক' বইটি ভূমিকা রেখেছে। আমার কৌতূহলকে অনেকটাই নিবৃত্ত করেছে। কিন্তু সেখানেও ফজলে হাসান আবেদে'র বড় জীবনের অনেক কথাই অনুপস্থিত। সেখানে নতুন করে আলো ফেললেন, ব্র্যাকে আবেদ সাহেবের দীর্ঘদিনের সহকর্মী আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী। তার লেখা 'আমার ব্র্যাক-জীবন, একজন উন্নয়ন কর্মীর বেড়ে উঠা'। বইটি সম্পূর্ণ নতুন দিকে আমাদের দৃষ্টি নিয়ে গেল। কিন্তু সেখানেও ব্রাক-জীবনের অনেক গল্পই অনুপস্থিত।

এইসব বয়ানের অভাব পূর্ণ করল স্কট ম্যাকমিলান রচিত আলভী আহমেদ অনুদিত 'আশার জয়, ফজলে হাসান আবেদ ও বৈশ্বিক দারিদ্র নির্মূলের বিজ্ঞান' বইটি। প্রথমত, বইটি লিখেছেন ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে লম্বা সময় কাটানো বিদেশি সহকর্মী স্কট ম্যাকমিলান। বিদেশী সহকর্মী হবার কারণে একটা নির্ভার, ভক্তিবাদমুক্ত, পূর্বসিদ্ধান্তমুক্ত বিশ্লেষণী, স্বচ্ছ দৃষ্টি দিয়ে বিবেচনার সুযোগ পেয়েছেন স্কট ম্যাকমিলান।

কী আছে এই বইয়ে..

১.ব্যক্তি ফজলে হাসানকে সবিস্তারে জানার সুযোগ পাওয়া গেছে এই বইয়ে। কিভাবে তরুণ বয়সে একজন বিদেশিনীর প্রেমে পড়লেন আবেদ, দীর্ঘ সময় মেলামেশার পরও সেই প্রেমকে প্রণয়ে পরিণত করা গেল না, সেই ব্যক্তিজীবনের ঘটনা সবিস্তারে আছে এখানে। প্রেমময় প্রনয়হীন প্রেমিকার আত্মহত্যা কিভাবে বদলে দিলো একজন ব্যক্তি মানুষকে, সেটা জানার ফলে আজকের ফজলে হাসান আবেদকে চেনাটাও সহজ হয়।

২এরপর দু-দুটো বিবাহ, ব্যক্তিজীবনের গল্পও কম আকর্ষণীয় নয়। বড় কথা দু-জন স্ত্রীর অকাল মৃত্যু কিভাবে ফজলে হাসান আবেদের কাজের ওপর প্রভাব ফেললো, কেনো তিনি প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যু রোধের কাজে ব্র্যাককে নিয়োজিত করলেন, সেটা নতুনভাবে আমাদের ভাবাতে শেখায়। বলা চলে, প্রত্যেক মানুষের সংগ্রাম ও বেদনামুখর জীবনের প্রতি ইঞ্চির অভিজ্ঞতা কিভাবে তার চিন্তা ও কাজকে বদলে দেয়, সেটার সবিস্তার বয়ান পাঠক হিসাবে আপ্লুত করে, সেটা এই বইয়ের বড় বৈচিত্র্যময় দিক।

৩. মাতৃহারা সন্তানদের নিয়ে একজন বাবার যে সংগ্রাম, প্রতিদিনের যে নতুন নতুন লড়াই সেটাও ফজলে হাসান আবেদকে পোহাতে হয়েছে। নতুন নতুন স্ত্রীর আগমন, সংসারে থাকা সন্তানদের কিভাবে প্রভাবিত করেছে, নতুন স্ত্রীরাও পুরনো পরিবারের সন্তানদের কিভাবে গ্রহণ করেছেন, সেটা পুরো পারিবারিক জীবনকে, ব্যক্তি ফজলে হাসান আবেদকে একটু একটু করে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে,সেই দিনগুওলোকে কিভাবে মোকাবিলা করছেন তার আদ্যপান্ত আছে এই বইয়ে।

৪. একজন পুরুষের বড় হয়ে ওঠার পেছনে ঘরের ও বাইরের নারীদের প্রভাব কিভাবে কাজ করে, কিভাবে আবেদের একেজন স্ত্রী একেভাবে ব্র্যাককে বড় হয়ে ওঠার পেছনে ভূমিকা রেখেছেন, তারও বিস্তারিত বয়ান পাঠকদের সামনে এনেছেন।

৫. ব্র্যাক, সহকর্মীদের একাংশ কিভাবে ফজলে হাসান আবেদের সহযোগী হয়ে উঠছেন, সেইসব সহকর্মীদের একাংশ ফজলে হাসান আবেদের চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন সেই কাহিনী এই বইয়ের একটি বিশেষ পর্ব। ক্ষুদ্রঋণ বা মাইক্রোক্রেডিট চালু করা, তাকে প্রধানতম বিস্তারে নিয়ে আসার চিন্তাকে ব্রাকের মূল ভাবনার পথ থেকে সরে আসা-এই বিতর্ক নিয়ে কিভাবে সবচাইতে কাছের সহকর্মী খুশী কবীর বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন  সেটা খুব চিত্তাকর্ষক অধ্যায় ব্রাকের সাংগঠনিক জীবনে। ফজলে হাসান আবেদ সেই বিদ্রোহকে মোকাবিলা করতে যেয়ে ব্রাক পরিচালনা পর্ষদে কি পরিবর্তন আনলেন, কিভাবে কবি সুফিয়া কামালকে সরে যেতে হলো, কিভাবে ফজলে হাসান আবেদকে পরিত্যাগ করলেন খুশী কবীরের নেতৃত্বে একদল তরুণ তুর্কী সেই কাহিনী উঠে এসেছে।

৬.  নানাবিধ ঘাত-প্রতিঘাতে পথ চলতে চলতে একদল বিস্তত্ব সহকর্মী বিশেষ করে আমিনুল ইসলাম (ফিল্ড মার্শাল নামে পরিচিত), আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরীর মত মানুষেরা তাদের জীবন আর ব্র্যাককে একীভূত করে ফেলছেন, সেই ব্র্যাক-জীবনের বয়ানও পাঠককে টানবে খুব। ব্র্যাকমগ্ন, একমাত্র ব্র্যাককেই জীবনের ধ্রুবতারা করে প্রতিষ্ঠানঘন এসব মানুষদের জীবন চলছে, কর্মধারা চলছে, তাদের জীবনাচার, এমনকি কারও কারও মৃত্যুও ঘটেছে -সেসব বয়ানও বইয়ের বিশেষ দিক।

৭. ব্র্যাক বড় হচ্ছে, দেশের সীমানা পেরিয়ে বাইরে যাচ্ছে, দেশীয় থেকে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠছে, ফজলে হা্সান আবেদ বিদেশ স্কলারদের নিয়ে এসে ব্র্যাকের বিভিন্ন অংশে নানারকম নিরীক্ষা চালাচ্ছেন-পুরো ব্রাকের একক ইশ্বর হয়ে উঠছেন, তার ঝুলি ভরে উঠছে একের পর এক আন্তর্জাতিক নানান পুরষ্কারে, সেসব দিনের কাহিনী ও ঘটনাপ্রবাহ সবিস্তারে লিখেছেন স্কট ম্যাকমিলান।

৮. বিদেশ ডোনারদের ওপর নির্ভরতা কমাতে ব্র্যাক ঝুঁকছে ব্যবসার দিকে। এর মধ্যেই তৈরি হয়েছে বাণিজ্যিকভাবে আড়ং, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক ব্যাংক। তাহলে কি ফজলে হাসান আবেদ সরে গেছেন তার মূলভাবনা থেকে? এসব বিতর্ক তৈরি হয়েছে এমনকি আদালতেও গড়িয়েছে। এনজিও হিসাবে রেজিস্ট্রি নেয়া ব্রাক, বাণিজ্যিক ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে পারে না, এই আর্জি নিয়ে উচ্চ আদালতে হাজির হয়েছেন দেশের খ্যাতিমান সিভিল সোসাইটি নেতা অধ্যাপক অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ। সেই মামলায় ব্রাক জিতেছে। ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক ব্যাংককে কিভাবে ও কেন, পুরাদস্তুর বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসাবে দাঁড় করিয়েছেন-সেসব সবিস্তারে আছে।

৯. কোন প্রতিষ্ঠান শতাব্দীর পর শতাব্দী টেকে? সেই গবেষণার খোঁজ পেয়েছেন পশ্চিমে যেয়ে। জেনেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে সেই প্রতিষ্ঠান যার আয়ু সবচাইতে দীর্ঘ। দীর্ঘায়ু প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হবার আকাঙ্ক্ষায় তৈরি করেছেন বেসরকারি ব্র্যাক-বিশ্ববিদ্যালয়। পেশাদার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্পূর্ণ বিনাখরচে দরিদ্র-মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য এনেছেন বিল গেটস-মেলিনা গেটস ফাউন্ডেশন থেকে এক বড় ফান্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন, প্রতিষ্ঠা, ভবিষ্যতের কথা প্রতিষ্ঠাতার ভাষায় পাঠককে জানিয়েছেন এই বইয়ের লেখক।

১০. ব্র্যাক বড় হয়েছে, এর পরিচালনায় দেশ বিদেশী বিশেষজ্ঞ, আমলা, স্কলারদের যুক্ত করেছেন ফজলে হাসান আবেদ। এরই মধ্যে তিনি অনুভব করছেন আয়ু সীমিত হয়ে আসছে। ক্যান্সার তার জীবন পরিকল্পনায় বিস্তর ভাবনা এনেছে। ফলে গুছিয়ে ব্র্যাকের নেতৃত্ব ঠিক করেছেন, নতুন প্রজন্মের হাতে ব্রাক পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে, স্বেচ্ছায় অবসরে গেছেন। কিন্তু কি বিবেচনায় এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কিভাবে পরিবারকে ব্রাক পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত করেছেন-তারও প্রসঙ্গ রয়েছে।

বইয়ে স্কট ম্যাকমিলানের বড় গুণ তিনি সব পক্ষের কথা শুনেছেন। খুশী কবীর ব্র্যাক ছেড়েছেন কিন্তু কেন? বহুপক্ষীয় ভাবনার বিস্তারে বয়ানগুলো হয়ে উঠেছে জীবন্ত ও বাস্তব। সেই বিবেচনায় ব্র্যাক ও তার প্রতিষ্ঠাতার জীবন সংগ্রামের এক বাস্তবানুগ বয়ান রয়েছে ।

বৃহত্তম এনজিওর প্রাতিষ্ঠানিক গল্প জানতে চান, শুনতে চান বাংলাদেশের মত দেশ থেকে বেড়ে ওঠা এক সফল উদ্যোক্তা অসম্ভব সংগ্রাম-উচ্চাকাঙ্ক্ষার গল্প, 'বাতিঘর' থেকে প্রকাশিত বইটি অবশ্য পাঠ্য।

Comments