৬ প্রকল্প নিয়ে আটকে গেছে রেলওয়ে

বিপুল চাহিদা থাকার পরও মাত্র দুটি ট্রেন চলে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের মধ্যে। অন্যদিকে, রেলপথে উত্তরাঞ্চলে যাতায়াত করতে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি সময় প্রয়োজন হয়। এর অন্যতম কারণ, বাংলাদেশ রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রকল্প শেষ করতে পারছে না।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ছয়টি বড় প্রকল্প বছরের পর বছর ধরে থমকে আছে কিংবা অগ্রগতি খুবই কম। এর মধ্যে অর্থায়ন নিয়ে জটিলতার কারণে দুটি প্রকল্পের ভাগ্য এখন একেবারেই অনিশ্চিত।

আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ২২৫ কিলোমিটার মিটারগেজ রেললাইনকে ২৩৯ কিলোমিটার ডুয়েলগেজে রূপান্তর করার জন্য ২০১৯ সালের এপ্রিলে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল।

ঢাকার সঙ্গে সিলেটের যোগাযোগ আরও সহজ করার লক্ষ্যে ১৬ হাজার ১০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৫ সালের জুনে।

এই প্রকল্পের ৬৬ দশমিক ১৬ শতাংশের অর্থায়ন করার কথা ছিল চীন সরকারের। এমনকি ঠিকাদার নির্বাচনসহ প্রায় সব প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়েছিল।

পরবর্তীতে ২০২০ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গঠিত একটি কমিটি দুটি প্রকল্পের চুক্তি মূল্য পর্যালোচনা করতে বলে বাংলাদেশ রেলওয়েকে। তার মধ্যে একটি ছিল ঢাকা-সিলেট রেলপথের এই প্রকল্পটি। রেলওয়েকে এই প্রকল্পের ব্যয় ৩ হাজার ৩৫৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বা প্রায় ২০ দশমিক ৮০ শতাংশ কমিয়ে আনতে বলা হয়।

তবে, চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি সংশোধিত এই ব্যয়ে কাজ করতে রাজি না হওয়ায় প্রকল্পটি থমকে যায়।

প্রকল্প সম্পর্কে অবহিত কর্মকর্তারা জানান, রেল মন্ত্রণালয় ওই চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পুনরায় আলোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু গত তিন বছরে প্রকল্পের কোনো ভৌত অগ্রগতি হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, 'প্রকল্পটি এখন অনিশ্চিত। আসলে বাংলাদেশ রেলওয়ে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এখন আর আগ্রহী না।'

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান অবশ্য বলেন, প্রকল্পটির কাজ শুরু করার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আলোচনা চলছে।

তহবিল অনিশ্চয়তায় আটকে থাকা আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ২০১৬ সালের অক্টোবরে। এটি ছিল ট্রেনের ২০০ বগি ক্রয়ের এবং এই প্রকল্পেও অর্থায়ন করার কথা ছিল চীনের এক ঠিকাদারের (ট্রেন্ডারার্স ফাইন্যান্স প্রক্রিয়ায়)।

এই ঋণের জন্য কঠিন শর্ত থাকায় একটি সরকারি কমিটি আপত্তি জানায় এবং এর ফলে ২০২২ সালের আগস্টে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চীনা কোম্পানিটির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়।

এরপর থেকে এখন পর্যন্ত নতুন অর্থায়নের ব্যবস্থা করা যায়নি এবং কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যেতে পারে।

বগির ঘাটতির কারণে পূর্বাঞ্চলে নতুন ট্রেন চালু করতে বা বিদ্যমান ট্রেনের সক্ষমতা বাড়াতে পারছে না রেলওয়ে।

একটি উদাহরণ তুলে ধরে এক রেল কর্মকর্তা বলেন, কক্সবাজারে অন্তত পাঁচটি এক্সপ্রেস ট্রেনের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বগি না থাকায় সেখানে মাত্র দুটি ট্রেন চালাতে হচ্ছে।

১৪ হাজার ২৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী সেকশনকে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন করতে একটি প্রকল্প নিয়েছিল রেলওয়ে। এই প্রকল্পও আটকে আছে। কারণ, ২০২১ সালের শুরুর দিকেই চীন এই প্রকল্পে অর্থায়ন করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।

এই প্রকল্পের চুক্তি মূল্য ছিল ১১ হাজার ৫৮৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গঠিত কমিটি এই চুক্তি মূল্য ১ হাজার ৪৯৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা কমানোর প্রস্তাব দেওয়ার কয়েক মাস পরেই চীন প্রকল্পটি থেকে সরে যায়।

দেশের উত্তর-পশ্চিমের জেলাগুলোর সঙ্গে রাজধানীর সংযোগকারী রেল লাইনের সক্ষমতা উন্নত করার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের নভেম্বরে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়।

সার্বিক পরিস্থিতিতে রেলওয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য জাপানের সহযোগিতা চাইলে দেশটি রাজি হয়।

রেল মহাপরিচালক কামরুল আহসান জানান, বর্তমানে প্রকল্পটির বিস্তারিত নকশার জন্য পরামর্শক নিয়োগের জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

রেল কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০২৮ সালের আগে শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে দ্বিতীয় রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যমান সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করে রেলওয়ে। প্রকল্পের সময়সীমা ছিল ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত।

প্রকল্পের কাজ ৮২ শতাংশ শেষ হওয়ার পর চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না গত বছরের ১৫ মার্চ চুক্তি বাতিল করে। তাদের অভিযোগ, তারা ঠিকমতো পেমেন্ট পাচ্ছে না এবং সময়মতো প্রকল্পের জায়গা হস্তান্তর করা হচ্ছে না।

ইতোমধ্যে প্রকল্পটির ব্যয় ৭৩ দশমিক ৯০ শতাংশ বেড়ে ৬৫৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা হয়েছে এবং সময়সীমা ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া, ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের কার্যপরিধিও বাড়ানো হয়েছে। তবে, গত এক বছরে প্রকল্পটির কোনো ভৌত অগ্রগতি হয়নি।

রেল মহাপরিচালক জানান, প্রকল্পের বাকি কাজ সম্পন্ন করার জন্য ঠিকাদার নিয়োগে প্রস্তাবিত দর মূল্যায়ন করছে রেলওয়ে।

২০১৮ সালের মে মাসে সম্ভাব্যতা জরিপ না করেই ফরিদপুরের মধুখালী থেকে মাগুরা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প নেয় রেলওয়ে।

১ হাজার ২০২ কোটি ৪৯ লাখ টাকার প্রকল্পটি ২০২২ সালের এপ্রিলের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের ৪৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে, যার মধ্যে গত বছর অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

রেল কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পের জন্য আরও ২৯০ কোটি টাকা এবং ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত সময়সীমা বৃদ্ধি করতে চাইছে।

কামরুল আহসানের মতে, জমি অধিগ্রহণের দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও চুক্তি মূল্য বৃদ্ধি এবং কিছু উপকরণের স্পেসিফিকেশন পরিবর্তন করার জন্য ঠিকাদারদের দাবির কারণে প্রকল্পটি বিলম্বিত হয়েছিল।

তিনি বলেন, 'জমি সংক্রান্ত সমস্যা প্রায় সমাধান হয়ে গেছে এবং আমরা অন্যান্য সমস্যা সমাধানেও কাজ করছি।'

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে রেলওয়ের কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্নিমাণের জন্য ১১৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১১ সালের জুলাইয়ে আরেকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল।

প্রকল্পটি ২০১২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত সাড়ে ১২ বছরে মাত্র ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে প্রকল্পটির এবং ব্যয় পাঁচ গুণেরও বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

ভারতীয় ঠিকাদারের পক্ষ থেকে কিছু সমস্যা থাকলেও তারা আবার কাজ শুরু করেছে বলে জানান কামরুল আহসান।

বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. শামসুল হক বলেন, 'অন্যান্য অনেক খাতের মতো রেলওয়েতে সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। এভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হলেও কাউকে দায়ী করা হয় না। এর ফলে এই অন্যায়কে আরও উৎসাহিত করা হয়।'

রেলওয়ের একটি মহাপরিকল্পনা থাকলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী তহবিল না পাওয়ায় প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হয় না।

শামসুল হক বলেন, 'কিন্তু বাস্তবসম্মত উপায়ে মহাপরিকল্পনা সময়োপযোগী করার সামর্থ্য বা আগ্রহ কোনোটাই রেলওয়ের নেই।'

রেলওয়ে অবশ্য দেরি হওয়ার জন্য বৈদেশিক তহবিল নিয়ে অনিশ্চয়তা, জমি অধিগ্রহণে জটিলতা এবং প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবকে দায়ী করেছে।

রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান আহসান বলেন, 'আমরা সমস্যা সমাধানে অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছি এবং প্রকল্পগুলো নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।'

Comments

The Daily Star  | English

Life insurers mired in irregularities

One-fourth of the life insurance firms in the country are plagued with financial irregularities and mismanagement that have put the entire industry in danger.

6h ago