‘অস্তিত্ব সংকটে’ মিয়ানমারের সামরিক সরকার
মিয়ানমারে নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে দেশটির সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নেওয়ার তিন বছরের মাথায় পরিস্থিতি এতটাই পাল্টে গেছে যে, এখন শক্তিশালী এই বাহিনীটিকেই ভুগতে হচ্ছে 'অস্তিত্ব সংকটে'।
গত কয়েক মাস ধরে সরকারবিরোধী ও জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহীদের হাতে সেনাদের ক্রমাগত পরাজয়ের কারণে সেনা শাসক মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্ব শুধু নয়, তার সরকারের অস্তিত্ব এখন প্রশ্নের মুখে।
মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের তৃতীয় বছর পূর্তির দিনে তথা গত ১ ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস'র প্রতিবেদনে বলা হয়, তিন বছর পর মিয়ানমারের জেনারেলরা 'অস্তিত্ব সংকটে' পড়েছেন।
এতে আরও বলা হয়, একদিকে সেনাবিরোধীদের মনোবল যেমন চাঙা হচ্ছে, অন্যদিকে জনবল সংকটে পড়ছে সেনাবাহিনী।
জাতিসংঘের বরাত দিয়ে সম্প্রতি ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, মিয়ানমারের তিন ভাগের দুই ভাগ অঞ্চল সেনাবিরোধী সংঘাতে জর্জরিত।
সামাজিক মাধ্যমের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমটি আরও জানায়, সামরিক সরকার সমর্থিত ব্যক্তিরাও সেনাপ্রধানের ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করছেন।
সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মান্দালয় অঞ্চলেও সেনা শাসকের পদত্যাগের দাবিতে সমাবেশ হওয়ার তথ্যও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে মনে হচ্ছে— মিয়ানমারের সামরিক সরকার শুধু 'অস্তিত্ব সংকটে'ই নেই, তাদেরকে হয়ত 'পালানোর পথও খুঁজতে হচ্ছে'।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ
গত সোমবার থাইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম দ্য ইরাবতী জানিয়েছে, মিয়ানমারে সামরিক সরকারবিরোধী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) ও জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সদস্যদের হাতে গত তিন দিনে দেশটির ক্ষমতাসীন সামরিক বাহিনীর এক ডজনের বেশি সদস্য নিহত হয়েছেন। তারা তিনটি ঘাঁটিও হারিয়েছে।
এসব ঘটনা ঘটেছে কাচিন ও রাখাইন রাজ্যে এবং মান্দালায়, সাগাইং, মগওয়ে ও তানিনথারি অঞ্চলে।
বিদ্রোহীদের কাছ থেকে এসব তথ্য নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকটি ঘটনা যাচাই করা যায়নি।
স্থানীয় কাচিন সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে প্রতিবেদন বলা হয়, কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি ও কাচিন অঞ্চলের পিডিএফ যৌথভাবে মাঝি গুং এলাকায় তিনটি সেনাঘাঁটি অবরোধ করেছিল। এসব ঘাঁটি ছিল সেনাদের হালকা পদাতিক বাহিনীর।
'রাখাইন রাজ্যে সংঘর্ষ চলছে' উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত শনিবার থেকে রাজ্যের রাজধানী সিত্তের কাছে পনাংইয়ুন শহরে সেনাদের পদাতিক বাহিনীর ঘাঁটি লক্ষ্য করে আরাকান আর্মির সদস্যরা ক্রমাগত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এটি পনাংইয়ুন শহরে সেনাদের সর্বশেষ ঘাঁটি।
আরাকান আর্মি এই রাজ্যের অন্যতম বড় শহর মংডুর উত্তরে ইয়ান অং পিন সেনাঘাঁটি অবরোধের চেষ্টা করছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, গত শনিবার তানিনথারি অঞ্চলে পিডিএফ সদস্যদের হামলায় সেনা ও সেনা-সমর্থিত মিলিশিয়াদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সংঘর্ষে অন্তত এক ডজন সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন। অনেক গোলাবারুদ বিদ্রোহীদের দখলে এসেছে।
এ ছাড়াও, সাগাইং, মগওয়ে ও মান্দালায় বিদ্রোহীদের ক্রমাগত হামলার মুখে পড়ছে সেনারা।
'সরকারহীন' মিয়ানমার
গত ১ মার্চ থাইল্যান্ডের সংবাদমাধ্যম ব্যাংকক পোস্ট'র মতামতে চুলালংক্রন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ইনস্টিটিউট অব সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ ফেলো অধ্যাপক থিতিনান পংসুধিরাক মিয়ানমারকে 'সরকারহীন' রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কেননা, তার দৃষ্টিতে সে দেশে এখন সরকারবিরোধীরাই শক্ত অবস্থানে।
তিনি বলেন, সামরিক অভ্যুত্থানের তিন বছর পর এটা স্পষ্ট যে, সেনারা ক্ষমতা হারানোর দ্বারপ্রান্তে। প্রথমদিকে, হাতে গোণা কয়েকজন বিশ্লেষকই এমন দৃশ্য কল্পনা করতে পেরেছিলেন।
তার মতে, বিদ্রোহীদের হাতে মিয়ানমারের চৌকস সামরিক বাহিনীর ছোট ছোট পরাজয় অভ্যুত্থানের প্রথম বছর থেকে শুরু হলেও জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে সেনাবিরোধী সংগঠনগুলোর ঐক্যমতের ফলে দেশটির অধিকাংশ এলাকা এখন তারা নিয়ন্ত্রণে নিতে পেরেছে।
অধ্যাপক থিতিনান পংসুধিরাক আরও বলেন, সেনাবাহিনী এখন আর মিয়ানমারের একক ক্ষমতাধর সংস্থা নয়। যদিও সরকারিভাবে সেনারা এখনো মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করছে, তবে তারা প্রতিদিনই বিদ্রোহীদের কাছে একটু একটু করে ক্ষমতা হারাচ্ছে। মিয়ানমারের জনগণের কাছে এখন তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রায় শূন্যের কোঠায়।
শুধু কয়েকটি বড় শহর সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে উল্লেখ করে তিনি জানান, সেসব শহরও নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেনাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
চীন ও থাইল্যান্ডের ভূমিকা
গত রোববার বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, গত শনিবার থাইল্যান্ডের পার্লামেন্টে মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে দুই দিনের সেমিনার হয়। মিয়ানমারের সামরিক সরকারের আপত্তি সত্ত্বেও সেখানে সে দেশের সরকারবিরোধীরা অংশ নেন।
মিয়ানমারের ছায়া সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) ও জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা বক্তব্য রেখেছিলেন। সেখানে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে কেউ অংশ তো নেয়নি, উল্টো এর বিরোধিতা করেছে।
মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বার্তা সংস্থাটির কাছে কোনো মন্তব্য করেনি। এ বিষয়ে থাইল্যান্ডের থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণপূর্ব এশিয়াবিষয়ক গবেষক দুলিয়াপাক প্রিচারুশ বার্তা সংস্থাটিকে বলেন, 'পার্লামেন্ট কমিটি গণতান্ত্রিক দলগুলোর জন্য আলোচনার জায়গা করে দিয়েছে।'
সেমিনারে থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পারনপ্রি বাহিদ্ধা-নুকারার মূল প্রবন্ধ পড়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করা হয়। তবে এর কোনো ব্যাখ্যা না পাওয়া গেলেও মিয়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে যে থাই সরকারের ভাবনা আছে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে এর 'বড় প্রতিবেশী' বা 'অভিভাবক' হিসেবে পরিচিত চীনের ভূমিকা নিয়ে জার্মান সংবাদমাধ্যমে ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— 'মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে চীন দুই পক্ষের সঙ্গেই যোগাযোগ রেখে চলছে'। ২০২১ সালে সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত মিয়ানমারের জাতীয় সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন মার অং গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, 'চীন সরকার সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার পাশাপাশি এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য সব পক্ষকে চাপ দিচ্ছে।'
এ বিষয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'চীন দুই পক্ষকেই নিয়ে খেলছে'। যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব পিসের মিয়ানমার কর্মসূচির কান্ট্রি ডিরেক্টর জাসোন টাওয়ার সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, 'চীন একদিকে সামরিক সরকারের বিরোধীদের সহযোগিতা করছে। অন্যদিকে, সামরিক সরকারকে দিয়ে বিরোধীদের চাপে রাখছে।'
'চীন এখনো মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করছে' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'একইসঙ্গে সরকারবিরোধীদের ক্ষমতাসীন জেনারেলদের সঙ্গে ব্যবসা করার জন্য চাপ দিচ্ছে।'
তিনি মনে করেন, চীন চায় এই দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হোক।
এমন পরিস্থিতিতে মনে হয়- আরও কিছুদিন ভবিষ্যতের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে মিয়ানমারে সেনাদের শেষ পরিণতি কী হতে যাচ্ছে তা জানার জন্য।
Comments