হলুদ করবীর সন্ধান

হলুদ করবী। ছবি: সুলতানা কবীর

শ্বেতকরবীর অকাল জাগরণে বনে আবেশ লাগার গান শুনিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আবার তার বিখ্যাত নাটক 'রক্তকরবী'র সূত্রে মৃদু সৌরভের আবেশমাখা লাল করবীর সঙ্গেও কম-বেশি পরিচিত সবাই। তবে গান-নাটক কিংবা কবিতায় রবিঠাকুর কোথাও হলুদ করবীর কথা আলাদা করে বলেছেন কি না, তা ঠিক জানা যায়নি।

প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক মোকারম হোসেন জানাচ্ছেন, এই হলুদ করবী বাংলাদেশে খুব একটা দেখা যায় না। তবে সম্প্রতি ঢাকার দক্ষিণখানের একটি বাড়ির ছাদবাগানে ফুটন্ত হলুদ করবীর বিপুল উচ্ছ্বাস চোখে পড়ে।

অনেকে বলে থাকেন, ফাল্গুন হলো মন সাজানোর মাস ও বসন্ত হলো বন সাজানোর ঋতু। আর বাসন্তী সাজে খোঁপায় গোজার মতো সেরা ফুল হলো করবী। বসন্তের শুরু থেকেই থোকা ধরে ফুটতে শুরু করে এই ফুল। অবারিত প্রস্ফুটনে এর চিকন পাতাগুলো অনেকটা ঢাকা পড়ে যায়।

দক্ষিণখানের উচারটেক এলাকায় 'প্রফেসর হাউস' নামের ওই বাড়ির ছাদে বড় টবে লাগানো একটিমাত্র গাছে এমন আনেক হলুদ করবী ফুটে থাকতে দেখা গেল। হালকা গন্ধমাখা ফুলগুলো মনে করিয়ে দিল রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি লাইন—'ফুলগুলি যেন কথা/ পাতাগুলি যেন চারি দিকে তার/ পুঞ্জিত নীরবতা।'

ছাদবাগানে হলুদ করবী। ছবি: সুলতানা কবীর

বাড়িটি অধ্যাপক মোস্তফা হোসেন ও সুলতানা কবীর দম্পতির। সুলতানা কবীর নিজেও একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী। ছাদের বাগানটি গড়ে তুলেছেন মূলত তিনিই। এখানে আম, জাম, জামরুল, পেয়ারা, পেঁপে, করমচা, কামরাঙা, সফেদা ও আতার মতো বিভিন্ন ফলদ গাছের পাশাপাশি আছে বেগুন, টমেটো ও করলার মতো সবজি। এছাড়া টবের মাটিতেই তিনি ফলিয়েছেন পুদিনা পাতা, ধনিয়া পাতা ও মরিচের মতো আনাজ। একটি ড্রামে আবার আখ ও সুপারির চারা পাশাপাশি বেড়ে উঠতে দেখা গেল। পাশে শিশুবয়সী একটি শিমুল গাছে আসা মনোহর ফুলও আলাদাভাবে নজর কাড়ল।

সুলতানা কবীরের ছাদবাগানে গোলাপ, বেলি, পাতাবাহার, রঙ্গন, গন্ধরাজ ও বকুলের মতো পরিচিতি ফুল গাছের সংখ্যাও অনেক। কিন্তু এই মুহূর্তে তার পুরো বাগান আলোকিত করে আছে ওই হলুদ করবীগুলো।

সুলতানা জানালেন, বছর দুয়েক আগে বাগান করার সূত্রে ফেসবুকে পরিচিত হওয়া এক ব্যক্তির কাছ থেকে হলুদ করবীর চারাটি কেনেন তিনি। শুরুর বছরেই তাতে ফুল আসে। এবার ফুলের পরিমাণ আরেকটু বেশি।

করবী একটি চিরহরিৎ ঝোপ জাতীয় গাছ। উচ্চতা সর্বোচ্চ ৭-৮ ফুট। মাটি থেকে সরাসরি উঠে আসা কয়েকটি সরলাকৃতি শাখায় সরু পাতা ও ফুল দেখা দেয়। ফুল সুদৃশ্য ও হালকা সুগন্ধযুক্ত। বীজ ধূসর বর্ণের ও লোমে আবৃত।

করবীকে ইংরেজিতে বলা হয় Sweet-Scented Oleander, Indian Oleander

Apocynaceae পরিবারভুক্ত এই ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Nerium indicum

ভারতীয় উপমহাদেশে করবীর আলাদা কদর আছে। শাস্ত্রমতে, হলুদ করবী গাছে ভগবান বিষ্ণুর অধিষ্ঠান। এই ফুল দিয়ে লক্ষ্মীর পূজা করলে সমৃদ্ধি আসে।

কিন্তু করবীর বীজ, পাতা, বাকল ও রস মারাত্মক বিষাক্ত। এই বিষে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে।

এ কারণেই হয়তো জীবনানন্দ লিখেছিলেন, 'সমস্ত দিনের মাঝে লুকায়ে রয়েছে যেন অসীম সময়…/ সমস্ত রাত্রির মাঝে অনন্ত মৃত্যুর স্বাদ/ পাইনি কি?-করবী'র রৌদ্রে যেন হাত লেগে রয় প্রেমিকের...'

হাসান আজিজুল হকের 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ' গল্পে দেশভাগে উন্মূল অসহায় অক্ষম পিতা আত্মজার অবমাননা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে আত্মহননের কথা ভাবেন। বলেন, 'আমি একটা করবী গাছ লাগাই বুঝলে? ফুলের জন্য নয়, বিচির জন্য। চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে।'

কাঁটাহীন করবী ফুল দেখতে দূর থেকে অনেকটা গোলাপের মতো লাগে। এ নিয়েও ছড়া লিখেছেন ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ। সেখানে তিনি বলছেন, 'ভালোবাসা মোর রাখি নি কাঁটায় ঘিরে/ সুলভ প্রেমের দুর্দশা তাই কিরে।/ গোলাপের মত কন্টকী নই শুধু/ তাই কি এ বুকে জমে না গোলাপী মধু।'

Comments

The Daily Star  | English
Tarique Rahman on interim government

Interim govt must not be allowed to fail: Tarique addresses BNP rally

Thousands join BNP rally from Nayapaltan to Manik Mia Avenue

7h ago