ক্যানসার কেন হয়, প্রতিরোধে করণীয়

প্রতীকী ছবি | সংগৃহীত

ক্যানসার মরণব্যাধি রোগ হওয়া সত্ত্বেও তা সম্পর্কে মানুষ কতটা সচেতন? ক্যানসার কেন হয় এবং এই রোগ প্রতিরোধে করণীয় কী?

চলুন জেনে নেওয়া যাক গণস্বাস্থ্য কমিউনিটি বেজড ক্যান্সার হাসপাতালের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ও বাংলাদেশ ক্যানসার ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিনের কাছ থেকে।

ক্যানসার কী

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, ক্যানসার সম্পর্কে জানার আগে বুঝতে হবে টিউমার কী। মানুষের শরীরে কোষের বিভাজন হয়। অর্থাৎ স্বাভাবিক নিয়মে একটা কোষ থেকে অনেকগুলো ভাগ হয় শরীরের প্রয়োজনে। হঠাৎ করে যদি শরীরের প্রয়োজন ছাড়া, নিয়ম-নীতি, নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোষ ভাগ হতে থাকে, তখন অনেক অতিরিক্ত কোষের সমষ্টি হয়ে চাকা বা পিণ্ডের মতো হয়, সেটাকে বলা হয় টিউমার। এই টিউমার দুই ধরনের হয়।

১. বিনাইন টিউমার

বিনাইন টিউমার অক্ষতিকারক। এই টিউমার শরীরের যে অঙ্গে অর্থাৎ যে কোষ বা টিস্যুতে হবে, সেই টিস্যুর মধ্যেই থাকবে। টিউমার যত বড় হোক কিংবা ছোট, টিস্যুর সীমানার বাইরে যাবে না, শরীরের অন্য কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করবে না।

২. ম্যালিগনেন্ট টিউমার

ম্যালিগনেন্ট টিউমার ক্ষতিকারক। এটি শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে উৎপত্তি হয় সেখানে থাকে না। আশপাশের টিস্যুকে সরাসরি আক্রান্ত করতে পারে। আবার শরীরের লোসিকা নালীর মাধ্যমে আশেপাশের গ্রন্থিগুলো যদি আক্রান্ত হয় আর কোনো কারণে যদি রক্ত প্রবাহের মধ্যে মিশে যায়, তাহলে শরীরের যেকোনো জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। এজন্যই এটা ম্যালিগনেন্ট, আর এজন্যই এটাকে ক্যানসার বলা হয়।

ক্যানসার কেন হয় ও ঝুঁকি

ডা. রাসকিন বলেন, বংশগত, পরিবেশগত ও কিছু জীবনাচরণের কারণেই ক্যানসারের ঝুঁকি তৈরি হয়। যেমন:

বংশগত কারণ

বংশগত বা জেনেটিক কারণে অনেকে ক্যানসারে আক্রান্ত হন। যেমন: ব্রেস্ট ক্যানসার যদি মায়ের দিকের নিকট আত্মীয় মা, খালা, বড় বোন, নানি কেউ আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। অনেক শিশুদের চোখের পর্দায় রেটিনোব্লাস্টোমা নামের টিউমার থেকে ক্যানসার হয়, সেটি বংশগত কারণেই।

পরিবেশগত কারণ

ক্যানসার হওয়ার জন্য পরিবেশগত কারণের মধ্যে ভৌত পদার্থ, রাসায়নিক পদার্থ ও জীবাণুজাতীয় পদার্থ দায়ী। যেমন:

১. কেমিক্যাল বা রাসায়নিক পদার্থের মধ্যে যত ধরনের তামাক জাতীয় পদার্থ আছে তা শরীরের ৫০ শতাংশ ক্যানসারের জন্য দায়ী। ফুসফুস ক্যানসারের জন্য প্রায় ৯০ শতাংশ দায়ী তামাক। তামাকের মধ্যে ক্যানসার সৃষ্টিকারী নানা উপাদান থাকে।

২. ফিজিক্যাল বা ভৌত কারণের মধ্যে প্রধানত রেডিয়েশন ক্যানসারের জন্য দায়ী। প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক্স-রে করা হলে লিউকোমিয়া বা ব্লাড ক্যানসার হতে পারে। আবার ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত গামা রে যদি শরীরের সুস্থ টিস্যুর ওপর পড়ে, তাহলে সেখানেও ক্যানসার হতে পারে। এ ছাড়াও সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি যদি দীর্ঘসময় শরীরে পড়ে, তাহলে ত্বকের ক্যানসার হতে পারে।

৩. বায়োলজিক্যাল বা জীবাণু জাতীয় পদার্থের মধ্যে নানা ধরনের জিনিস রয়েছে, যা ক্যানসারের জন্য দায়ী। যেমন: ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস, প্যারাসাইট সবগুলোর মধ্যেই কিছু কিছু আছে, যা ক্যানসার সৃষ্টি করে। এর মধ্যে এইচ পাইলোরি নামক ব্যাকটেরিয়া আছে, যার জন্য পাকস্থলীতে ক্যানসার হয়।

এ ছাড়া হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে যদি ইনফেকশন ক্রনিক হয়, তাহলে লিভার ক্যানসার হতে পারে।

হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের যদি ক্রনিক ইনফেকশন হয়, তাহলে মেয়েদের জরায়ুমুখের ক্যানসার হতে পারে। পায়ুপথের, মুখের, খাদ্যনালির ক্যানসার হতে পারে।

অনিয়ন্ত্রিত লাইফস্টাইলের কারণে

১. ওরাল হাইজিন যেমন দরকার ওরাল ক্যানসার থেকে রক্ষা পেতে, তেমনি ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা দরকার বিশেষ করে মেয়েদের সারভাইভাল ক্যানসার থেকে সুরক্ষার জন্য। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে ক্যানসারের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

২. অতিরিক্ত প্রাণীজ প্রোটিন যারা খান, যার মধ্যে ফাইবার কম থাকে, যারা চর্বি জাতীয় খাবার বেশি খান, তাদের কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে নারীরা যদি এ ধরনের খাবার বেশি খায়, তাহলে মোটা হওয়া ও ওজন বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকবে, ওবেসিটি হবে। আর ওবেসিটি যত বেশি হবে, ব্রেস্ট ক্যানসারের ঝুঁকিও তত বাড়বে।

৩. যারা বেশিরভাগ সময় শুয়ে-বসে থাকে, হাঁটা-চলা করে না, ব্যায়াম করে না, তাদের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।

৪. বাল্যবিবাহ, অল্প বয়সে সন্তান হওয়া, বেশি সন্তান জন্ম দেওয়া, ঘন ঘন সন্তান জন্ম ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভাব থাকলে জরায়ুমুখের ক্যানসার হতে পারে। আবার ৩০ বছর বয়সের পরে বিয়ে হলে, সন্তানকে স্তন্যদান না করলে নারীদের ব্রেস্ট ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।

৫. মাল্টিপল সেক্সুয়াল পার্টনার ও অস্বাভাবিক যৌন আচরণের কারণে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের ইনফেকশন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এতে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।

৬. অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে মুখের ক্যানসার থেকে শুরু করে খাদ্যনালী, পাকস্থলী ও লিভার ক্যানসার হতে পারে।

ক্যানসার প্রতিরোধে করণীয়

১. তামাক জাতীয় জিনিস ও অ্যালকোহল পরিহার করতে হবে।

২. বাল্যবিবাহ রোধ করলে, সন্তানকে স্তন্যদান করলে, ওরাল ও ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চললে ব্রেস্ট ক্যানসারের ঝুঁকি কমে।

৩. শাকসবজি, ফলমূল, বিটা ক্যারোটিন ও আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে, যা ক্যানসার থেকে সুরক্ষা দেয়। একইসঙ্গে চর্বিযুক্ত, অস্বাস্থ্যকর ও জাঙ্ক ফুড পরিহার করতে হবে।

৪. ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটি বাড়াতে হবে, নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস ও ব্যায়াম করতে হবে।

৫. হেপাটাইটিস 'বি'র ভ্যাকসিন নিতে হবে ক্যানসার প্রতিরোধে। এখন শিশুদের এই ভ্যাকসিন দেওয়া হয় টিকা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে। এ ছাড়া অন্যরাও এই ভ্যাকসিন নিতে পারবেন।

৬. হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস, যেটা ৯৯ শতাংশ জরায়ুমুখ ক্যানসারের জন্য দায়ী, এটি প্রতিরোধে ভ্যাকসিন আছে। নয় থেকে ১৪ বছর বয়স এই ভ্যাকসিনের উপযুক্ত সময়। এ ছাড়া ২৫ বা ৪০ বছর বয়সেও এই ভ্যাকসিন নিলে কিছুটা সুরক্ষা দেবে।

৭. মাল্টিপল সেক্সুয়াল পার্টনার ও অস্বাভাবিক যৌন আচরণ পরিহার করতে হবে।

৮. অপরিকল্পিত নগরায়ন বন্ধ করতে হবে। নিয়মনীতি বাস্তবায়ন, খেলার মাঠ, হাঁটার জন্য ফুটপাত রাখতে হবে।

৯. ক্যানসার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে সর্বস্তরে।

Comments

The Daily Star  | English

Money laundering: NBR traces Tk 40,000cr in assets abroad

The National Board of Revenue has identified overseas assets worth nearly Tk 40,000 crore, accumulated with money laundered abroad from Bangladesh, according to the Chief Adviser’s Office.

1h ago