ফ্লোর প্রাইসের ভুল থেকে শেখেনি বিএসইসি, আবারও সূচকে হস্তক্ষেপ

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিএসইসি, ফ্লোর প্রাইস, শেয়ারবাজার, সূচক,

শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতে সম্প্রতি কোম্পানির শেয়ারের দাম কমার সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

তবে নতুন সিদ্ধান্ত কাজে দিচ্ছে না, কারণ বিনিয়োগকারীরা নতুন সীমার মধ্যে শেয়ার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে।

গত বুধবার পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা একদিনে দর পতনের সীমা আগের ১০ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনে।

ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের দুই মাস না যেতেই সর্বশেষ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি। কারণ ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হলেও বাজারের উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু বাজারে সূচক তিন বছরের সর্বনিম্নে নেমে এসেছে।

এর আগে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট, বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতার কারণে দেশের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের পতন ঠেকাতে ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে ফ্লোর প্রাইস চালু করা হয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে বিএসইসির বার বার হস্তক্ষেপে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে। আর এমন এক সময়ে দর পতনের সীমা কমানো হলো যখন বিনিয়োগকারীরা ফ্লোর প্রাইসের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। কারণ ফ্লোর প্রাইস চালু থাকার ১৮ মাসে বেশিরভাগ শেয়ারের লেনদেন হয়নি।

এখন মনে হচ্ছে করপোরেট মুনাফা হ্রাস, নিম্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস, অব্যাহত উচ্চ মূল্যস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন এবং রিজার্ভ হ্রাসের কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার দিকে ঝুঁকছেন। তার মানে, বাংলাদেশ কবে নাগাদ বর্তমান অনিশ্চয়তা থেকে বের হতে পারবে তার কোনো সুস্পষ্ট আভাস নেই।

বিনিয়োগকারীরা এখন চরম আস্থাহীনতায় ভুগছেন। ফ্লোর প্রাইস এই আস্থাহীনতাকে আরও তীব্র করেছে। তাই নতুন কোনো নীতি বাস্তবায়নের আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত ছিল যথাযথ বিশ্লেষণ ও গবেষণা করা, যেন তাদের কোনো সিদ্ধান্ত ভালোর বদলে উল্টো ক্ষতির কারণ না হয়।

বিএসইসির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, ৩ শতাংশ দর পতনের সীমা নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা কোনো গবেষণার ভিত্তিতে নেওয়া হয়নি।

'এমনকি বিএসইসির কোনো আনুষ্ঠানিক কমিশন বৈঠকের মাধ্যমেও এই সিদ্ধান্ত আসেনি,' বলেন তিনি।

ফ্লোর প্রাইসের কারণে ইতোমধ্যে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার নিয়ে আস্থা সংকটে ভুগছেন। আর বিএসইসির নতুন এই সিদ্ধান্ত তাদের আস্থা সংকট আরও তীব্র করেছে। কারণ তাদের আশঙ্কা, তাদের বিনিয়োগ আবার আটকে যেতে পারে, এর আগে যেভাবে ফ্লোর প্রাইস চালু থাকার সময়ে আটকে ছিল।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, 'নিয়ন্ত্রক সংস্থার এভাবে বাজারে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। বরং সরবরাহ ও চাহিদা অনুযায়ী বাজার চলতে দেওয়া উচিত।'

ফ্লোর প্রাইস চালু করে কৃত্রিমভাবে দীর্ঘদিন সূচক উচ্চ পর্যায়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু বুধবারের হস্তক্ষেপের পর বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করছেন, বাজার আবার অচল হয়ে পড়বে।

'তাই বাজার নেতিবাচক প্রবণতা দেখিয়েছে,' বলেন তিনি।

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিএসইসির প্রধান ছিলেন, কিন্তু এ সময়কালে এ ধরনের কোনো ভাবনা তার মাথায় আসেনি বলে জানান তিনি।

তিনি মন্তব্য করেন, 'বাজারে হস্তক্ষেপ করা কমিশনের কাজ নয়।'

বুধবারের সিদ্ধান্তের পর রোববার বাজার ঊর্ধ্বমুখী হলেও বেশ কয়েকজন স্টেকহোল্ডার এজন্য কমিশনের মৌখিক আদেশকে দায়ী করেছেন। তাদের অভিযোগ, কিছু বড় বিনিয়োগকারীকে প্রধান সূচক ঊর্ধ্বমুখী করতে বাজারে প্রচুর বিনিয়োগ করতে বলা হয়েছিল।

একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে বাজারে হতাশা বিরাজ করছে। বিএসইসির সর্বশেষ সিদ্ধান্ত সেই হতাশা আরও বাড়াবে।

বিএসএইসির সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একটি ব্রোকারেজ ফার্মের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তিনি বলেছেন, 'নিয়ন্ত্রক সংস্থা আনুষ্ঠানিক কমিশন সভা না করে এ জাতীয় আদেশ জারি করতে পারে কি না?'

তিনি বলেন, 'বিধি মোতাবেক আদেশ জারির জন্য কমিশনের সভা হওয়া দরকার। কিন্তু বাজারের দর পতন ঠেকাতে হঠাৎ করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি।'

এই ব্রোকার বলেন, এই সীমা না থাকলে সূচকগুলো হয়তো বেশ কয়েকদিন পড়ে যেত, কিন্তু এক সময় ঘুরে দাঁড়াত।

'এখন বিএসইসির এই হস্তক্ষেপ বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও কমাতে পারে। তাই নিয়ন্ত্রক সংস্থা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার নামে তাদের ক্ষতি করছে,' যোগ করেন তিনি।

একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে বাজারে হতাশা বিরাজ করছে। বিএসইসির সর্বশেষ সিদ্ধান্ত সেই হতাশা আরও বাড়াবে।

তিনি বলেন, 'এটি বাজারের জন্য মোটেও ভালো সিদ্ধান্ত নয়।'

তার মতে, পতনের সীমা নির্ধারণের পেছনে যুক্তি হচ্ছে বাজার একদিনে ১০ শতাংশ দর পতন হবে না।

'তবে, আস্থা এবং দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বাজারে যেটুকু পতন হওয়ার তা অবশ্যই হবে এবং ১০ শতাংশ কমতে তখন তিন দিন সময় লাগতে পারে, এই যা' বলেন তিনি।

বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং কারসাজি বন্ধে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে মনোনিবেশ করার পরামর্শ দেন ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী।

বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, কিছু বড় মূলধনী কোম্পানির শেয়ারে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে, যে শেয়ারগুলোর পতনে সূচকের ওপর বড় প্রভাব পড়ছিল। তাই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তিনি আশা করেন, খুব শিগগির বড় বিনিয়োগকারীরা বাজারে অংশগ্রহণ বাড়াবেন। তখন বাজার আবার উর্ধ্বমুখী হবে।

এই নীতি খুব স্বল্প সময়ের জন্য নেওয়া। বাজার ঊর্ধ্বমুখী হলেই এটি তুলে নেওয়া হবে, তিনি যোগ করেন।

Comments