‘বস’ আইয়ুব বাচ্চুকে এখনো যেভাবে দেখেন এস আই টুটুল

ঢাকা ছেড়ে তিনি চট্টগ্রামে চলে যান ‘বস’ আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে দেখা করবেন বলে। এরপর বসের সঙ্গে পরিচয়, সাহচর্যে আসা, ঘনিষ্ঠতা, একসঙ্গে মিউজিক...
আইয়ুব বাচ্চু ও এসআই টুটুল। ছবি: এসআই টুটুলের সৌজন্যে

বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের অন্যতম প্রবাদপ্রতিম তিনি। তাকে দেখে গিটার হাতে তুলে নিয়েছে হাজারো তরুণ। গিটারের তারে সুর তুলেছে তার বহুগানের। ওই ছয়তারের ছন্দে তিনিও মাতিয়েছেন বহু বছর। গিটার বাজানো, গায়কি, সুর, কথা—সবকিছুতেই ছিল তার পারদর্শিতা। তিনি আইয়ুব বাচ্চু।

যেসব হাজারো তরুণ তাকে দেখে মিউজিক করার স্বপ্ন দেখেছে, চেয়েছে তার সঙ্গে দেখা করতে, তার সান্নিধ্য পেতে, তাদেরই একজন শহীদুল ইসলাম টুটুল, যিনি এস আই টুটুল নামে পরিচিত। ঢাকা ছেড়ে তিনি চট্টগ্রামে চলে যান 'বস' আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে দেখা করবেন বলে। এরপর বসের সঙ্গে পরিচয়, সাহচর্যে আসা, ঘনিষ্ঠতা, একসঙ্গে মিউজিক...

বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের অবিসংবাদিত প্রাণপুরুষ 'বাচ্চু ভাইয়ের' ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীর দিন গত শুক্রবার দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথোপকথনে সেই সময়গুলো নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন এস আই টুটুল

ছবি: এসআই টুটুলের সৌজন্যে

বসের সঙ্গে পরিচয়

আমার পরিবারের সবাই সংগীতপ্রেমী। আমার বাবা গান করতেন, ভাই-বোনরা সবাই গান করতেন। আমিও খুব ছোটবেলা থেকেই গান ভালোবাসতে শুরু করি। আরেকটু বড় হয়ে কি-বোর্ড বাজানো শিখলাম। ১৯৮২-৮৩ সাল থেকেই ব্যান্ডের গান শুনতাম, আজম খানের গান বা সোলস-ফিডব্যাকের গান শুনতাম। ফলো করতাম সোলসের আইয়ুব বাচ্চুকে, যিনি আগে 'ফিলিংস' ব্যান্ডে বাজাতেন। কুষ্টিয়াতে বন্ধুদের সঙ্গে একটা ব্যান্ডও করি—শিঞ্জন—সেখানে কি-বোর্ড বাজাতাম, গান গাইতাম। ১৯৮৬ সালে এইচএসসি পাস করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় এলো। আমি ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। কিন্তু মনের গভীরে আইয়ুব বাচ্চুর সান্নিধ্য পাওয়ার যে স্বপ্ন ছিল, সেটা আমাকে নিয়ে গেল চট্টগ্রাম। গিয়ে ভর্তি হলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।

চট্টগ্রাম শহরে থাকতে শুরু করলাম ভাইয়ের বাসায়। সেখানে গিয়ে জানলাম আমার ভাইয়ের সঙ্গে আইয়ুব বাচ্চুর একটা যোগাযোগ আছে, এমনকি বাসায়ও যাতায়াত আছে। সুযোগ খুঁজছিলাম কীভাবে বাচ্চু ভাইয়ের কাছাকাছি যাওয়া যায় বা তার সঙ্গে বাজানোর একটা উপলক্ষ্য তৈরি হয়। ভাইয়ের কাছে আবদার করলাম আপাতত যেকোনো একটা ব্যান্ডে আমাকে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় কিনা। ভাই তখন তার আরেক বন্ধু পার্থ বড়ুয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। পার্থদা ছিলেন বাচ্চু ভাইয়ের স্টুডেন্ট। তার একটা ব্যান্ড ছিল, নাম 'মেসেজ'। আবার 'স্পার্কস' নামে আরেকটা নতুন ব্যান্ড গঠনে সাহায্য করছিলেন পার্থদা। আমাকে বললেন ওই ব্যান্ডে কি-বোর্ড বাজানোর জন্য। আমাকে তিনি শেখাবেন, কোনো ঘাটতি থাকলে পূরণ করে দেবেন বললেন। তারপর 'মেসেজ' ব্যান্ডের কি-বোর্ড কিনলাম 'স্পার্কসের' সঙ্গে কাজ করার জন্য। এরপর প্র্যাকটিস শুরু করি, পার্থদা'র কাছে শিখি, সকালে চলে যাই তার বাসায়।

বছরখানেকের মধ্যে আমরা শো করা শুরু করলাম। এর মধ্যে একদিন বাচ্চু ভাই হঠাৎ এলেন আমাদের প্র্যাকটিস প্যাডে। আমি তো মনে হলো স্বপ্ন দেখছি। তিনি এসে বললেন, তার কি-বোর্ড লাগবে একটা প্রোগ্রামের জন্য। আমি তো মনে মনে ভাবি, 'আপনার জন্য রক্ত লাগলে তাও দেবো'। যাহোক বাচ্চু ভাই গিটার ধরলেন আর আমাকে বললেন, 'কি-বোর্ডে একটু খেলো তো'। কিছুক্ষণ বাজানোর পর বললেন, 'তুমি তো সুন্দর বাজাও। তোমাকে দিয়ে হবে'।

এরপর মাঝেমাঝেই তিনি আমাদের প্র্যাকটিস প্যাডে আসতেন। আর আমার কারণে ভাইয়ের বাসায় তার আসা-যাওয়া বেড়ে গেল। আমি তার কাছে লেসন চাইতাম, তিনি কিছু কিছু দিতেন। ইতোমধ্যে দুয়েকবার 'মেসেজ' ব্যান্ডের সঙ্গে বাজানো হয় আমার। এর মধ্যে 'ফিলিংস' ব্যান্ডের কি-বোর্ডিস্ট পাবলো ভাই ঢাকা চলে যান। এবার জেমস ভাই আমাকে ডাকলেন তাদের ব্যান্ডে বাজানোর জন্য। তারা তখন প্রচুর ইংরেজি গান করে—ডায়ার স্ট্রেইট, ক্রিস রিয়া, ক্রিস ডি বার্গ। আগ্রাবাদ হোটেলে তাদের প্রতিদিন শো থাকে। আমাকে প্রায় ৩০০-র মতো ইংরেজি গান দেওয়া হয় তোলার জন্য। সারারাত গান তুলি, বিকেলে প্র্যাকটিসে যাই।

ছবি: এসআই টুটুলের সৌজন্যে

এলআরবি প্রতিষ্ঠা

আমার মাথায় তো সেই আগের চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে, বসের অর্থাৎ আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে বাজাতে হবে। এর মধ্যে সোলসের কি-বোর্ডিস্ট সুহাস ভাই অ্যামেরিকায় চলে গেলে পার্থদা যোগ দিলেন তার পরিবর্তে। বাচ্চু ভাই আবার সলো শো করতেন। তখন তারা একটা বিষয় মেনে চলতেন—কারো সলো শোতে নিজব্যান্ডের মেম্বার নেওয়া যেত না। বাচ্চু ভাই আগে তার শোতে কি-বোর্ডিস্ট হিসেবে পার্থদাকে নিলেও এবার আর নিতে পারছেন না। অবশেষে আমার ডাক পড়ল বসের শোতে বাজানোর।

১৯৯০ সালের দিকে আইয়ুব বাচ্চু মনস্থির করলেন নতুন ব্যান্ড করবেন। আমি তখন 'স্ট্র্যান্ড' নামে আরেকটা ব্যান্ডে বাজাই, ওই ব্যান্ডের তখন অ্যালবামের কাজ শুরু করেছি। ওই কাজের জন্য ঢাকা যাওয়া-আসা শুরু। মালিবাগে বাচ্চু ভাইয়ের বাসায় গিয়ে আমরা থাকতাম। এর মধ্যে বাচ্চু ভাইয়ের বিয়ে। আমি আর আমাদের ড্রামার জয় বিয়েতে বেশ খাটা-খাটনি করলাম। সেসময় বসের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ হলো। বিয়ের পর 'সোলস' ছেড়ে দিয়ে আমাকে আর জয়কে ডাকলেন, 'ফিলিংস' থেকে স্বপন ভাইকে বেইজ গিটার বাজাতে ডাকলেন বস। আমাদের তিনজনকে নিয়ে গড়ে তুললেন এলআরবি। প্রতিদিন প্র্যাকটিস, নিয়মিত শো, ঢাকায় যাওয়া-আসা এভাবেই চলল। কোনোকিছুই আমাদের আটকাতে পারেনি। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঝড়ের রাতেও আমরা প্র্যাকটিস করেছি মনে আছে।

ছবি: এসআই টুটুলের সৌজন্যে

'মেন্টর' আইয়ুব বাচ্চু

তিনি একদিকে যেমন খুব কড়া ছিলেন, তেমন আদরও করতেন, আবার অভিমান করতেন, ঝগড়াও করতেন। আইয়ুব বাচ্চুর মতো ব্যান্ড লিডার বা মেন্টর—যেটাই বলি না কেন, এমন একজন থাকলে সেই ব্যান্ডকে আটকানো সম্ভব নয়। তার মতো শিক্ষক থাকলে শিখতেই হবে। আইয়ুব বাচ্চু আমার গুরু। আমি তার গান খুব পছন্দ করি। কিন্তু তার গিটার বাজানোর ভক্ত আমি। আমার মতে তার মতো গিটারিস্ট এখনো বাংলাদেশে আসেনি। আমি জানি অনেকে অনেক সুন্দর বাজান। সবার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু আমার বসের হাতে যে রস ছিল, তা দিয়ে কখনো মানুষের চোখের পানি ঝরেছে, কখনো হৃদয়ে ক্ষরণ হয়েছে। এত সুরেলা ছিল তার বাজানো যে, হয়তো তিনি অনেক জটিল কিছু বাজাতেন না, কিন্তু তার সুরের মূর্ছনা অন্যদের থেকে অবশ্যই আলাদা ছিল। তার গিটার বাজানোর নিজস্ব একটা সিগনেচার ছিল।

গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চুর পর সুরকার-গীতিকার আইয়ুব বাচ্চুরও ভক্ত আমি। সেই তুমি, ফেরারী মন, ভাঙা মন, স্মৃতি নিয়ে, তিন পুরুষ, মাধবী, হকার ইত্যাদি তার লেখা গান। তার সুরে 'শেষ চিঠি' গানটি গেয়েছিলাম আমি। আমি গান গাইতে চাইতাম না, হারমোনাইজ করতাম। হারমোনাইজেশনের কারণে প্রতিটি গানে আলাদা সাউন্ড তৈরি হতো। ১৯৯১ সালের শেষদিকে এলআরবির প্রথম অ্যালবাম রেকর্ডিংয়ের সময় 'শেষ চিঠি' গানের সব ট্র্যাক রেকর্ডিং শেষ। বাচ্চু ভাই বললেন, এ গানটা তিনি গাইবেন না, আমাকে গাইতে বললেন। আমি বললাম, 'আমি বস গান গাইতে পারি না'। কিন্তু বস বলছেন গাইতে, মানে এটা একটা অর্ডার। এভাবেই চলতে থাকল... এরপর থেকে তো ২০০৩ সাল পর্যন্ত পুরো সময়টা তার ছায়াসঙ্গী হয়ে কাটিয়ে দিলাম।

ছবি: এসআই টুটুলের সৌজন্যে

বিশেষ স্মৃতি

১৯৯৪ সালের দিকে ঢাকায় কলাবাগানে থাকি স্বপন ভাই আর আমি। নিয়মিত সোনারগাঁ হোটেলে শো করি। এর মধ্যে একবার আমাদের হাতে টাকা নেই। হেঁটে হোটেলে যাই, বাজাই, খাওয়া-দাওয়া করে বাসায় ফিরি। সারাদিন আর কিছু খাই না। বাচ্চু ভাই একদিন আমাকে দেখে বললেন, 'তোর মুখ শুকনা কেন?' আমি তো বলি না। বস চেপে ধরলেন। বললাম, 'বস টাকা নেই'। বস সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে দিলেন। আমাকে প্রচণ্ড আদর করতেন। সবসময় কাছে রাখতেন। আমি তার স্টুডেন্ট ছিলাম। ব্যান্ড থেকে চলে যাওয়ার পরও আমি তার স্টুডেন্ট ছিলাম। ২০১৮ সালে বস চলে যাওয়ার আগে একবার অসুস্থ হয়েছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি হলেন। ডাক্তার এক্সারসাইজ করতে বলেন, কিন্তু শোনেন না তিনি। আমি গিয়ে বললে বস এক্সারসাইজ করতেন। ২০০৩ সালে এলআরবি ছেড়ে গেলেও বসের সঙ্গে মনের দূরত্ব কখনোই হয়নি।

'বস' যেদিন মারা যান তখন আমি আমেরিকায়। মনে হচ্ছিল আমার পৃথিবীটা শূন্য হয়ে যাচ্ছে। কারণ আমার মনে হতো, পৃথিবীর কোনো কিছু আমাকে ক্ষতি করার আগে বস এসে সেটা প্রতিহত করবেন। এটা আমার এখনো মনে হয়। আমি তার সন্তানের মতো ছিলাম, তার স্নেহের ছায়ায় ছিলাম। তার সঙ্গে আমার যে জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক, সেটার কাছে সব রাগ-অভিমান তুচ্ছ।

Comments

The Daily Star  | English
protesters attempt to break Bangabhaban barricade

Law enforcers stop protesters from breaking thru Bangabhaban barricade

A group of protesters attempted to break through the security barricade in front of Bangabhaban around 8:30pm

2h ago