বুদ্ধুর পুরি: সূত্রাপুরের স্বাদের জাদু

বুদ্ধুর পুরি
ছবি: জাওয়াদ সামি নিয়োগী

প্রতিদিন বিকেল হতেই পুরান ঢাকার সুত্রাপুরের ডালপট্টির কাছের একটি গলিতে ভিড় জমে যায়। আর এই ভীড়ের কারণে বুদ্ধুর পুরি। সূত্রাপুরের বিখ্যাত স্বাদের এই পুরি স্থানীয়দের কাছে ভীষণ প্রিয়।

তাই বিকেলের চায়ের আড্ডায় কিংবা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে হাসি-গল্পের অনুষঙ্গ হিসেবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এলাকাবাসীর প্রিয় বুদ্ধুর পুরি।

নামে বিখ্যাত হলেও বুদ্ধুর পুরি বিক্রি হয় ছোট্ট একটি দোকানে। গত ৭০ থেকে ৭৫ বছর ধরে এই ছোট দোকানটিই স্বাদ আর ঐতিহ্য বজায় রেখে বিক্রি করে চলেছে কয়েক ধরনের পুরি। দোকানটির প্রতিষ্ঠাতার নাম আফতাব উদ্দিন, পাড়ার লোকজন যাকে ভালোবেসে ডাকতেন বুদ্ধু বলে।

পুরি
ছবি: জাওয়াদ সামি নিয়োগী

তিনিই এই এলাকায় পুরি বিক্রির ছোট দোকানটি খোলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার পুরির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে গোটা এলাকায়। আফতাব উদ্দিন বন্ধুবৎসল ছিলেন। প্রতিবেশিরাও তাকে দারুণ পছন্দ করতেন। ক্রেতাদের কাছে সে বিষয়টিও ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৯২ সালে আফতাব উদ্দিনের মৃত্যুর পর পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেন তার ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফ। বুদ্ধুর পুরির দোকানটি দুই শিফটে খোলা থাকে। প্রথম দফায় প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এরপর কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার বিকাল ৫টায় খোলে, বিকিকিনি চলে রাত ৯টা পর্যন্ত।

মেনুতে আছে ডাল পুরি, যার দাম ১০ টাকা। আরও পাওয়া যায় চিকেন কিমা পুরি, ডিম পুরি এবং টাকি মাছের পুরি। এগুলোর প্রতিটির দাম ৩০ টাকা। এর মধ্যে টাকি মাছের পুরি মৌসুমি, কেবল শীতকালেই পাওয়া যায়।

সূত্রাপুর
ছবি: জাওয়াদ সামি নিয়োগী

বুদ্ধুর পুরির সবচেয়ে দারুণ বিষয় হলো এখানে কখনো ঠান্ডা পুরি পরিবেশন করা হয় না। প্রতিবার অর্ডারের পর গরম গরম পুরি তৈরি করে ভেজে দেওয়া হয়। যত বেশি গ্রাহকই থাকুক না কেন, যত ভিড়ই হোক না কেন, সবাইকেই গরম পুরি ভেজে পরিবেশন করা হয়।

ইউসুফ বলেন, 'ডালপুরি আমাদের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত আইটেম। আব্বা ডালপুরি দিয়েই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। আমি সেই মেনুতে আইটেম বাড়িয়েছি, আপনি সেগুলো দেখতেই পাচ্ছেন।'

'ডিম পুরি শুরুতে জনপ্রিয় ছিল না। এটা মূলত কিছু গ্রাহকের অনুরোধে বানানো হয়েছিল। এরপর একদিন এটা ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে গেল। তখন গ্রাহকের চাহিদা মেটাতেই একে মূল মেনুতে যুক্ত করতে হলো।'

দোকানে কথা হয় ইলিয়াসের সঙ্গে। বুদ্ধুর পুরিতে তিনি সাত বছর ধরে কাজ করছেন। মূলত পুরির ভেতরের যে মশলা বা পুর সেটি তিনিই তৈরি করেন।

ইলিয়াস বলেন, 'যেহেতু ডালপুরি সবচেয়ে সস্তা, তাই এটাই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। বিশেষ করে স্থানীয়রা একবারে অনেকগুলো করে কিনে নিয়ে যান যেন বাড়ির সবাই মিলে খেতে পারেন। কিমা পুরিও অনেক জনপ্রিয়। কিন্তু শীতকালে সবচেয়ে বেশি অনুরোধ আসে টাকি পুরির।'

একটা সময় পর্যন্ত বুদ্ধুর পুরির দোকানে চাও বিক্রি হতো। কিন্তু চায়ের সরঞ্জামের দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় এখন চা বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

ইউসুফ বললেন, 'একটা সময় দেখলাম চায়ের কাঁচামাল ভীষণ দামি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি সেই অনুপাতে চায়ের দাম বাড়াতে চাইনি। কারণ আমার ক্রেতারা সবাই ছিলেন পরিচিত, স্থানীয়। তাই বাধ্য হয়ে চা বিক্রি বন্ধ করে দিই।'

বুদ্ধুর পুরির দোকানে কথা হয় দীন ইসলামের সঙ্গে। তিনি একজন চাকরিজীবী, নিয়মিত এই দোকানে আসেন।

তিনি বলেন, 'আমার জন্য বুদ্ধুর পুরি খুবই স্পেশাল। এর স্বাদ সবসময় একইরকম এবং আমি কোনোদিন স্বাদ বা মানে কোনও কমতি দেখিনি।'

গত ১২ বছর ধরে বুদ্ধুর পুরির নিয়মিত ক্রেতা ধুপখোলার ব্যবসায়ী আমজাত।

তিনি বলেন, 'এই দোকানে নিয়মিত আসার বড় কারণ হলো এর স্বাদ অপরিবর্তনীয়। সেই প্রথমদিন যেমন খেয়েছিলাম, এখনও ঠিক তেমনই স্বাদ।'

তিনি আরও বলেন, 'আমি ডিম পুরি খেতে ভালোবাসি, টাকি পুরিও। যদিও টাকি পুরি সারাবছর পাওয়া যায় না, নভেম্বর থেকে শুরু করে শীতকালেই এটা পাওয়া যায়।'

কোন বিষয়টা বুদ্ধুর পুরিকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে, জানতে চেয়েছিলাম ইউসুফের কাছে।

তিনি তার বাবার একটা দারুণ গল্প বললেন আমাদের।

ইউসুফ বলেন, 'যখন আমার বাবা এই দোকানটা শুরু করেন, তখন সুইপাররা এই এলাকায় কাজ করতেন। কিন্তু যেকোনো দোকানে বসে খাবার খাওয়ার বা গল্প করার অনুমতি ছিল না তাদের। সেই সময় আমাদের দোকানে ছোট্ট এক টুকরো উঠান ছিল। বাবা সেই উঠানে সুইপারদের যখন ইচ্ছা তখন বিশ্রাম নেওয়ার, বসে পুরি খাওয়ার এবং সময় কাটানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তবে কেবল সুইপাররাই নন, যে কেউ চাইলে সেখানে বসে খেতে পারতেন, বিশ্রাম নিতে পারতেন। আপনি কে, কোন ধর্মের, কী কাজ করেন বা আপনার পরিচয় কী-তার কোনোকিছুই এখানে মুখ্য নয়। আমার দোকানের দরজা সবসময়ই সবার জন্য খোলা।'

বাবার ঐতিহ্য ধরে রেখে তা এগিয়ে নিয়ে যেতে কাজ করতে পেরে গর্বিত মোহাম্মদ ইউসুফ। সেইসঙ্গে বাবার স্মৃতিচারণ করতেও ভালোবাসেন তিনি।

তিনি বলেন, 'আপনারা আমার দোকানে ভালোবেসে আসেন, ভালোবাসা নিয়ে আসেন। এটাই আমার দোকানকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। এই ভালোবাসা কখনো মুছে যাবে না, এখানেই থাকবে।'

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English

A good example of a bad plan

A year on, Karnaphuli tunnel losing over Tk 27 lakh a day

6h ago