১১২ পেরিয়ে ‘নট আউট’ আনন্দ কনফেকশনারি

‘দাদা যে প্রক্রিয়ায় খাবার বানাতেন, সেটাই যথাসম্ভব অনুসরণ করি। আমাদের খাবার মানুষের কাছে ভালো লাগলে, তারা আনন্দ পেলে তাতে আমরাও খুশি।’
ছবি: সংগৃহীত

পুরান ঢাকার সাত রওজায় আবুল হাসনাত রোডে অবস্থিত আনন্দ কনফেকশনারি। নামে কনফেকশনারি হলেও এটি মূলত বেকড পণ্য বিক্রি করে। অর্থাৎ এটি একটি বেকারি।

কনফেকশনারি ও বেকারির ভেতর পার্থক্য আছে। কনফেকশনারি মূলত মিষ্টি জাতীয় জিনিস, ক্যান্ডি, চকলেট ইত্যাদি বিক্রি করে থাকে। তবে আভিধানিকভাবে যাই হোক না কেন, আনন্দ কনফেকশনারি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েও দিব্যি নট আউট হয়ে রয়ে গিয়েছে।

শুরুটা ১৯১১ সালে। আজ থেকে ১১২ বছর আগের কথা। ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে ঢাকা আসেন চান মিঁয়া। নিতান্তই অল্প বয়স তখন। ঢাকার বাংলাবাজারের খুব কাছেই নর্থব্রুক হল। স্থানীয়ভাবে লালকুঠি নামে পরিচিত এই হলে তখন মঞ্চনাটক হয়। সংস্কৃতি অঙ্গনের লোকজনের বেশ আনাগোনা এদিকে।

চান মিঁয়া সেই হল তথা লালকুঠির পাশে এক বেকারির দোকানে কাজ নেন। সেটি আরও আগের কথা। তখনও বঙ্গভঙ্গ রদ হয়নি। এরপর ১৯১১ তে বঙ্গভঙ্গ রদ হলো। ব্রিটিশ মালিক ব্যবসা গুটিয়ে বেকারি ছেড়ে চলে গেলেন।

রকমারি বেকারি আইটেম। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

চান মিঁয়ার ততদিনে হাতযশ বেড়েছে। ১৯১১ সাল তখন। বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছে। পূর্ব বাংলা থেকে অভিজাতদের অনেকে কলকাতামুখী হচ্ছেন। তাই রুটি-বিস্কিটের ক্রেতাও নেই আগের মতো। এ অবস্থায় চান মিঁয়া ঘরে তৈরি রুটি ও বিস্কিট ফেরি করে বিক্রি করতে শুরু করেন। ঢাকার নানান জায়গায় যেতেন তিনি। এর ভেতর বুড়িগঙ্গার পাশে কেরানীগঞ্জ যেমন ছিল, তেমনি ছিল তুরাগ নদীর তীরে টঙ্গী। এভাবে একেকদিন একেক হাটে গিয়ে ফেরি করে বিক্রি করতেন বেকারি পণ্য। এজন্য পুরো ঢাকা ও এর আশপাশটা চষে ফেলেছিলেন তিনি।

দীর্ঘ ৪ দশক এভাবে চলে যায়। ফেরি করে বিক্রি করতে করতে চান মিঁয়ার বেকারি পণ্যের বেশ চাহিদা তৈরি হয়। হাতে বেশকিছু টাকাও আসে। পঞ্চাশের দশকে খ্যাতিমান গায়িকা লায়লা আর্জুমান্দ বানুর বাবার কাছ থেকে বাগানবাড়ি কিনে নিয়ে তিনি তার এক কোণে প্রতিষ্ঠা করেন আনন্দ কনফেকশনারি। চান মিঁয়া নিজেও ছিলেন সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ।

ক্রেতাদের ভালো লাগা তার কাছে প্রাধান্য পেত। ভালো গান যেমন মানুষকে আনন্দ দেয়, তেমনি আনন্দ দিতে পারে ভালো খাবারও। তাই কনফেকশনারির নাম রাখেন আনন্দ।

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু ঘটে চান মিঁয়ার। এরপর তার ছেলে তারা মিয়া দোকানের হাল ধরেন। এরপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ২৫ মার্চের পর দোকান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে তারা মিয়া নতুন করে দোকান শুরু করেন আগের জায়গাতেই।

দোকানের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তাদের সুতি কাবাব, ইলিশ কাবাব, ফ্রুট কেক, টানা পরোটা, লাচ্ছা সেমাই, ডেনিস বিস্কুট, বাকরখানি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৮৭ সালে চকবাজারে ও ১৯৯০ সালে কুর্মিটোলায় শাহীন প্লাজায় নতুন শাখা হয় আনন্দ কনফেকশনারির। সবশেষ শাখাটি ২০১২ তে ওয়ারীতে চালু হয়েছে।

আবুল হাসনাত রোডের মূল শাখার ব্যবসা এখন দেখেন সিদ্দিকুর রহমান। তিনি চান মিঁয়ার নাতি। চান মিঁয়া সব পণ্য হাতে তৈরি করতেন। তখন মেশিনে এসব কাজ হতো না। এখন যুগের হাওয়া মেশিনের অনুকূলে হলেও আনন্দ কনফেকশনারি পুরোপুরি সেদিকে যায়নি।

সিদ্দিকুর রহমান বলেন, 'হাতে খাবার বানানোর আলাদা মজা আছে। আমরা ঢাকায় ৪টার বেশি শাখা খুলিনি। শাখা বাড়ালে তখন পুরোপুরি মেশিনের দিকে যেতে হবে, আমরা সেটা চাই না। আমরা এখানে বংশপরম্পরায় খাবারের মূল স্বাদ ঠিক রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।'

বেকারি আইটেমের বাইরে এতে আছে নানা কনফেকশনারি পণ্যও। ছবি: মাহমুদ নেওয়াজ জয়

তাদের দোকানের পেছনেই খাবার তৈরির কারখানা, এক পাশে রয়েছে অফিস কক্ষ।

সিদ্দিকুর বলেন, 'ঢাকার ৪টি শাখার বাইরে আমাদের আর কোথাও কোনো শাখা নেই। আমাদের কর্মী আছে প্রায় ৫০ জনের মতো। আমার তত্ত্বাবধানে সবাই কাজ করে। আগে বেকিং হতো কয়লার চুল্লিতে। এখন বড় সাইজের গ্যাসের চুল্লি ব্যবহৃত হয়।'

এই চুল্লির বিশেষত্ব হলো, এতে নকশাদার খাবার তৈরি সহজ হয়। শবে বরাতের সময় পুরান ঢাকায় মাছ, কুমির বা কচ্ছপের নকশা কাটা যে বিশেষ রুটি হয়, এই চুল্লি ছাড়া তা সম্ভব নয় বলে জানান সিদ্দিকুর। এর বাইরে শবে বরাতের সময় স্পেশাল বুটের ও সুজির হালুয়া করেন তারা, যা অন্য সময় পাওয়া যায় না।

সিদ্দিকুর আরও জানান, চিকেন প্যাটিস, সমুচা, লাড্ডু, চমচম, চানাচুর নিয়মিত তৈরি হয়। রোজার সময় তাদের সুতি কাবাব ও হালিমের বিশেষ চাহিদা থাকে। ঈদের সময় লাচ্ছা সেমাইয়েরও। টানা পরোটা অর্ডার পেলে বানানো হয়। ইলিশ কাবাবও ৩-৪ আগে অর্ডার দিলে সে অনুযায়ী বানানো হয়।

শত বছর পেরিয়ে গেলেও আনন্দ কনফেকশনারি এখনও ক্রেতাদের ভিড়ে মুখরিত। বেকারি আইটেমের বাইরে এখন চকলেট, মিষ্টিসহ নানা রকম আইটেমের সমাহারে আক্ষরিক অর্থেই কনফেকশনারি হয়ে উঠেছে আনন্দ।

তবে ব্যবসা সম্প্রসারণের চেয়ে খাবারের মানগত উৎকর্ষই সিদ্দিকুরের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, 'আমার ছোট ভাই খুব উদ্যোগী ছিল। তার নাম আব্দুল ওয়াজেদ। ১৯৮৭ ও ১৯৯০ এ আনন্দের দুটো নতুন দোকান (শাখা) হওয়ার পেছনে তার ভূমিকাই ছিল বেশি। ২০০০ সালে সে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় ধাক্কা ছিল। এর অনেকদিন পর ওয়ারীতে নতুন একটা শাখা খুললাম।'

'তবে ব্রাঞ্চ আর বাড়ানোর চিন্তা নেই। এখন পর্যন্ত আমরা আগের স্বাদ যতটা পারা যায় ধরে রেখে খাবার বানিয়ে যাচ্ছি। আমার দাদা চান মিঁয়া এই ব্যবসাকেও মনে করতেন এক রকম ইবাদত। আমরা সেটা মনে রেখে সেভাবে কাজ করতে চাই। দাদা যে প্রক্রিয়ায় খাবার বানাতেন, সেটাই যথাসম্ভব অনুসরণ করি। আমাদের খাবার মানুষের কাছে ভালো লাগলে, তারা আনন্দ পেলে তাতে আমরাও খুশি', যোগ করেন তিনি।

 

Comments