বেক্সিমকো: সুকুক ছাড়ার আগে-পরে ভিন্ন চিত্র, ভোগান্তিতে বিনিয়োগকারীরা

বেক্সিমকো

বেক্সিমকো সুকুকের বিনিয়োগকারীদের জন্য দুঃসংবাদ—আগামী ডিসেম্বরে এই শরিয়াহভিত্তিক বন্ড থেকে মুনাফা নয় শতাংশে নেমে আসবে।

এটি পাঁচ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের ১২ দশমিক তিন শতাংশ ও অক্টোবরের মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশের কম।

মূলত সুকুকের মুনাফার হার নির্ধারক বেক্সিমকো লিমিটেডের আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় এমনটি হতে যাচ্ছে।

২০২০-২১ অর্থবছরের প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি শরিয়াহভিত্তিক বন্ড 'বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক আল ইস্ততিসনা'র মাধ্যমে তিন হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের ঘোষণা দেয়।

ওই বছর বেক্সিমকোর মুনাফা এক হাজার ৪০০ শতাংশ বেড়ে ৬৬০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে মুনাফা আরও বেড়ে এক হাজার ২৫৪ কোটি টাকা হয়।

এরপর শুরু হয় সংকট। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ৩৬ কোটি টাকা লোকসানের কথা জানায়।

বেক্সিমকোর এই আকস্মিক সংকটের কারণে সুকুকের মুনাফার হার কমে যাওয়ায় সুকুকের বিনিয়োগকারী ব্যাংক, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছু বিষয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।

দেশের প্রথম বেসরকারি সুকুক বন্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বেক্সিমকো বেশি করে মুনাফা দেখিয়েছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে তারা মনে করছেন।

২০২০-২১ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ মুনাফার ওপর ভিত্তি করে ৩৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। পরের বছর বেক্সিমকোর শেয়ারহোল্ডারদের ৩০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া হয়।

এ দিকে, বেক্সিমকোর লভ্যাংশের ওপর সুকুকের কুপন হার নির্ভর করে। প্রথম দিকে প্রতিষ্ঠানটি ভালো লভ্যাংশ দেওয়ায় শুরুর দিকে সুকুকের কুপন হারও ছিল সেই সময়ের ট্রেজারি বন্ডের তুলনায় অনেক বেশি।

প্রথম বছর সুকুক কুপনের মুনাফা ছিল প্রায় ১২ শতাংশ। সেসময় ট্রেজারি বন্ডের সুদহার ছিল তিন দশমিক ৯২ শতাংশ। তাই তখন সুকুক খুবই লাভজনক দেখাচ্ছিল।

তা সত্ত্বেও বেক্সিমকো সুকুকের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ছিল না। তা কেনার জন্য একাধিকবার মেয়াদ বাড়ানো হলেও প্রতিষ্ঠানটি তাদের লক্ষ্য অনুযায়ী টাকা তুলতে পারছিল না।

এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন দিয়ে ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য গঠিত এক বিশেষ তহবিলের টাকা থেকে বেসরকারি খাতের এই সুকুক কেনার অনুমতি দেয়।

যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক এই তহবিল গঠন করেছিল পুঁজিবাজারে টাকার প্রবাহ বাড়াতে। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকগুলোকে ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের অনুমতি দেওয়া হয়।

ছয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান তাদের সুকুক বন্ড কিনতে চাপ দিয়েছিলেন।

দুই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সুকুক কিনতে তাদের অন্য শেয়ার বিক্রি করতে হয়েছিল।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সালমান এফ রহমানের স্কিম প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফলে ৭৫০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ৫০ কোটি টাকা পেয়েছে।'

'কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো সুকুক বন্ড কিনতে বাধ্য হয়েছিল। এই সুকুক কিনতে অনেককে অন্য শেয়ার বিক্রি করতে হয়।'

ফলে, বাজারে এর প্রভাব পড়ে।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ডিএসইর প্রধান সূচক প্রথমবারের মতো সাত হাজার ৩৫৬ পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়। তখন ডিএসইর লেনদেন ছিল গড়ে দুই হাজার কোটি টাকা।

এর চার মাসের মধ্যে লেনদেনের পাশাপাশি সূচক কমতে শুরু করে।

ছয় মাসের ব্যবধানে ডিএসইর গড় লেনদেন ৭০০ কোটি টাকায় নেমে আসে। সূচক কমে এক হাজার পয়েন্টের বেশি।

তবে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি ও ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজের পরিচালক সাইফুল ইসলাম এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সুকুকের বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী প্রাতিষ্ঠানিক হওয়ায় তাদের সুকুকে বিনিয়োগ বাজারে প্রভাব ফেলেনি।'

তার দাবি, প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজার থেকে সুকুকে টাকা স্থানান্তর করেনি।

গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক আল ইস্ততিসনা ও আইএফআইসির গ্যারান্টিযুক্ত শ্রীপুর টাউনশিপ গ্রিন জিরো কুপন বন্ড ইস্যুতে অনিয়ম তদন্তে কমিটি করে।

যেভাবে কমবে বেক্সিমকোর সুকুকের কুপন রেট

প্রতি বছর সুকুকের অভিহিত দামের বিপরীতে নয় শতাংশ বেস রেট নিশ্চিতভাবে পাওয়ার কথা আছে বিনিয়োগকারীদের। সুকুক প্রসপেক্টাস অনুসারে, ওই বছরের জন্য বেক্সিমকোর নগদ লভ্যাংশ নয় শতাংশের বেশি অতিরিক্ত লভ্যাংশের ১০ শতাংশ সুকুকের বেসর রেটের সঙ্গে যুক্ত হবে।

এ বছর বেক্সিমকো নগদ লভ্যাংশ দিচ্ছে না। তাই আগামী ডিসেম্বরে পরবর্তী পেমেন্টে সুকুক বিনিয়োগকারীরা সর্বনিম্ন নয় শতাংশ হারে লভ্যাংশ পাবেন।

সুকুকে বেশ কয়েকটি ব্যাংক বিনিয়োগ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় অনেকে সময়মতো প্রথম কুপন পেমেন্ট পায়নি।

যেমন, রূপালী ব্যাংক সুকুকে বিনিয়োগ করেছে ২০০ কোটি টাকা। বেক্সিমকো তা পরিশোধে দেরি করেছে বলে ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন ব্যাংকটির এক শীর্ষ কর্মকর্তা।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আগামীতে বাকি টাকা পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ব্যাংকটি।

সুকুক বিনিয়োগকারীদের ওপর ফ্লোর প্রাইসের বাধা

সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, 'বেক্সিমকোর শেয়ারের ওপর ফ্লোর প্রাইস দেওয়ায় সুকুক বিনিয়োগকারীরা তাদের টাকা শেয়ারেও রূপান্তর করতে পারছেন না। এর দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে রাখা হয়েছে।'

সুকুক বিনিয়োগকারীরা প্রতি বছর তাদের টাকার ২০ শতাংশ বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারে রূপান্তর করতে পারেন। প্রতিষ্ঠানটির ২০ দিনের গড় লেনদেনের টাকা বিবেচনায় নিয়ে সুকুক ক্রেতারা ২৫ শতাংশ ছাড়ে শেয়ার নিতে পারবেন।

তবে কয়েক মাস ধরে এই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম ১১৫ টাকার নিচে আটকে আছে।

সাইফুল ইসলামের ভাষ্য, 'ফ্লোর প্রাইস তুলে নিলে এর দাম কমতে পারে। ফ্লোর প্রাইস বহাল রাখার বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্তের কারণে সুকুক বিনিয়োগকারীরা শেয়ার রূপান্তর করেও মুক্তি পাবেন না।'

যত দ্রুত সম্ভব ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি।

একইভাবে ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার পক্ষে মত দেন। তার মতে, এতে সুকুক বিনিয়োগকারীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

তিনি বলেন, 'যারা বন্ডকে শেয়ারে রূপান্তর করে এখান থেকে বের হতে চেয়েছিলেন ফ্লোর প্রাইসের কারণে তাদের শেয়ার বিক্রির বিকল্প নেই।'

বেক্সিমকো লিমিটেডের ফ্লোর প্রাইস সচল রাখার সিদ্ধান্তকে 'বাজে' আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, 'শরীরের কোনো অংশে পচন ঘটলে তা কেটে ফেলতে হবে। আর কোনো উপায় নেই। তা না হলে পুরো শরীর পচে যাবে।'

'ফ্লোর প্রাইস বাড়ালে সূচকে প্রভাব পড়তে পারে। এটি তুলে নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই' বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

শেয়ার ধরে রাখা বিনিয়োগকারীদের পোর্টফোলিওকে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেখানো হয়, তাদেরকে অনেক টাকা ঋণ দেওয়ার অনুমতি আছে। অন্যদিকে সুকুক বিনিয়োগকারীরা এখন শেয়ার রূপান্তর করলে লোকসানে পড়বেন।

তার প্রশ্ন, 'এই ক্ষতির দায় কে নেবে?'

বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বেক্সিমকোর কাছ থেকে ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়নি। কোনো সুকুকধারী বিএসইসির কাছে আবেদন করলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা তা বিবেচনা করবে।'

বেক্সিমকোর বক্তব্য

বেক্সিমকো লিমিটেডের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আসাদ উল্লাহ মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বেক্সিমকো লিমিটেডের সর্বশেষ আর্থিক বিবরণীতে বলা হয়েছে, দেশে-বিদেশে পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়া, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট ও গ্যাস-বিদ্যুতের খরচ বেড়ে যাওয়ার মতো সংকটের কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে পড়েছে।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh trade deficit July-August FY25

Trade deficit narrows 2.6% in July-April

The country’s trade deficit narrowed by 2.60 percent in the first ten months of the current fiscal year compared to the same period a year ago, thanks to a rise in export earnings coupled with subdued imports..During the July-April period of fiscal year (FY) 2024-25, the trade gap was $18.

3h ago