ভাষা গবেষণার বাইরে সবই করে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট

'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এক যুগেরও বেশি সময় আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে কেবল বাংলা ভাষা নয়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন দেশের ভাষা নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করার কথা। কিন্তু তারা বিভিন্ন দিবস পালন, সেমিনার, পদক প্রদান, প্রশিক্ষণ, স্মরণিকা ও নিউজলেটারের মতো রুটিন কাজ করছে। গবেষণার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ দেখা যাচ্ছে না। ভারতের দিল্লির একটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ভাষা নিয়ে ভালো কাজ করছে, তারা পারলে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট কেন পারছে না'।

গত বছর বাংলা ট্রিবিউনের কাছে এমন হতাশা প্রকাশ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান। এই মন্তব্য করা অধ্যাপক বর্তমানে ইনস্টিটিউটটির পরিচালক।

২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও কার্যত ১০ বছর প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল প্রতিষ্ঠানটি। ২০১০ সালে নতুন করে কার্যক্রম শুরু হলেও গত ১৪ বছরে বড় কলেবরে কোন পূর্ণাঙ্গ গবেষণা শেষ করতে পারেনি তারা। ভাষা বিষয়ে বিভিন্ন আয়োজন, দিবস পালন, সেমিনার ইত্যাদির জন্যই যেন প্রতি বছর বরাদ্দ দেয়া কোটি কোটি টাকা খরচ করছে তারা। ভাষা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটি তৈরি হলেও ২০২৩ সালে গবেষণাও ১ টাকাও খরচ করেনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট।

আন্তর্জাতিক ভাষা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর যেসব ভাষা রয়েছে, সেগুলো নিয়ে উঁচু মানের গবেষণা করার কথা ছিল প্রতিষ্ঠানটির। বাংলাদেশে কতগুলো ভাষা রয়েছে, প্রতিটি ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা কেমন- এই বিষয়গুলো নিয়ে ২০১৪ সালে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সমীক্ষার কাজ শুরু হয়। এই সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ১০ খণ্ডের একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ হবার কথা। প্রায় দশ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকাশ হয়েছে মাত্র ১ খণ্ড, অথচ সমীক্ষাটি ২০১৬ সালেই শেষ হয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষার ইতিহাস, উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে তথ্য সম্বলিত 'মাতৃভাষা পিডিয়া' ১০ খণ্ডে প্রকাশিত হবার কথা ছিল ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে। ২৩ পেরিয়ে ২৪ সালের শেষে এসেও ১ খণ্ডও প্রকাশ করতে পারেনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট।

শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি ভিন্ন ৬টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় ভাষান্তর করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। অথচ বাংলাদেশের ৪১টি ভাষার মধ্যে ১৪টি ভাষা বিপন্ন অবস্থায় আছে, সেগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না গেলে চিরতরে মুছে যেতে পারে বাংলাদেশের ১৪টি ভাষা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটট দেশের ৪১টি ভাষার মাত্র ৩টি ভাষা নিয়ে কাজ করতে পেরেছে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট যে গবেষণার কাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই লক্ষ্য থেকে অনেকটাই দূরে আছে কিনা -এমন প্রশ্ন জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান মহাপরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, 'গত বছরগুলোতে প্রতিষ্ঠানটি সভা-সেমিনারের রুটিন কাজেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর আভ্যন্তরীণ বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও দেখতে পাচ্ছি। যেমন, এখানে জনবলের ঘাটতি আছে। অনেকগুলো পদ ফাঁকা পরে আছে, সেসব পদে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। এছাড়াও গবেষণার কাজে ব্যয় করতে প্রতিষ্ঠানটির বাৎসরিক যেই বরাদ্দ রয়েছে, সেটিকেও আরও বাড়ানো যায় কিনা এসব বিষয়ে আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব রাখব'।

প্রতিষ্ঠানটি এত বছরেও অনুমোদিত সবগুলো পদে নিয়োগ সম্পন্ন করতে পারেনি তারা। ভাষা নিয়ে কাজ করা তরুণ গবেষকদেরকে নিয়োগ না দিয়ে কেন এত বছর ধরে পদগুলো খালি রাখা হয়েছে, এর সদুত্তর দিতে পারেনি কেউই। পাল্টাপাল্টি দোষারোপের ভেতর আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকেই দায়ী করছেন তারা। তবে ভাষা বিষয়ে গবেষণার জন্য আগ্রহী ও যোগ্য জনবল নিয়োগের ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। কারণ যেসব মানুষ নিয়োগপ্রাপ্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছেন, তারা বেশিরভাগই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বদলি হয়ে এখানে এসেছেন। তারা কেউই ভাষা বিষয়ক কাজে অভিজ্ঞ নন। এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানে বদলি হবার আগে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে 'ট্রাঞ্জিশনাল পিরিয়ড' পার করেন তারা। দিনের পর দিন এই প্রক্রিয়ার কারণে আদতে নিজের লক্ষ্য থেকে বহুদূর সরে গেছে প্রতিষ্ঠানটি।

৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেই তারুণ্যের অংশগ্রহণের ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে। শুধুমাত্র জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নয়; বরং মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে যে কোন বয়সী মানুষকে নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে দেশে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে সাংবাদিকরা খালি পদে তরুণ গবেষক ও ভাষা বিষয়ে আগ্রহী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা আছে কিনা এমন প্রশ্ন করেন।

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক জানান, 'মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ইতিমধ্যে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে, আমরাও খালি পদগুলোতে নিয়োগের বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করেছি। এছাড়াও গবেষণার জন্য আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে বৃত্তি ও ফেলোশিপ দেয়া হয়। তরুণ গবেষকরাও যেন অংশ নিতে পারেন সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করব'।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও জানান, 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যেই বেশ কিছু কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। এবছর সারাদেশে লিঙ্গুইস্টিক অলিম্পিয়াড আয়োজন হবে। ৫টি বিভাগের ৭টি অঞ্চলের ৮টি ভেন্যুতে প্রতিযোগিতা হবে। ফাইনাল রাউন্ডে ২ ক্যাটাগরিতে ৩ জন করে মোট ৬ জন মাননীয় উপদেষ্টার নিকট হতে পুরস্কার গ্রহণ করবেন। এই ৬ জন আগামী বছরে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক লিঙ্গুইস্টিক অলিম্পিয়াডের জন্য বিবেচিত হবেন'। তিনি আশা প্রকাশ করেন, 'এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাংলাসহ অন্যান্য মাতৃভাষা চর্চার প্রতি নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে'।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladeshi Migrant Workers Deaths Over The Years

In coffins, from faraway lands

Kazi Salauddin, a 44-year-old man from Cumilla, migrated to Saudi Arabia in October 2022, hoping to secure a bright future for his family. But barely a year later, Salauddin, the father of two daughters and a son, died suddenly.

9h ago