বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষে ঢাকার আশপাশে যেসব জায়গায় ঘুরতে যেতে পারেন

জল কাচারি রিসোর্ট
জল কাচারি রিসোর্ট। ছবি: ইউএনবি থেকে নেওয়া

শুরু হয়ে গেছে উৎসবের মৌসুম। একইসঙ্গে বড়দিন, বছরান্ত, ইংরেজি নববর্ষ ও শীতকাল। ফানুশ ওড়ানো ও ঘন কুয়াশায় মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হওয়ার অভিজ্ঞতাকে প্রাণভরে উপভোগ করতে ভ্রমণপ্রিয় মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে হিড়িক পড়ে যায় মুখরোচক ভোজের মধ্য দিয়ে পরিবার বা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বড়দিন ও নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর। আর এই উদযাপন যদি করা যায় নির্মল প্রকৃতির সান্নিধ্যে, তাহলে আনন্দটা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। ঢাকার সন্নিকটে তেমনি কিছু দর্শনীয় স্থান ও রিসোর্ট নিয়েই আজকের ভ্রমণকড়চা। চলুন, ঢাকার কাছেই বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের দারুণ কয়েকটি জায়গার ব্যাপারে জেনে নেওয়া যাক।

বড়দিন ও নতুন বছরের ছুটিতে ঢাকার কাছেই কিছু অবকাশ যাপনের স্থান

জল কাচারি রিসোর্ট

কেরানীগঞ্জ উপজেলার হযরতপুরের এই রিসোর্টের মূল আকর্ষণ হলো ধলেশ্বরী নদীর মনভোলানো দৃশ্য। লাল-সাদা টিনকাঠের প্রানেশ্বরী কটেজ ও দৃষ্টিনন্দন দুটি সানরুম থেকে দৃষ্টিজুড়ে ধারণ করা যায় নদীকে। আর গাঙচিল প্ল্যাটফর্মটি তো একদম নদীর ওপরেই ভাসমান। এখানে বসে মাটির চুলায় রান্না করা দেশীয় খাবার খাওয়ার সময় চোখে পড়ে ওপাড়ের নির্মল সবুজ প্রকৃতি। চাইলে নৌকায় ভেসে আরও কাছ থেকে উপভোগ করা যায় নদীর অনিন্দ্য সৌন্দর্যকে।

মোহাম্মদপুর থেকে কলাতিয়া রোড ধরে ঢালিকান্দির দিকে এই রিসোর্টটিতে পৌঁছাতে সময় লাগবে এক ঘণ্টা।

কটেজ হাউস

সাভারের এই সুদৃশ্য অতিথিশালাটি মূলত প্রায় দুই বিঘা জমির একটি অত্যাধুনিক ভিলা। রাজধানী থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বের এই অবকাশ যাপনকেন্দ্রে রয়েছে এক হাজার ৩০০ বর্গফুটের সুইমিং পুল। থাকার জন্য রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দুটি প্রশস্ত রুম। আছে বারবিকিউ, উন্মুক্ত ডাইনিং ও ব্যাডমিন্টন খেলার সুবিধা। সবুজ লন, বাগান ও এর মাঝে দোলনা আভিজাত্যের পাশাপাশি দিয়েছে শৈল্পিক পরশ।

সাভারের বাজার রোডে উঠে সামনে এগোলে বাড্ডা ভাটপাড়া রোডের ৯৩ বি প্লটটিই কটেজ হাউস।

কটেজ হাউস
কটেজ হাউস। ছবি: ইউএনবি থেকে নেওয়া

মাওয়া

ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে হওয়ার পর থেকে বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে পুরো মাওয়া অঞ্চলটি। সহজে যাতায়াতযোগ্য হওয়ায় পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে মাওয়া ফেরিঘাট ও পদ্মা সেতুর আশেপাশের জায়গাগুলোতে। পদ্মায় নৌকা ভ্রমণ এবং ইলিশ ভোজন এখন আর সময়সাপেক্ষ ব্যাপার নয়। দিনে গিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই আবার ফিরে আসা যায় ঢাকায়। যারা প্রমত্তা নদীতে সূর্যাস্ত উপভোগ করতে চান, তারাও বেশি রাত হওয়ার আগেই ফিরতে পারেন।

বিগত কয়েক বছরে পর্যটকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে অবস্থিত 'প্রজেক্ট হিলশা'। অবিকল ইলিশ মাছের আদলে নির্মিত স্থাপনাটি আসলে একটি অভিজাত রেস্তোরাঁ। এখানে দেশি-বিদেশি খাবারের পাশাপাশি রয়েছে শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের রাইডের ব্যবস্থা।

শীলবাড়ির হেঁশেল

মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার নন্দনকোনা গ্রামের এই জায়গাটি নামের মতোই নান্দনিক। ১০৫ কাঠা জমির ওপর উঠোনসহ বাড়িকে গাছগাছালির আবরণে দেওয়া হয়েছে গ্রামীণ আবহ। এখানে একে একে চোখে পড়ে বৈঠকখানা, ছোট্ট পুকুরের পাড়ে বিক্রমপুরের স্থাপত্যশৈলীতে বানানো কাঠের ঘর।

এখানে খাবার পরিবেশন করা হয় কাঁসার থালার ওপর কলাপাতা বিছিয়ে। প্রতিটি খাবার ও তার উপকরণ স্থানীয়ভাবে চাষ করা এবং গ্রামের নারীরা তা মাটির চুলায় রান্না করেন।

এখানে সকাল সাড়ে ৯টায় প্রবেশ করে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানো যায়। রাতে থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। ঘুরতে যেতে হলে ন্যূনতম ১০ জনের দল নিয়ে অগ্রিম বুকিং দিতে হয়।

মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত যাওয়ার পর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে বেরিয়ে যেতে হবে বাম পাশের সড়কে। তারপর নিমতলা বাজারের পর বাঁয়ে বীরতারার রাস্তায় উঠে আরও সামনে এগিয়ে পড়বে নন্দনকোনা বাজারের পথ। এই পথ ধরে গেলেই পাওয়া যাবে শীলবাড়ির হেঁশেল।

শীতলক্ষ্যায় নৌকা ভ্রমণ

ঢাকার উপকণ্ঠে নৌকা ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে পূর্বাচল সেক্টর-৪ এর শিমুলিয়া ট্যুরিস্ট ঘাট ও ব্রাহ্মণখালী ঘাট। নৌকাসহ বিভিন্ন ইয়ট, ট্রলার, লঞ্চ ও ক্রুজগুলো শীতলক্ষ্যায় নৌকা ভ্রমণের জন্য এখান থেকেই যাত্রা শুরু করে।

এসব নৌযানে ঘণ্টাপ্রতি ভাড়ায় নদী ভ্রমণ করা যায়। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার নোয়াপাড়া বিসিক জামদানি পল্লি এবং মুড়াপাড়ার জমিদারবাড়িও ঘুরে দেখা যায়।

কাঞ্চন মেরিনা অ্যান্ড অস্ট্রিচ হারবারে গেলে দেখা মিলবে দেশের প্রাচীনতম প্যাডেল স্টিমার পিএস অস্ট্রিচ।

মাটির মায়া ইকো রিসোর্ট

গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত এই রিসোর্টটি পরিবেশ-বান্ধব স্থাপনার এক শৈল্পিক দৃষ্টান্ত। নামের মতোই এর সর্বত্রে রয়েছে মাটির ঘরের সয়লাব। মাটির সঙ্গে কটেজগুলোর উপকরণে সংযোজন করা হয়েছে কাঁচ ও বাঁশ। ঘরগুলোকে ঘিরে রয়েছে ঘন বাঁশঝাড়।

অতিথিদের খাবার ও তার রন্ধনপ্রণালীতে দেশীয় ঐতিহ্যেরই আধিক্য বেশি। এখানে ফুটবল, ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। বিনোদনের জন্য আরও রয়েছে বনফায়ার নাইটস, লাইভ মিউজিকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা।

গাজীপুরের মাওনা পর্যন্ত গিয়ে শিশু পল্লী সড়কে উঠে বামে মোড় নিয়ে সাইতালিয়ার পথেই পড়বে এই ইকো রিসোর্টটি।

মাটির মায়া ইকো রিসোর্ট
মাটির মায়া ইকো রিসোর্ট। ছবি: ইউএনবি থেকে নেওয়া

সরল বাড়ি রিসোর্ট

জনপ্রিয় শিল্পী আনুশেহ আনাদিলের এই দৃষ্টি নন্দন রিসোর্টটির অবস্থান গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে। রাত্রি যাপনের জন্য এখানে আছে দুটি দোতলা বাড়ি, যেগুলোর নিচে বৈঠকখানা আর দোতলায় বেডরুম। এগুলোতে সব মিলিয়ে চার থেকে ছয়জন থাকতে পারে। বাড়ি দুটোর আঙ্গিনা ঘিরে বিস্তৃত সবুজ খোলা প্রান্তর। সেখানে নির্দিষ্ট দূরত্বে পর্যাপ্ত জায়গা নিয়ে রয়েছে বসার ছাউনি, বাঁশ ও কাঠে বাধানো ঘাটসহ পুকুর, কয়েকটা দোলনা ও টিনের চালার খাবার ঘর। স্থানীয় খেত-খামারে চাষকৃত শাক-সবজি ও পালনকৃত হাঁস-মুরগি রান্না করেই সাজানো হয় খাবারের মেনু।

এই রিসোর্টে যেতে হলে রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্ট হয়ে ফাউগান-ধলাদিয়া সড়ক ধরে এগোতে হবে।

মেঘনা ভিলেজ হলিডে রিসোর্ট

মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার এই অবকাশ যাপন কেন্দ্রটিকে শুধু রিসোর্ট বললে ভুল হবে। কেননা প্রায় ৩০ বিঘা এলাকার ওপর গড়ে তোলা এই দর্শনীয় স্থানটিতে কুটির ছাড়াও রয়েছে একটি থিম পার্ক। এই পার্কে রয়েছে পেন্ডুলাম পাইরেট শিপ, মেরিগো রাউন্ড ও প্যাডেল বোটের মতো নানা ধরনের রাইড, একটি মিনি চিড়িয়াখানা এবং একটি থ্রিডি সিনেপ্লেক্স। বসবাসের কুটিরগুলো নেপালি ঢঙে তৈরি।

দেশি-বিদেশি খাবারের রেস্তোরাঁ, বার বি কিউ, সুভ্যেনির শপ, মাছ ধরা, নিজস্ব পরিবহন ও খেলাধুলার জন্য আছে বিশাল দুটি খেলার মাঠ।

রিসোর্টের প্রবেশ মূল্য প্রাপ্ত বয়স্কদের জনপ্রতি ৫০ টাকা এবং শিশু-কিশোরদের জন্য ২০ টাকা।

যাত্রাবাড়ী থেকে মেঘনা ব্রিজ পেরিয়ে বালুকান্দি বাসস্ট্যান্ড থেকে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে বেশ ভেতরে গেলে পাওয়া যাবে এই রিসোর্টটি।

সিগাল রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট

প্রাকৃতিক শোভার পাশাপাশি আভিজাত্যের ছোঁয়া পেতে হলে যেতে হবে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার সিঙ্গারদিঘি গ্রামে। কেননা এখানকার প্রায় ৪২ বিঘা জায়গার ওপর নির্মিত সিগাল রিসোর্টটি কেবল সবুজায়নেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সেই সঙ্গে ব্যবস্থা রেখেছে মিনি চিড়িয়াখানা, কিডস জোন, কনফারেন্স রুম, লেক, খেলার মাঠ ও রেস্টুরেন্ট। গাছপালার মধ্যে রয়েছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রজাতির বনজ, ওষুধি ও ফলজ গাছ।

সিগালে যাওয়ার জন্য ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মাওনা চৌরাস্তা থেকে প্রথমে মাওনা-দুলিভিটা সড়ক ধরে এগোতে হবে। অতঃপর সিংদিঘি কারওয়ান বাজার পর্যন্ত যেয়ে ডানে মোড় নিয়ে বেশ ভেতরে গেলে পৌঁছা যাবে এই রিসোর্টে।

বিশনন্দী ঘাট

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় অবস্থিত এই বালুময় ঘাট রীতিমতো সমুদ্রসৈকতের স্বাদ দেয়। তাই মেঘনা নদীর এই পাড়টি পরিচিতি পেয়েছে মিনি কক্সবাজার হিসেবে। ঘাট থেকে নিচে নেমে নদীর ধার ধরে হেঁটে গেলে দেখা মেলে অনেক জলচর পাখির। অদূরে দেখা যায় দেখা যায় পালতোলা নৌকা ও সেগুলোর মাছ ধরার দৃশ্য। বেলা পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে রক্তিম গোধূলি। পারাপারের জন্য নিয়মিত ফেরি তো আছেই; সেই সঙ্গে নৌকা বা স্পিডবোট ভাড়া নিয়েও নদী ভ্রমণ করা যায়।

ঢাকার কুড়িল বিশ্বরোড থেকে সরাসরি মাধব্দী অথবা ভুলতা গাউছিয়া হয়ে বিশনন্দী ফে‌রিঘাট পর্যন্ত যাওয়া যায়।

সাবদি গ্রাম

শীতের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হলুদ সরিষা ফুলে ভরে ওঠে নারায়ণগঞ্জের সাবদি গ্রাম। ফুলের গ্রাম হিসেবে ব্যাপক পরিচিত রয়েছে এই গ্রামের। দিগন্ত বিস্তৃত ফুলের রাজ্যে সূর্যাস্তের দৃশ্য নিঃসন্দেহে এক বিমোহিত অভিজ্ঞতা।

এমন নৈসর্গিক দৃশ্যের জন্য গ্রামটির বেশ কিছু জায়গা পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সেগুলো হলো—প্রেমতলা, লক্ষ্মণবন্দে নদীর পাড়, সিরাজ শাহের মাজার কমপ্লেক্স, কদম রসুল দরগা ও সোনাকান্দা দুর্গ।

এই গ্রামে যেতে হলে গুলিস্তান থেকে কাঁচপুর ব্রিজের পর মদনপুর থেকে ডানে সোজা চলে যেতে হবে নারায়ণগঞ্জের বন্দর। এই পথ ধরে অনেকটা এগিয়ে বামে পড়বে সাবদি যাওয়ার রাস্তা।

পরিশিষ্ট

ঢাকা সংলগ্ন এই দর্শনীয় স্থানগুলোর যেকোনোটিই হতে পারে বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষের ছুটি কাটানোর সেরা গন্তব্য। মাওয়া, শীতলক্ষ্যা, বিশনন্দী ঘাট ও সাবদি গ্রাম অবিস্মরণীয় কিছু অভিজ্ঞতা দেবে, যেগুলো যান্ত্রিক শহরে সচরাচর মেলে না। শীলবাড়ির হেঁশেল, মেঘনা ভিলেজ ও সিগালের সঙ্গে ছুটিটা হয়ে উঠতে পারে ব্যতিক্রম ও রোমাঞ্চকর। যারা তাড়াহুড়ো না নিয়ে আরামপ্রদ ডে ট্রিপের কথা ভাবছেন, তাদের জন্য রয়েছে কটেজ হাউস, জল কাচারি, মাটির মায়া ও সরল বাড়ির মতো রিসোর্টগুলো।

Comments

The Daily Star  | English

PSC announces major changes to ease BCS recruitment process

The PSC chairman says they want to complete the entire process — from prelims to recruitment — in 12 months

2h ago