কোন রোগে ভুগছিলেন ওস্তাদ জাকির হোসেন, কেন হয়, কাদের হয়

ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিস
ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফুসফুসের এক রোগে মারা যান কিংবদন্তি তবলাবাদক জাকির হোসেন। মৃত্যুর ১৫ দিন আগে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে উঠলে এই ৭৩ বছর বয়সীকে পরে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের এই পুরোধা।

ফুসফুসের যে রোগে তিনি ভুগছিলেন, তার নাম ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিস। নিরাময়যোগ্য নয়—এমন একটি রোগ ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিস। ইডিওপ্যাথিক মানেই অজানা, আর রোগটি সম্পর্কেও অনেকেই খুব বেশি কিছু জানেন না। নীরবে বাড়তে পারে আইপিএফ যার ফলশ্রুতিতে মৃত্যু।

ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিস সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান।

ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিস কী

অধ্যাপক আতিকুর রহমান বলেন, ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিস (আইপিএফ) ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী একটি রোগ। ফুসফুসের স্বাভাবিক কাজ অক্সিজেন আদান-প্রদান করা। শ্বাস নেওয়ার সময় ফুসফুস প্রসারিত হয় কারণ ফুসফুসের টিস্যু বা তন্তগুলো সাধারণত নরম, স্থিতিস্থাপক থাকে। ইডিপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিস হলে ফুসফুসের টিস্যুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেগুলো শক্ত হয়ে যায়, বিভিন্ন দাগ পড়ে। আইপিএফের কারণে রক্তে অক্সিজেন আদান-প্রদানে ফুসফুসের সক্ষমতা কমে যায় এবং শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।

কেন হয়

ইডিওপ্যাথিক শব্দটির অর্থই হলো এর কারণ জানা যায় না। তবে কিছু কিছু সম্ভাব্য কারণ হতে পারে আইপিএফ রোগটি হওয়ার ক্ষেত্রে। যেমন:

১. ধুলাবালি, ধোঁয়া, বিষাক্ত রাসায়নিক সংস্পর্শে বারবার আসার কারণে হতে পারে।

২. অতিরিক্ত ধূমপান।

৩. ক্রমাগত ভাইরাল সংক্রমণ থেকে হতে পারে।

৪. জেনেটিক বা জিনগত প্রবণতা, পারিবারিক আইপিএফের ইতিহাস থাকলে।

৫. মাইক্রো অ্যাসপিরেশনের কারণে হতে পারে। মাইক্রো অ্যাসপিরেশনে খাদ্যনালী থেকে অল্প পরিমাণ অ্যাসিড বা খাদ্য ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং ফুসফুসের ক্ষতি করতে থাকে আস্তে আস্তে। ফুসফুসের যে তন্তুগুলো নরম থাকে সেগুলো শক্ত হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিস তৈরি করতে পারে।

আইপিএফ ঝুঁকিতে কারা

অধ্যাপক আতিকুর রহমান বলেন, বয়স্ক ব্যক্তিদের ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি, ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়স যাদের। নারীদের তুলনায় পুরুষদের আইপিএফ বেশি হয়, ধূমপায়ীদের ঝুঁকি বেশি থাকে। এ ছাড়া পারিবারিক ইতিহাস ও ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী কোনো রোগ, অ্যাজমা, সিওপিডি, নিউমোনিয়ায় বারবার আক্রান্ত হয় এমন ব্যক্তিদের আইপিএফ হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

লক্ষণ

১. দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্ট যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বাড়তে থাকে, কমানো যায় না।

২. হাঁটাচলা-কাজ করার সময় দ্রুত হাঁপিয়ে যাওয়া।

৩. সবসময় শুকনো কাশি থাকা।

৪. ক্লান্তি ও দুর্বলতা।

৫. ওজন কমে যাওয়া।

৬. ক্লাবিং হয়, অর্থাৎ হাতের নখের আকৃতি মোটা হয়ে যায়, বেঁকে যায়।

ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিস হলে শ্বাসকষ্ট হয়, কারণ অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। অক্সিজেনের অভাবে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে না। ফুসফুস সম্পূর্ণভাবে অক্সিজেন সরবরাহ করতে না পারার কারণে ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে পড়ে। ফুসফুসের অক্ষমতার কারণে ফুসফুসে রক্তচাপ বাড়ে, যেটাকে পালমোনারি হাইপারটেনশন বলে। এই পালমোনারি হাইপারটেনশনের কারণে হার্ট বা হৃদযন্ত্রের ওপর চাপ পড়ে। অক্সিজেনের স্বল্পতায় শ্বাসকষ্টের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়।

চিকিৎসা

অধ্যাপক আতিকুর রহমান বলেন, ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিস কেন হয় তার সুনির্দিষ্ট কারণ জানা নেই। আইপিএফ সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়। রোগ দ্রুতগতিতে খারাপ হতে থাকে। রোগের অগ্রগতি ধীর করতে কিছু চিকিৎসা দেওয়া হয় আইপিএফ রোগীদের।

ফুসফুসের ফাইব্রোসিস বা শক্ত হয়ে যাওয়া বন্ধ করা যায় না। তবে অগ্রগতি কমানোর জন্য  পিরফেনিডোন (Pirfenidone) ও নিনটেডানিব (Nintedanib) নামক অ্যান্টি-ফাইব্রোটিক ওষুধ দেওয়া যেতে পারে রোগীকে। অক্সিজেনের স্বল্পতায় অক্সিজেন থেরাপি দেওয়া হয় শ্বাসকষ্ট কমানোর জন্য। কিছু ক্ষেত্রে পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন অর্থাৎ শারীরিক ও শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামও করানো যেতে পারে রোগীকে তার পরিস্থিতি অনুযায়ী যতটা সে সহ্য করতে পারে।

ফুসফুসের জটিল অবস্থায় রোগীর প্রয়োজন ও পরিস্থিতি অনুযায়ী আইপিএফের চিকিৎসায় ফুসফুস প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে।

অন্যান্য সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে ফুসফুস সংক্রমণ রোধে টিকা দিতে হবে। আইপিএফ আক্রান্ত রোগীকে ইনফ্লুয়েঞ্জা-নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন দিলে ইনফ্লুয়েঞ্জা-নিউমোনিয়া কম হবে এবং এতে আইপিএফ রোগীর কষ্ট কিছুটা হলেও কম হবে।

আইপিএফ নিরাময়যোগ্য রোগ নয়। সেই কারণে রোগীকে আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে। ফুসফুসে কার্যকারিতা পরীক্ষায় ফলোআপে থাকতে হবে রোগীকে। আইপিএফ আক্রান্ত রোগীদের আয়ুষ্কাল খুবই কম, কিছু গবেষণায় দেখা গেছে আক্রান্ত রোগী তিন থেকে চার বছর কিংবা আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর বেঁচে থাকে। আইপিএফ খুব দ্রুতগতিতে বাড়ে এবং কষ্টদায়ক রোগ, তাই রোগ দ্রুত শনাক্ত করে চিকিৎসা শুরু করা গেলে কষ্ট কমানো সম্ভব।

প্রতিরোধ

অধ্যাপক আতিকুর রহমান বলেন, ইডিওপ্যাথিক পালমোনারি ফাইব্রোসিস সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব না। তবে এর ঝুঁকি কমানো সম্ভব। প্রতিরোধ হিসেবে ধূমপান বন্ধ করতে হবে, ধুলাবালি, ধোঁয়া, রাসায়নিক উপাদানের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা, ঘরের বাইরে গেলে মাস্ক ব্যবহার করা, ফুসফুসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন নিতে হবে, ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।

একইসঙ্গে পরিবারে আইপিএফের ইতিহাস থাকলে আগে থেকেই সতর্ক হতে হবে। শ্বাসকষ্ট, শুকনো কাশি দীর্ঘস্থায়ী হলে এবং ফুসফুসের কার্যকারিতা পরীক্ষায় চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।

Comments

The Daily Star  | English
Kudos for consensus in some vital areas

Kudos for consensus in some vital areas

If our political culture is to change, the functioning of our political parties must change dramatically.

4h ago