হার্ট অ্যাটাক কেন হয়, লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

হার্ট অ্যাটাক
ছবি: সংগৃহীত

নানা কারণেই হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক এর চিকিৎসা করাতে না পারলে তৈরি হয় ঝুঁকি। ফলে এর জন্য সচেতন থাকা অত্যাবশ্যক।

হার্ট অ্যাটাক সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও উপপরিচালক ডা. কাজল কুমার কর্মকার

হার্ট অ্যাটাক কী, কেন হয়

ডা. কাজল কর্মকার বলেন, হার্ট বা হৃদযন্ত্র রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় পাম্প হিসেবে কাজ করে সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ করে মাসক্যুলার অর্গান বা পেশিবহুল অঙ্গ সচল রাখে।

হার্টের চারটি প্রকোষ্ঠ রয়েছে। সারা শরীর থেকে ডিঅক্সিজেনযুক্ত রক্ত প্রথমে হৃৎপিণ্ডের রাইট অ্যাট্রিয়াম বা ডান অলিন্দে প্রবাহিত হয়, সেখান থেকে রাইট ভেন্ট্রিকল বা ডান নিলয়ে যায়। এরপর পালমোনারি ধমনির মাধ্যমে ফুসফুসে পাঠানো হয় অক্সিজেনের জন্য। এরপর অক্সিজেনযুক্ত রক্ত হার্টে ফিরে আসে লেফট অ্যাট্রিয়াম বা বাম অলিন্দে প্রবেশ করে লেফট ভেন্ট্রিকল বা বাম নিলয়ে যায়। এরপর রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় পাম্প হিসেবে কাজ করে সারা শরীরে রক্ত সরবরাহের মাধ্যমে শরীর সচল রাখে।

হার্ট নিজেও একটি মাসক্যুলার অর্গান। হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য হার্ট অক্সিজেনযুক্ত রক্ত নেয় করোনারি ধমনির মাধ্যমে। করোনারি আর্টারি তিনটি—লেফট করোনারি আর্টারি, রাইট করোনারি আর্টারি ও লেফট অ্যান্টেরিয়র ডিজেন্ডিং আর্টারি।

এই তিনটি আর্টারি বা ধমনির মধ্যে কোনো কারণে যদি কিছু অংশ বা পুরোপুরি ব্লক হয়, তাহলে হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। পার্সিয়াল বা অংশত ব্লক হলে তাকে অ্যানজাইনা পেকটোরিস বলা হয়। আর সম্পূর্ণ ব্লক হলে তাকে বলা হয় হার্ট অ্যাটাক।

হার্ট অ্যাটাক কাদের হয়

১. বংশগত বা জেনেটিক কারণে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। কারো বাবা-মা কিংবা কাছের স্বজনদের হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকলে তাদের ঝুঁকি বেশি।

২. অতিরিক্ত অ্যালকোহল ও ধূমপান।

৩. অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস।

৪. অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ।

৫. অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা।

৬. শারীরিক ওজন কম, কিন্তু রক্তে কোলেস্টরেল বা অতিরিক্ত চর্বি বেড়ে গেলেও হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।

৭. কায়িক পরিশ্রম, ব্যায়াম ও হাঁটাহাঁটি না করা, শুয়ে-বসে থাকা।

৮. মানসিক চাপ, উদ্বেগ, বয়স, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণেও হতে পারে।

হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ

১. হার্ট অ্যাটাকের প্রধান লক্ষণ বুকে ব্যথা হওয়া। দুই বুকের মাঝখানে মুষ্টিবদ্ধ হাত রাখলে যেটুকু জায়গা এটাকে রেট্রোস্টার্নাল পেইন বলা হয়। ভেতর থেকে ব্যথা হবে আর এই জায়গার ব্যথাকেই হার্ট অ্যাটাকের ব্যথা বলে।

২. বুকের ব্যথা একসময় বাম হাত ও ঘাড়ের দিকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। চোয়াল, পেটেও ব্যথা হতে পারে।

৩. হার্ট অ্যাটাকের তীব্রতা বেশি হলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে, কাশি হতে পারে।

৪. প্রেশার কমে গিয়ে অতিরিক্ত ঘাম হতে পারে।

৫. বুকের ব্যথার তীব্রতা বেশি হলে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে রোগী।

৬. অনেক সময় বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া।

৭. বুক ধড়ফড় করা।

হার্ট অ্যাটাক হলে তাৎক্ষণিক করণীয়

ডা. কাজল কর্মকার বলেন, হার্ট অ্যাটাক এমন একটি সমস্যা যার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে রোগী যেকোনো সময় মারা যেতে পারে। বুকে ব্যথা অনুভূত হলে, হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ মনে হলে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে জরুরি স্বাস্থ্য সেবায় (৯৯৯) ফোন করতে পারেন।

আক্রান্ত ব্যক্তি যেন বেশি নড়াচড়া না করেন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শান্ত থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। রোগী যদি জ্ঞান হারায় বা শ্বাস নিচ্ছে না এমন হলে সঠিক নিয়মে কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন বা সিপিআর দিতে হবে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে সিপিআর কীভাবে দিতে হয় সেটি জানেন এমন কোনো ব্যক্তি ছাড়া না জেনে যে কেউ সিপিআর দিতে পারবেন না।

আক্রান্ত ব্যক্তিকে অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ অ্যান্টি প্লাটিলেট ড্রাগ দেওয়া যেতে পারে, যা রক্ত তরল করার জন্য ও ধমনিতে রক্ত প্রবাহে বাধা কমাতে সহায়ক।

কারো যদি আগে থেকে হার্টের সমস্যায় নাইট্রোগ্লিসারিন জাতীয় ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসক, তাদেরকে তাৎক্ষণিক অবস্থায় জিহ্বার নিচে ওই ওষুধ দেওয়া যেতে পারে। অন্যদের বেলায় দেওয়া যাবে না।

হার্ট অ্যাটাক হলে পালস রেট কমে যায়। এ সময় কাশি দিলে রিফ্লেক্স হয়, যার ফলে প্রেশার বাড়ে এবং হার্ট রেটও বেড়ে যায়। সেজন্য কাশি দিতে বলা যেতে পারে রোগীকে।

চিকিৎসা

ডা. কাজল কর্মকার বলেন, ইসিজি ও রক্ত পরীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় পরীক্ষার মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কি না, সেটি নিশ্চিত হবে। তাৎক্ষণিকভাবে রোগীর অবস্থা বিবেচনা করে রক্ত যাতে জমাট না বাঁধে, চর্বি না জমে সেজন্য রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করা ও রক্ত তরল করার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া হয় রোগীকে। প্রেশার, গ্যাস্ট্রিক, ডায়াবেটিস, কোলেস্টরেল থাকলে, ঘুম না হলে সেগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওষুধ খেতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শে। একই সঙ্গে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনে পরিবর্তন আনতে হবে।

এ ছাড়া আধুনিক চিকিৎসা হিসেবে অ্যানজিওগ্রাম করা হয়। হার্ট অ্যাটাকের পর অ্যানজিওগ্রাম করা যেতে পারে, আবার পরেও করা যেতে পারে। অ্যানজিওগ্রামের মাধ্যমে দেখতে হবে হার্টের ব্লক আছে কি না। যদি বেশি ব্লক থাকে, তাহলে বাইপাস করতে হবে। আর যদি কম ব্লক অর্থাৎ এক বা দুইটা ব্লক থাকে তাহলে রিং পরানো যেতে পারে। হার্টের চিকিৎসায় রক্তনালীর ব্লক দূর করে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক বা পুনঃপ্রতিস্থাপন করাটাই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিরোধ

১. জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে।

২. সকালে ও বিকেলে নিয়মিত ৩০-৪৫ মিনিট হাঁটা ও ব্যায়ামের অভ্যাস করতে হবে।

৩. অ্যালকোহল ও ধূমপান পরিহার করতে হবে।

৪. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, জাঙ্ক ফুড, অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিহার করতে হবে।

৫. ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, প্রেশার, কোলেস্টরেল থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

৬. পরিবারে যদি হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস থাকে, তাদের ২০ বছর বয়সের পর থেকেই নিয়মিত চেক আপ করাতে হবে।

৭. উদ্বেগ, মানসিক চাপমুক্ত থাকতে হবে, ঝগড়া কিংবা জোরে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে।

Comments