‘ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো নির্বাচন’ মানে কী?

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি-ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার বলেছেন, 'আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো নির্বাচন।' গত ১১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন ভবনে ‍উন্নয়ন সহযোগীদের জন্য আয়োজিত ব্রিফিং শেষে তিনি বলেন, 'আমরা একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে সমর্থন করছি। আশা করি বাংলাদেশের ইতিহাসে সেরা নির্বাচন হবে এবং সেটিই আমাদের আকাঙ্ক্ষা।'

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, তা নিয়ে যে ধোঁয়াশা ছিল, যা আপাতদৃষ্টিতে কেটে গেছে। কেননা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য দুটি সময়ের (ডিসেম্বর ২০২৫ অথবা জুন ২০২৬) কথা বললেও গত ১০ ফেব্রুয়ারি তার সঙ্গে বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, 'প্রধান উপদেষ্টা ও তার সঙ্গে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা আশ্বস্ত করেছেন যে, অতি দ্রুত নির্বাচন দেওয়া হবে এবং জনগণের প্রত্যাশা রয়েছে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট হবে। আমরা আশা করছি, এ ব্যাপারে সরকার দ্রুত একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করবে।'

একই দিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার জানিয়েছেন, তারাও ডিসেম্বরের মধ্যে যাতে জাতীয় নির্বাচন হয়, সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, 'সবার প্রত্যাশা পূরণের জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে। পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই।'

গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে জনপরিসরে যে আলোচনাটি ঘুরপাক খাচ্ছে সেটি হলো, জাতীয় নির্বাচন কবে হবে? বিশেষ করে অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যে ধরনের সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা চলছে, তাতে জনগণের একটি বিরাট অংশই মনে করে যে, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতির হয়তো উন্নতি ঘটবে।

নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলেই যে রাতারাতি পরিস্থিতি বদলে যাবে, সেটিও বলা কঠিন। কিন্তু তারপরও জনমনে এই ভরসা অন্তত আছে যে, এ মুহূর্তে যে ধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে এবং দেশের অর্থনীতি যেভাবে খারাপ হচ্ছে; অসংখ্য শিল্প-কারখানা বন্ধ এবং তার ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ যেভাবে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন, সেখানে হয়তো একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে যদি রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসে। কেননা এখন যে পরিস্থিতি চলছে তাতে নতুন করে কোনো বিনিয়োগ হওয়া কঠিন। কেননা পুরোনো বিনিয়োগকারীরাও এক ধরনের ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। সুতরাং নির্বাচনটি দ্রুত প্রয়োজন বলে বিএনপি যেমন মনে করছে, তেমনি নাগরিকেরও বিরাট অংশ। যদিও সংস্কারের আগে নির্বাচনের ব্যাপারে ভিন্ন অবস্থানে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মতো দলগুলো।

ধরা যাক নির্বাচন ডিসেম্বরে বা ডিসেম্বরের মধ্যেই হবে। সেটিই কি সমাধান? এক কথায় উত্তর হচ্ছে 'না'। নির্বাচনই সমাধান নয়। নয় যে তার প্রমাণ বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন—যেগুলো হয়েছিল দলীয় সরকারের অধীনে একতরফা। আইনত গত তিনটি মেয়াদে নির্বাচিত সরকারই ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু তারা যে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে এবং বিগত তিনটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে দেশের পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থাটিই ধ্বংস করা হয়েছে, তা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ কম। তার মানে নির্বাচনই একমাত্র সমাধান নয়। বরং প্রশ্ন হলো নির্বাচনটি কেমন হবে? সেই কেমন প্রশ্নের উত্তরেই স্টেফান লিলার বলেছেন, 'আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো নির্বাচন।'

ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো নির্বাচন বলতে আসলে কী বুঝায়—সেটি অনেক বড় তর্ক। সেই তর্কে না গিয়েও এটা বলা যায় যে, ভালো নির্বাচন মানে হলো তফসিল ঘোষণার পর আগ্রহী সব প্রার্থী নির্বিঘ্নে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন। মনোনয়ন যাচাই-বাছাইয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তারা রাজনৈতিক কারণ বা অন্য কোনোভাবে প্রভাবিত হবেন না। প্রতীক বরাদ্দের পরে প্রার্থীরা আচরণবিধি মেনে প্রচার-প্রচারণা চালাবেন এবং সেখানে সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে যা নিশ্চিত করবে নির্বাচন কমিশন। কোনো প্রার্থীকে তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার বা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে সরকারের কোনো বাহিনী চাপ প্রয়োগ করবে না। নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ভোটের একটি সুন্দর ও উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় থাকবে। ভোটের দিন ভোটাররা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন এবং পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্ভয়ে ফিরবেন। জাল ভোট, কেন্দ্রদখল বা সহিংসতা হবে না। ভোট গণনায় কোনো ধরনের কারচুপি হবে না। কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে জয়ী করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা উৎসাহ দেখাবেন না বা এ বিষয়ে তাদের ওপর কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় চাপ থাকবে না। ভোটের ফলাফল ঘোষণার পরে প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থী সেটি মেনে নেবেন।

অনেক সময় ভোট সুষ্ঠু বা শান্তিপূর্ণ হলেও সেখানেও কারচুপি হতে পারে। ভোটের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। সুতরাং সহিংসতামুক্ত নির্বাচন মানেই সেটি গ্রহণযোগ্য ভোট নাও হতে পারে। একটি নির্বাচনকে তখনই ভালো নির্বাচন বলা যায় যখন সেটি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়। সেই হিসাবে বাংলাদেশে বিগত দিনে হওয়া ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্যে পঞ্চম, সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়া আর কোনো নির্বাচনই বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। ওই তিনটি নির্বাচন নিয়েও পরাজিত দলের পক্ষ থেকে কিছু অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু ভালো নির্বাচনের সংজ্ঞা অনুযায়ী সেগুলো ছিল গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য। অতএব আগামী জাতীয় নির্বাচনটি সেরকম হলেও মানুষ খুশি হবে।

নানা ইস্যুতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনা করার একটা প্রবণতা আমাদের দেশে আছে। যেমন ভারতের নির্বাচন কমিশন যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম, তার পেছনে রয়েছে দেশটির সংবিধান, আইন ও প্রশাসনিক কাঠামো। ভারতের নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন হলেও অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে নির্বাচন কমিশন মূলত সরকারের ওপর নির্ভরশীল এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে ক্ষমতাসীন দল দারুণভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সুতরাং সেই প্রবণতা ও সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারলে কাগজে-কলমে কমিশনকে স্বাধীন বলে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন দলের নিবন্ধন, কোনো দলের নিবন্ধন বাতিল, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা ইত্যাদি ইস্যুতে কমিশন কতটা নিরপেক্ষ, নির্মোহ ও সরকারের প্রভাবমুক্ত থাকতে পারছে—সেটি দিয়েই বোঝা যাবে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের ভূমিকা কেমন হবে।

বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে যে কাজ করতে পারে না, তার পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনি দুর্বলতার বাইরেও প্রধান কারণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। যে কারণে দেখা গেছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো তুলনামূলক ভালো ও বিতর্কমুক্ত হয়েছে। আগামী নির্বাচনও যেহেতু একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনেই হবে, অতএব সেখানে নির্বাচন কমিশনের ওপর সরকারের বাড়তি কোনো চাপ থাকবে না বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

অতএব, ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো নির্বাচন প্রয়োজন নেই, বরং অন্তর্বর্তী সরকার যদি নির্বাচনে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার না করে বা করতে না পারে; নির্বাচন কমিশন যদি সবার জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) তৈরি করে; সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং মাঠ প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ ও নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করে—তাহলেই একটা ভালো নির্বাচন করা সম্ভব এবং সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণ যাদেরকে চাইবে তারা যদি সরকার গঠন করতে পারে, তাহলে সেটিই হবে দেশ ও জাতির জন্য বিরাট পাওয়া।

গত তিনটি নির্বাচনে যে মানুষেরা ভোট দিতে পারেনি বা ভোট দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি, তারা এবার নিজের পছন্দের প্রার্থীকে কোনো ধরনের ভয়-ভীতি ও চাপমুক্ত পরিবেশে ভোট দিতে পারলেই খুশি হবে। কেননা সংবিধান যে জনগণকে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার মালিক বলে ঘোষণা করেছে, সেই মালিকানা প্রয়োগের প্রধান উপায় যে ভোট—সেই ভোট দিতে না পারার ক্ষোভও যে আওয়ামী লীগের পতনের পেছনে বিরাট ভূমিকা রেখেছে, সে বিষয়ে দ্বিমতের সুযোগ কম। অতএব এবারও যদি মানুষ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে না পারে বা এবারও যদি সরকার নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে এবং কোনো একটি দল বা জোটকে জিতিয়ে আনার ব্যাপারে ভূমিকা রাখে—তাহলে দেশ যে সংকটের ভেতরে ছিল, তার চেয়ে বড় সংকটে পতিত হবে।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments