চা-শ্রমিকদের ভাষা রক্ষায় নেই কোনো জাতীয় উদ্যোগ

চা-বাগানের শিশুরা। ছবি: স্টার

বাংলাদেশের চা-শ্রমিকদের অধিকাংশই অবাঙালি। খাড়িয়া, সৌরা, মুন্ডারি, রাজবংশীর মতো অন্তত ১৫টি ভাষায় কথা বলে এসব চা-বাগানে বসবাস করা প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা এসব ভাষার সিংহভাগই এখন বিপন্নপ্রায়।

দেশের কয়েকটি আদিবাসী ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নসহ কিছু সরকারী উদ্যোগ নেওয়া হলেও চা-বাগানের ভাষাগুলো এখনো পুরোপুরি উপেক্ষিত। এমনকি বিপন্নপ্রায় ভাষার তালিকাতেও নেই চা-বাগানের কোনো ভাষা।

সরকার ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগের অভাব এই ভাষাগুলোর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। কেবল ভাষা না, এই সংকট চা-শ্রমিকদের শত শত বছরের সাংস্কৃতিক পরিচয় ও ঐতিহ্যকেও বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (সেড) মতে, বাংলাদেশে ১৫৮টি চা-বাগান রয়েছে। সেখানে কাজ করেন এক লাখ ৩৮ হাজার শ্রমিক। তবে মোট জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ।

এই জনগোষ্ঠীগুলোর বাংলায় আগমন ব্রিটিশ আমলে। সিলেট অঞ্চলের চা-বাগানগুলোর জন্য বিহার, মাদ্রাজ, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশসহ ভারতের বেশ কিছু অঞ্চল থেকে শ্রমিক নিয়ে আসে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো।

ভাষাগত তফাৎ, শ্রেণি-বৈষম্য, শোষণ ও বঞ্চনার মধ্য দিয়ে এসব জনগোষ্ঠী এখনো নিম্নবিত্ত হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছে। জীবনমানের মতো তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিও সরকারের কাছে উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।

হবিগঞ্জের চন্ডিছড়া চা-বাগানের বাসিন্দা মনি মুন্ডা জানান, সেখানে তার সম্প্রদায়ের ৪০টি পরিবার বাস করে, যাদের মাতৃভাষা মুন্ডারি।

'আমাদের বাবা-মায়েরা মুন্ডারি ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু এখনকার বেশিরভাগ শিশুই এই ভাষা পারে না। তারা বাংলা শিখে বড় হচ্ছে,' বলেন মনি।

তিনি আরও জানান, তার সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন মনে করে মুন্ডারি ভাষা 'পশ্চাৎপদ, এর কোনো মূল্য নেই'। তারা তরুণ প্রজন্মকে এই ভাষা ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করেন।

মুন্ডারি কেবল কথা বলার ভাষা না। এর নিজস্ব লিপি, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস আছে। এটি আর্য-পূর্ববর্তী একটি ভারতীয় ভাষা, যা অস্ট্রো-এশীয় ভাষাগোষ্ঠীর অংশ। কিন্তু চাঁন্দপুর, লুস্করপুর, লালচাঁদ, চাকলাপুঞ্জি, সুরমার মতো অনেক চা বাগানে মুন্ডারি ভাষা বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকসের (সিল) মতে, বাংলাদেশে ১৫টি বিপন্নপ্রায় মাতৃভাষা রয়েছে, যার প্রায় সবগুলোই চা-বাগানের মানুষজনের ভাষা। সিলের তথ্য অনুযায়ী কন্দ, গঞ্জু, বানাই, বাড়াইক, বাগদি, ভূমিজ, খাড়িয়া, মালো, মুসহর, তেলি, তুরি, রাজোয়ার, হুদি ও ভুঁইমালী সম্প্রদায়ের ভাষা এখন বিলুপ্তির মুখে।

এদের মধ্যে মালো, বাড়াইক ও গঞ্জু সম্প্রদায়ের লোকেরা মৌখিকভাবে 'সাদরি' ভাষা ব্যবহার করে। তবে এ ভাষার কোনো লিপি নেই। বাগদি, হুদি ও ভুঁইমালী সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষার মৌখিক প্রচলনও বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

সিলের এদেশীয় পরিচালক কর্নেলিয়াস টুডু বলেন, 'এসব জাতিসত্তার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থান দুর্বল। জীবন-জীবিকার তাগিদে ছুটতে গিয়ে তারা ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও নিজস্বতার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। তাদের দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা মাতৃভাষা শেখার বা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তা হস্তান্তর করার প্রতি অনীহা তৈরি করছে।'

বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, উত্তরবঙ্গের মতো কিছু অঞ্চলের আদিবাসীদের ভাষা নিয়ে দেখা দেওয়া সমস্যাগুলো নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়। সমাধানের পথও খুঁজে বের করা হয়। কিন্তু চা-বাগানগুলোর কথা সবাই ভুলে যায়।'

প্রান্তিক সম্প্রদায়ের এসব ভাষা, সংস্কৃতি এবং পরিচয় সংরক্ষণের জন্য সরকার এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের অতিরিক্ত পরিচালক (ভাষা, গবেষণা ও পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।'

Comments