মাজারের মৌন আর্তনাদ

নরসিংদীর পলাশে ঐতিহ্যবাহী দেওয়ান শরীফ খানের মাজারে গত ৫ আগস্ট হামলা ও ভাঙচুর হয়। ছবি: ওয়াহেদ আশরাফ

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আলিমুদ্দিন চিশতীর মাজার। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে মাজারটিতে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল বিভিন্ন আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠান, যেখানে শহরের ভেতর ও বাইরে থেকে অংশ নিতেন ভক্তরা। বাৎসরিক উৎসব ছাড়াও প্রতি বৃহস্পতি-শুক্রবার জমতো ভক্তদের মিলনমেলা। বৃহস্পতিবার রাতে সাপ্তাহিক মাহফিলে অংশ নিতেন বিশিষ্ট বাউল শিল্পীরা।

গত ১১ সেপ্টেম্বর রাতে ভুলতা বাজারের কাছে পোনাবো এলাকার মাজারটিতে সংঘবদ্ধভাবে হামলা করে একদল দুর্বৃত্ত। এরপর থেকে (২২ জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত) মাজার কমপ্লেক্সটি তালাবদ্ধ এবং পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। ভেতরের মসজিদেও ভাঙচুরের ছাপ। প্রাক্তন খাদেম আব্দুল হকের সমাধির ওপর টিন-কাঠের নির্মিত কাঠামোটি বিধ্বস্ত, ভক্তনিবাসগুলো খালি পড়ে আছে। খাদেম (মাজার প্রধান), ইমাম ও ভক্তরা নিরুদ্দেশ।

গত ৮ অক্টোবর ও ১০ নভেম্বর এবং পরবর্তীতে এ বছরের ২২ জানুয়ারি তিন দফায় মাজারটি সরেজমিনে পরিদর্শন করেও কথা বলার মতো তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে আমাদের দ্বিতীয় পরিদর্শনের সময় নির্জন মাজারে প্রার্থনা করতে আসা বাহাউদ্দিন নকশবন্দি নামের এক তরুণ জানান, আবারও হামলার আশঙ্কায় খাদেম, ইমাম ও ভক্তরা মাজারে আসছেন না।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই দেশজুড়ে ভিন্ন এক ধরনের 'মব' হামলা শুরু হয়, যা এত বড় আকারে আগে কখনো দেখা যায়নি।

দেশের বিভিন্ন স্থানে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মাজার, সুফি দরবার শরীফ, পাগল-ফকিরদের মাজার ও বাউল-ফকিরদের আখড়া-আস্তানায় একেরপর এক হামলা হতে থাকে। এর বেশিরভাগই হয়েছে প্রশাসনিক শূন্যতার প্রথম কয়েকদিনে এবং সেপ্টেম্বরজুড়ে শিথিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যে। গত অক্টোবর ও ডিসেম্বরে কোনো হামলার খবর পাওয়া না গেলেও, গত নভেম্বর এবং এ বছরের জানুয়ারিতে বেশ কয়েকটি মাজারে হামলা হয়েছে। সর্বশেষ গত ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী ও মানিকগঞ্জে দুই মাজারে ওরসে হামলা হয়।

গত অক্টোবর-নভেম্বর এবং এ বছরের জানুয়ারিতে কমপক্ষে ২৫টি আক্রান্ত মাজার পরিদর্শন এবং ভক্ত, খাদেম ও পীরদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। আবারো হামলার আশঙ্কায় মাজারে যাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন তাদের অনেকেই।

গত ৮ জানুয়ারি ময়মনসিংহে ২০০ বছরের পুরোনো একটি মাজারে বাৎসরিক ওরস ও কাওয়ালি গানের উৎসবে হামলা হয়।

এ ঘটনার তিনদিন পর সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী গণমাধ্যমকে বলেন, 'মাজার বা বাউল সংগীত, কাওয়ালি গানের আসরে কোথাও কোথাও হামলা হচ্ছে, সব জায়গায় না। একটি জায়গায় হলেও আমরা টলারেট করব না, আমাদের অবস্থানটা খুব পরিষ্কার, এ ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণু।'

পুলিশের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত ১৮ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং দেশে গত ৪ আগস্ট থেকে পরবর্তী সাড়ে পাঁচ মাসে ৪০টি মাজারে হামলার বিষয়ে নিশ্চিত করেছে। এসব ঘটনায় ১৫ মামলায় পুলিশ এখন পর্যন্ত ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে এবং বিভিন্ন থানায় ২৯টি সাধারণ ডায়েরির (জিডি) তদন্ত চলছে।

গত ২৩ জানুয়ারি বিশ্ব সুফি সংস্থা নামে এক সংগঠন জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানায় যে, আগস্ট থেকে অন্তত ৮০টি মাজারে হামলা হয়েছে।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর হামলার পর গাজীপুরের পোড়াবাড়ীর ফসিহ পাগলার মাজারের ধ্বংসাবশেষ। ছবি: তরুণ সরকার

হামলা, সংঘর্ষ, হতাহত

ডেইলি স্টারের নিজস্ব অনুসন্ধান ও গণমাধ্যম প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শুধু গত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসেই সারাদেশে কমপক্ষে ৭০টি মাজার ও আখড়ায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট হয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) জানায়, এসব হামলায় অন্তত একজন নিহত ও ৪৩ জন আহত হয়েছেন। গাজীপুরের পোড়াবাড়ীর ফসিহ পাগলার মাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সামছু পাগলার মাজার ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সৈয়দ রেজা সারওয়ারের মাজারসহ বেশ কয়েকটি মাজারে একাধিকবার হামলা হয়েছে এবং কোনো কোনোটিকে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

কোথাও কোথাও ভক্তদের জোরপূর্বক চুল-দাড়ি ছেঁটে প্রকাশ্যে অপমান করা হয়েছে।

আমাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একদিনে সর্বোচ্চ ১৪টি হামলা হয়েছে গত ৫ আগস্ট বিকেলে।

আক্রান্ত মাজারের মধ্যে কুমিল্লার লাকসামে সৈয়দ আশরাফ আলী চাঁদপুরী প্রতিষ্ঠিত আশরাফনগর দরবার শরীফ একটি। হামলার সময় প্রথমেই মাজারের খাদেম ও ভক্তদের পিটিয়ে বের করে দেওয়া হয়। তারপর চলে ভাঙচুর ও লুটপাট এবং শেষে আগুন দেওয়া হয় বলে জানিয়েছে দরবার শরীফ সূত্র।

গত নভেম্বরে দরবার শরীফের পীর সৈয়দ মো. মাজেদুল হক চাঁদপুরী বলেন, 'দরবার একটি সর্বজনীন জায়গা। এখানে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সবাই আসে। দরবারে মানুষ আসে ভালোবাসায়। এখানে জোর করে কাউকে আনা যায় না। আবার কেউ আসতে চাইলে জোর করে ঠেকিয়েও রাখা যায় না।' 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সামছু পাগলার মাজারে ৬ ও ৭ আগস্ট দুই দফায় হামলা হয়।

মাজারের খাদেম ও স্থানীয় ইউপি সদস্য আলাউদ্দিন মেম্বার গত ৮ অক্টোবর ডেইলি স্টারকে জানান, হামলাকারীরা তার মাথায় আঘাত করে পাশের একটি ডোবায় ফেলে দেয়। হামলার দুই ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরলে হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মাথায় ৩৫টি সেলাই পড়ে।

নরসিংদীর কপ্পা পাগলার মাজারের খাদেম সজল ফকির জানান, মাজারের পাশাপাশি খানকাহ ঘর, কাফেলা ঘর, জিয়ারত ঘর, এমনকি খাদেম-ভক্ত পরিবারের বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাট চালানো হয়।

গত আগস্টে মাজারে মাজারে একচেটিয়া হামলা হলেও সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তা রূপ নেয় সংঘর্ষে। গণমাধ্যমের তথ্যানুসারে, সিলেটে শাহ পরানের ওরসের শেষদিনে দুই পক্ষের সংঘর্ষে প্রায় ৫০ জন আহত হন।

নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও ত্রিশালে দেওয়ানবাগ দরবার শরীফেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। মাজার সূত্র, পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, সেসব হামলায় একজন নিহত ও অনেকে আহত হয়েছেন।

একদিনে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ঈদে মিলাদুন্নবীর দিন। সেদিন নেত্রকোণার তারাকান্দা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, ফেনীর দাগনভূঁইয়া এবং কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে মাজার ভক্ত ও হামলাকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

মাজার সূত্র ও স্থানীয়রা জানায়, কুলিয়ারচরের সংঘর্ষে অন্তত একজন নিহত হয়েছেন।

ঐতিহ্য ধ্বংস

আক্রান্ত মাজারের অনেকগুলোই প্রাচীন এবং এগুলোর ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে। কিছু কিছু মাজার কয়েক শতাব্দী আগে নির্মিত, যখন এ অঞ্চলে ইসলামের বিস্তার লাভ শুরু করে। ইসলামী বিশেষজ্ঞদের মতে, মাজার এবং সুফিবাদের ঐতিহ্য এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এখনকার মাজার সংস্কৃতির সমালোচকরা অবশ্য বলছেন, কিছু কার্যকলাপ যেমন গান গাওয়া, পুরুষ ও নারীদের পাশাপাশি প্রার্থনা করা এবং ধূমপান ইসলামে অনুমোদিত নয় এবং তাই এ ধরনের অনুশীলন বন্ধ করতে হবে।

৫ আগস্ট আক্রান্ত মাজারগুলোর মধ্যে চারটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মাজার- ঢাকার বৈরাম শাহর মাজার, যশোরের গরীব শাহর মাজার, নরসিংদীর দেওয়ান শরীফ খানের মাজার এবং চুয়াডাঙ্গার শাহ ভালা নামে পরিচিত সৈয়দ রেজা চিশতীর মাজার।

গরীব শাহ, দেওয়ান শরীফ খান এবং শাহ ভালার মাজার চত্বরের পরিসর বেশ বড় এবং তিনটি মাজারেই প্রতিদিন প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়, পাগল-ফকির-বাউলদের উপস্থিতি থাকে। তবে বৈরাম শাহর মাজারটি বর্তমানে এক কক্ষে সীমাবদ্ধ। হাকিম হাবিবুর রহমানের ঢাকা বিষয়ক আকরগ্রন্থ 'আসুদেগানে ঢাকা'য় উল্লেখ আছে যে, মাজারটি পাঠান আমলের (আনুমানিক ১৩-১৬ শতক) এবং এখানে একসময় শিলালিপিও ছিল।

ঈশা খার বংশধর দেওয়ান শরীফ খানের মাজারটি একটি হেরিটেজ ভবন। মূল সৌধভবনটি মুঘল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত বর্গাকার এবং এক গম্বুজবিশিষ্ট ভবন। এর পাশে রয়েছে বঙ্গীয় স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত একটি দোচালা কক্ষ। মাজার চত্বরের চারপাশে আছে কয়েকটি ভবন এবং ভক্ত, পাগল-ফকিরদের জন্যে টিন দিয়ে নির্মিত কিছু অস্থায়ী ছাউনি।

মাজারের খাদেম দীন ইসলাম বলেন, '৫ আগস্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিন শতাধিক লোক এসে প্রথমে মাজার, মাজারের অফিস, রান্নাঘর, খাদেমের থাকার জায়গা, পাগল-ফকিরদের আস্তানায় লুটপাট চালায়। এরপর ভাঙচুর করে। শেষে তারা মাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়।'

গত ২৩ সেপ্টেম্বর সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, হামলায় দেওয়ান শরীফ খানের মাজারের হেরিটেজ ভবনটির ভেতর ও বাইরের বিভিন্ন দিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষত বিভিন্ন দিকের দরজা, কুলঙ্গি ও মেঝে।

তিন শতাধিক বছরের পুরোনো নোয়াখালীর লক্ষ্মী-নারায়ণপুর এলাকার চাড়ু মিজি শাহর মাজার ভাঙচুর হয় ১৩ সেপ্টেম্বর।

শাহ সুফি সৈয়দ রেজা সারোয়ার রাজাজীর মাজারের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন তার স্ত্রী অ্যাডভোকেট সৈয়দা জাহিদা সুলতানা। গত ৫ আগস্ট মাজারটি গুড়িয়ে দেওয়া হয়।

মাজার সংস্কৃতি

ইসলামী মরমীবাদের পরম্পরাগুলো তরিকা বা সিলসিলা নামে পরিচিত। প্রতিটি তরিকার মধ্যে পীর, ফকির ও পাগল ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সাধক দেখা যায়। আবার কলন্দরিয়া ও মাদারী তরিকা মূলত পাগলদের তরিকা।

সেমেটিক ও ভারতীয় ঐতিহ্যে প্রাচীনকাল থেকে সাধকদের মধ্যে পাগলপন্থা একটি প্রবহমান ধারা। সবধরনের সামাজিকতা আর বিধি-বিধানকে পাশ কাটিয়ে স্রষ্টার প্রেমে মগ্ন পাগলদের সুফি পরিভাষায় বলা হয় 'মজ্জুব'।

সুফি গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আহসানুল হাদী ইসলামী ঐতিহ্যে পাগল-ফকিরি ধারার সূচনা প্রসঙ্গে বলেন, 'সুফি শব্দের উৎপত্তি নিয়ে কয়েকটি মত আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, "সুফফা" শব্দ থেকে সুফি শব্দের উদ্ভব। সুফফা হচ্ছে মসজিদে নববী সংলগ্ন একটি স্থান, সেখানে মক্কা থেকে হিজরত করে আসা একদল তরুণ অবিবাহিত মুহাজির দরিদ্রতার মধ্যে বসবাস করতেন। তাদের "আসহাব আল সুফফা", "আহলুস সুফফা" অথবা "আহলে সুফফা" বলা হয়। সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাসুল (স.)। রাসুলের (স.) সাহচর্যের জন্য আহলে সুফফারা উন্মুখ হয়ে থাকতেন, এবাদতে মগ্ন থাকতেন। পাশাপাশি তারা ধর্ম, কৃষি ও শিল্পসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করতেন।'

ড. হাদী আরও বলেন, 'আহলে সুফফাদের নিয়মিত খাবার জুটতো না। কারও কারও পোশাক ছিল ছেঁড়া। আহলে সুফফাদের উপহাস করে কেউ কেউ পাগল বলতো।'

সুফিদের প্রার্থনাসহ তৎপরতা পরিচালনার কেন্দ্র দরবার শরীফ মূলত কমপ্লেক্স ধরনের হয়। একেকটি কমপ্লেক্সে মসজিদ, মাদ্রাসা, হেফজখানা, গ্রন্থাগার, এতিমখানা, লঙ্গরখানা, হাসপাতাল, অফিস, অতিথি নিবাস ও ভাণ্ডারকক্ষ থাকে। কোনো কোনো দরবার শরীফের রয়েছে একাধিক শাখা দরবার ও খানকাহ।

সুফি ঐতিহ্যে যেমন দরবার শরীফ, তেমনি বাউল-ফকিরদের মধ্যে রয়েছে আখড়া-আশ্রম প্রতিষ্ঠার রেওয়াজ। বাউল-ফকিরদের আখড়া ও আশ্রমের পরিসর সাধারণত দরবারের তুলনায় ছোট হয়। অনেকক্ষেত্রে বসতবাড়ির এক কোণে একটি ঘর তৈরির পর পরিণত করা হয় আখড়া বা আশ্রমে। এ ছাড়া, পাগল-ফকিরদের কিছুটা স্থায়ী অবস্থানস্থলকে বলা হয় আস্তানা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ইসলামী ঐতিহ্যের মরমী ধারার চার ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে পাগল-ফকিরদের, বিশেষ করে পাগলদের মাজার। যেখানে ধর্ম-বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার প্রবেশাধিকার এবং প্রার্থনার অংশ হিসেবে নিয়মিত সংগীতচর্চা ছিল। অনুষ্ঠিত হতো বাৎসরিক ওরস ও মেলা।

এ প্রসঙ্গে কবি এবং সুরেশ্বরী তরিকার ফকিরি ধারা অনুশীলনকারী সৈয়দ তারিক বলেন, 'মাজারের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। এখানে ভক্তিবাদী সাংস্কৃতিক আবহ বিরাজ করে। মাজারে সব ধর্মের, সব বর্ণের মানুষ আসে। এখানে নারীদের প্রবেশাধিকার আছে। যার যেভাবে মন চায়, সেভাবেই প্রার্থনা করে। কোনো ধর্মীয় কঠোরতা নেই। মাজার হচ্ছে আধ্যাত্মিক মুক্তাঞ্চল।'

'মাজার ভাঙার মাধ্যমে সংগীতচর্চা বন্ধ, নারীদের প্রবেশ ও ভক্তি প্রকাশে বাধা দেওয়া হচ্ছে। জোর করে শরিয়ত সিস্টেম চাপিয়ে দিয়ে মাজারের নিজস্ব সংস্কৃতি ধ্বংসের পায়তারা চলছে। নিজের নিয়ম অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়াটা অগণতান্ত্রিক। মাজারে জোর-জবরদস্তি করলে ফল ভালো হবে না। শরীয়ত বনাম মারিফত লড়াই বেঁধে যেতে পারে', বলেন তিনি।

'নিরাপত্তাহীনতার ঘেরাটোপ'

মাজারে হামলার প্রথম ঢেউয়ের কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও দেশজুড়ে খাদেম-ভক্তদের মধ্যে এখনো নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি বিরাজ করছে।

অপরদিকে, বাউল সাধকরা (জীবিকা ও আধ্যাত্মিক আনন্দের জন্য যারা মাজারে সংগীত পরিবেশন করেন) কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না যে, সমাজের একটি অংশ তাদের ওপর হামলা করবে এবং সংগীতচর্চা বন্ধ করে দেবে।

দেশে প্রায় চার লাখ পেশাদার বাউল আছেন বলে ধারণা করা হয়।

কুমিল্লার লাকসামে ভাণ্ডারী তরিকার অনুসারী মালেক দরবেশের মাজারে হামলা হয় গত ৫ আগস্ট সন্ধ্যায়। মাজার পরিচালনা কমিটির সদস্য ও মালেক দরবেশের ভাতিজা শেখ সাদি বলেন, 'আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। হামলাকারীরা এখনো হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা বলেছে, আমাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবে।'

হামলার পর থেকে মাজারটিতে সংগীতচর্চা বন্ধ রাখা হয়েছে। শেখ সাদি জানান, মালেক দরবেশের জন্মদিন উপলক্ষে প্রতি বছর ৮ সেপ্টেম্বর ওরস অনুষ্ঠিত হয়। তবে এ বছর ওরস হয়নি।

মাজারের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড জোরপূর্বক বন্ধ করে দেওয়ার উদাহরণও আছে।

নরসিংদীর পলাশে ইউসুফ আলী ফকিরের মাজারে বাৎসরিক ওরস হয় ৭ নভেম্বর। মাজারের খাদেম সজল ফকির বলেন, 'ওরসের আগের দিন একদল লোক পুলিশ নিয়ে এসে অনুষ্ঠান বন্ধ করতে আয়োজকদের বাধ্য করে।'

দেশের বড় মাজারগুলোর অন্যতম সিলেটের শাহ পরানের মাজারে এ বছর বাৎসরিক ওরস অনুষ্ঠিত হলেও কোনো সংগীত পরিবেশন হয়নি। দেশব্যাপী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মাজারের খাদেম সৈয়দ কাবুল আহমদ নিজেই ওরস শুরুর দুদিন আগে গত ৬ সেপ্টেম্বর ঘোষণা দেন, ওরসে এবার গান-বাজনা হবে না।

এরপর থেকে আশপাশের মাজারগুলোতেও প্রার্থনার অংশ হিসেবে সংগীত পরিবেশন বন্ধ আছে।

বাউলমাতা নামে পরিচিত বিশিষ্ট বাউল শিল্পী আলেয়া বেগম এ প্রসঙ্গে বলেন, 'কার্তিক মাস থেকে বর্ষাকাল আসার আগ পর্যন্ত দেশের বাউল শিল্পীরা ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু এ বছর তারা বসে আছেন। কেননা তাদের অনুষ্ঠানগুলো মূলত মাজারের ওরসকেন্দ্রীক। এবার দেশের বিভিন্ন স্থানে ওরস পালনে বাধা দেওয়া হচ্ছে।'

তিনি জানান, মাদারীপুরের শিবচরের বন্দরখোলায় গত ৮ অক্টোবর ওরসে তার গান গাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সব আয়োজন সম্পন্নের পর কিছু লোক এসে নিষেধ করে। এরপর আয়োজকরা জেলা প্রশাসন থেকে ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠানের অনুমতি নিলেও তা আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আলেয়া বেগম বলেন, 'বাধা দিলে আমরা তো আর মারামারি করতে পারি না। মারামারির অভ্যাস বাউল-ফকিরদের নেই।'

তিনি আরও জানান, মাজারে মাজারে ওরস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাউলরা বেশ অর্থকষ্টে পড়েছেন। প্রাণের টানে গান গাইতে না পারায় অন্তর্দহনে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছেন তারা।

Comments