হযবরল বইমেলা, দায় কার?

একুশে বইমেলার একটা জাতীয় চরিত্র আছে। জাতীয় বা স্থানীয়ভাবে যেসব বই প্রকাশিত হয় মেলায় সেগুলোই কেবল প্রদর্শিত হয় বিক্রির জন্য। সারাদেশে সারা বছরের সিংহভাগ প্রকাশনা এ মেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয়। লেখক-প্রকাশকের দিক থেকে শুরু হয় উৎসব উৎসব ভাব। দর্শকের দিক থেকেও আগ্রহের কমতি থাকে না। সংকট কেবল ক্রেতা-পাঠকের।
অনেক বছর ধরে এ অভিযোগ চলে আসছে। এবছর আমার মনে হয়েছে ক্রেতা-পাঠকের অনাগ্রহের দিকটা চরম হয়ে উঠেছে। "অথচ খুব শক্ত করে/ হাতখানা তার ছিলাম ধরে,/ তবুও সে এই মেলার মাঠে/ হঠাৎ কখন হারিয়ে গেছে।' — মেলাটা আছে, কিন্তু মানুষটাকে খুঁজে পাচ্ছেন না নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ।
এবারের একুশের মেলায় গিয়ে মনে হল আস্ত মেলাকেই যেন আমি হারিয়ে ফেলেছি। কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। যদিও আমি মফস্বলের মানুষ, মেলায় যাই, দুএকদিন। এদিক ওদিক ঘুরি, মেলার হালচাল দেখে ফিরে আসি। বই বহনের ঝামেলা এড়ানোর জন্য মেলায় বই কেনা হয় কম। দেখে শুনে পছন্দ করে আসি। পরে অনলাইনে অর্ডার করে আনি।
এবারের মেলা বিগত ১৫-১৬ বছরের মেলার আয়োজন থেকে ভিন্ন। ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। মানুষের কথা বলায় বাধা নেই। দেশের মানুষ পরিষ্কার দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল বিগত বছরগুলোতে। মেলায় সব ধরনের পাঠক যাতে আসতে পারে সেজন্য হয়তো ধর্মীয় বইগুলোর কিছু স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। মেলার পোস্টার, কতিপয় ঘটনা সবকিছুতে ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার ছাপ স্পষ্ট ছিলো। কিন্তু তাতে কি কিছু ইতরবিশেষ হয়েছে? ধর্মীয় বইগুলোর সেই সব দোকানে বিক্রি বেশি বলে মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশের বই পাঠকরা ধর্মীয় বই এই মেলা থেকে কিনতে অভ্যস্ত নয়। ভবিষ্যতে এধারা অব্যাহত থাকলে হয়তো মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।
এবারের বইমেলা ময়দানের বিপুল পরিসর ব্যবহার করে আয়োজন করা হয়েছিল। পেছনের দিকে খাবারের দোকান। সেগুলো প্রতিবারের মতোই জমজমাট। বিদেশি দু-চারজন দেখলাম। বাংলাদেশের এক তরুণ এদের একজনের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিল। সারাক্ষণ ইংরেজি শব্দের সঙ্গে এঁ এঁ এঁ জুড়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে প্রশ্ন করছিল। কিন্তু উত্তরদাতা অপরিসীম ধৈর্যসহ উত্তর দিচ্ছিলেন হাসিমুখে। টিকটকারদের ব্যস্ততাও নজরে পড়লো। কথোপকথন শুনছিলাম দুই টিকটকারের। মুদি দোকানদার ১০০ টাকার জিনিস কিনলে একটা চালের বস্তা ফ্রি দেবে। দোকানদারের লাভ কীভাবে হবে? মেয়েটাকে বলা হল এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে ১০০ টাকা পুরস্কার। মেয়েটা ১০ সেকেন্ডে উত্তরটা দিতে পারে নি। তাই টাকাটা সে পেল না। আমার এতে আপসোস নেই।
বইমেলার সঙ্গে এর সম্পর্ক না থাকলেও এগুলো স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে বিগত বছরে। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বেশি। যেকোনো কিছু নিয়ে মেলা আয়োজন করলেই লোকসমাগম হতেই থাকে। কেনাকাটার চেয়েও সময় কাটানো মানুষের কাছে প্রধান বিষয়। স্বাভাবিকভাবে বইয়ের মেলা হোক আর বুড়াবুড়ির মেলা হোক মানুষে ভরে যায় মেলা প্রাঙ্গন। বিকেল থেকে সন্ধ্যা গড়াতে শুরু করলে পিল পিল করে মানুষ আসতে থাকে। মেয়েরা আসে প্রচুর। খুব বেশি বয়স না ওদের। আমার ধারণা ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় মনোযোগী মেয়েরা সাজগোজে একটু অমনোযোগী। কিন্তু বই মেলায় তেমনটা হয় না।
এখানে সাজগোজে পরিপাটি হয়েই আসে মেয়েরা। সাজগোজে থাকে প্রধানত দেশীয় আবহ। কিন্তু ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে হাতে বইয়ের প্যাকেট খুব একটা চোখে পড়েনি। ঢাকা শহরে পাশ্চাত্য কেতার পোশাক-পরিচ্ছদ পরা মেয়েদের দেখা যায় না এমন নয়। কিন্তু মেলায় সেরকম মেয়ে কম আসে। গ্রামীণ মেলাগুলো দরিদ্র মানুষের, আর একুশের বইমেলা একান্তই শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবর্গের। এ-মধ্যবর্গ আগেও আনুপাতিক হারে কম পড়তো এখনো তাই। নতুন প্রজন্ম কাগজের বইয়ে আগ্রহ হারাচ্ছে। কিন্তু আমাদের প্রকাশনা এখনো ডিজিটাল বইয়ের প্রতি আগ্রহী নয়। বছর বছর মেলায় দর্শনার্থী বাড়ছে কিন্তু সে হারে বই বিক্রি-বাট্টা বাড়ছে না। এ-বিষয়ে অংশীজনরা ভেবেছেন খুব তেমনটা মনে হয় না। আমার ধারণা মানুষ বই কিনতে মেলায় কেন আসবে, যেখানে অনলাইনে ভারী বস্তুটার বহন করার ঝামেলা এড়ানো যায়!
এবছর গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম মেলা। গত কয়েক বছর করোনা ও করোনা-উত্তর মেলা ধীরে ধীরে বিক্রি দিক থেকে দুর্বল হচ্ছিলো। তবে মানুষজনের উপস্থিতি আগ্রহ কমে যাচ্ছিলো আমার তেমন মনে হয় নি। এবছরও মানুষজনের উপস্থিতি ঠিক ছিলো কিন্তু মেলাটা কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছিলো। এর কারণ কী হতে পারে? অনেক ভেবেছি। একটা মত প্রচলিত আছে শিক্ষিত মধ্যবর্গের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ যেটা বিগত সরকারের অনুগ্রহ বা কৃপাভাজন ছিল তারা সরকার প্রধানের পলায়নের শোকে-দুঃখে এবার মেলা বর্জন করেছে। তাই বিক্রি বাট্টা কম। এটা আমার কাছে গুরুতর কারণ মনে হয় নি। এ শ্রেণিটা খুব যে বই কিনতো এমনটা নয়। এরা টিএস এলিয়টের কবিতার একএকজন আলফ্রেড প্রুফ্রক। জাগতিক ভণ্ডামি আর শূন্যতায় এরা ভাসমান। এরা বইকেনার মতো গভীরতায় কোনোকালে ছিলো না। সে কবিতার মতো এরা বড়জোর মহিলাদের মাইকেল এঞ্জেলোর আদলে বইয়ের নাম নেয় মাত্র।
দেশের অর্থনীতি চরম দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে বিগত ১৫/১৬বছরে। সরকারের পতনের অন্যতম কারণও এটি। এটা জাতীয় অর্থনীতির সামগ্রিক সংকট। শিক্ষিত মধ্যবর্গের বইয়ের জন্য যেটুকু বাজেট বরাদ্দ দরকার, বই পড়ার আগ্রহ থাকলে তাতে কমতি পড়তো এমন মনে হয় না। অর্থনীতির কিছু প্রভাবতো থাকতেই পারে। তাই বলে মেলার বিশ দিন পার হবার পর কোনো ছোট প্রকাশকের গত বছর এসময়ে ১২লক্ষ টাকার বই বিক্রির জায়গায় এবছর ১ লক্ষ টাকার বইও বিক্রি করতে না পারার আক্ষেপ বিস্ময়কর। লিটল ম্যাগাজিনের এক সম্পাদক বললেন, গত বছর প্রথম ২০দিনে ৬০০০ টাকার পত্রিকা বিক্রি করেছেন এই বছরে একটি কপিও কেউ কিনেনি।
পত্রিকা ছুঁয়ে দেখেছে এমন লোকও বিস্ময়করভাবে কম। বড় এক প্রকাশক মেলার বিশ দিনের হিসেব দিয়ে বললেন, গতবারের অর্ধেক পরিমাণ অর্থাগম হয়েছে এসময়ে। এভাবে চললে ব্যবসায় আর করা যাবে না। সে প্যাভিলিয়নের সামনে আবার ভীষণ ভীড়। আমি একটু কৌতূহলে কাছে গিয়ে দেখি বাইরে দাঁড়িয়ে বই দেখা যায় না। ভেতরে ঢুকতে হলো না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলে বলল, তুমি কিছু বোঝো না। ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনটা খুব ভালো হয়েছে তো, ছবি তুলতে ওরা ভীড় করছে। তাহলে এ মেলায় প্রকাশকের অর্জন কি? অর্জন বইয়ের প্রদর্শন, কিছু প্রচার যাতে অনলাইনে সারা বছর বিক্রি করা যায়। প্রকাশকরা মেলার বিক্রি নিয়ে যতটা হতাশা ব্যক্ত করুন না কেন সারাবছর অনলাইন বিক্রি যে বাড়ছে সেটা আন্দাজ করা যায়। সে হিসাবটা দেখলে বাজারের সামগ্রিক চিত্রটা পাওয়া যেতো।
বই বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত একজনের কাছে জানতে চেয়েছি, এত দুরবস্থা কেন মেলায় বিক্রির? তিনি বললেন, শুরুতেই মেলাকে বিতর্কিত করা হয়েছে। বাংলা একাডেমি এর জন্য দায়ী। পুরস্কারটা ঘোষণা করে সেটা দেয়া হয়নি সময়মতো। এবারের পুরস্কার প্রাপ্তদের বিষয়টা ছিলো সবচেয়ে কম বিতর্ক কন্টকিত। সারা মাস মেলাতে পুরস্কারের বিষয়টা আলোচনায় থাকে। বিশ্বব্যাপী সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিয়ে প্রতিবছর আলোচনা-সমালোচনা হয়। কয়েকবছর আগে একবছরতো নোবেল পুরস্কার ঘোষণাই করা গেলো না।
বাংলা একাডেমি পুরস্কার বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবর্গের আগ্রহের ও কৌতূহলের একটা জায়গা। গত কয়েকবছর আলোচনা সমালোচনা বিতর্ক একেবারে নজিরবিহীন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। এ বছর নতুন পরিস্থিতিতে পুরস্কারটা যথাবিধি করা হয়েছিল বিভিন্ন জনের কথা থেকে বোঝা যায়। কিন্তু বিগত সরকারের সমর্থক দুতিনজন পুরস্কার পেয়েছে এমন অভিযোগ ওঠায় সাংস্কৃতিক উপদেষ্টার সরাসরি হস্তক্ষেপে পুরস্কার স্থগিত হয়ে যায়। পরে ওদের বাদ দিয়ে পুরস্কার দেয়া হয়। একাডেমির এমন আচরণ মেলায় প্রভাব ফেলেছে কেউ কেউ মনে করেছেন। শুরুতেই ডাস্টবিন, সেনিটারি ন্যাপকিন, পোস্টার বিতর্ক চলে আসছিল। আমার কাছে মনে হয়েছে এসব কারণ গৌণ।
এ বাস্তবতায় আগামী বছর কেমন হবে বই মেলা? ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হবে আশা করা যায়। গোটা দেশ আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। যে উৎসাহ, উদ্দীপনা এবং আগ্রহ নির্বাচনকে ঘিরে, কারণ ১৬ বছরে দেশে ফ্যাসিবাদ ছিল। মানুষের মনোযোগ নির্বাচনের দিকে থাকবে। এর একমাসের মধ্যে বইমেলা খুব একটা জমবে আশা করা যায় না। বাংলাদেশে বই বাজারজাতকরণের দিকটাও গতানুগতিক।
বর্তমান মেলার পরিসরটা ক্রেতাবান্ধব নয়, দর্শকবান্ধব। বিষয়টি মাথায় নিয়ে আগাতে হবে। আগামীতে বই কেনার জন্য মেলায় মেলায় ধরনা না দিলেও বইকে পরিচিত করার জন্য বইয়ের ডিজিটাল ভার্সন থাকতে হবে। শুধু কাগজে বইয়ের ব্যবসা করে প্রজন্মের সঙ্গে চলবে না।
Comments