স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রবন্ধ সংকলন

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বিজয় অর্জনের পর বাংলাদেশের মানুষ কলকাতা থেকে সবেমাত্র ফিরতে শুরু করেছে স্বাধীন বাংলাদেশে। দেশ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত। অভাব-অনটন আর দুর্যোগের ঘনঘটা কাটতে তখনও অনেক দেরি। এমতাবস্থায় মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় একটি সংকলন সিরিজ- 'হে স্বদেশ'। কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধের সংকলন ও সম্পাদনার কাজ করেছে মূলত বাংলাদেশ লেখক শিবির; প্রকাশনার দায়িত্ব নেন বাংলা একাডেমি।

কথা বলবো প্রবন্ধের সংকলনটি নিয়ে, যেটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। সম্পাদনায় ছিলেন আহমদ ছফা এবং ফরহাদ মজহার। একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর বিশেষজ্ঞদের বলে প্রবন্ধ লেখানো, সংগ্রহ করা এবং সম্পাদনা করা দুঃসাধ্য ব্যাপার মনে হলেও বাংলাদেশ লেখক শিবির তা সফলতার সাথেই করতে পেরেছিলেন, বাংলা একাডেমির আর্থিক সহযোগিতায়। সময়ের কথা বিবেচনা করলে এ সংকলন ঐতিহাসিক, সন্দেহ নেই।

এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলাম এই ঐতিহাসিক সংকলনের একজন সম্পাদক ফরহাদ মজহারকে। তিনি বললেন: "আমি, আহমদ ছফা এবং হুমায়ুন কবির এই তিনজন মিলে বাংলাদেশ লেখক শিবির করি। স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ব থেকেই আমাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও আমরা সাংগঠনিকভাবে একটিভ ছিলাম। আমাদের সাথে অন্যান্য লেখকদের একটা সুসম্পর্ক ছিল। যে কারণে লেখক শিবিরের সাথে জড়িত লেখকদের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য কাজ ছিল না। যাদের লেখা সংকলনে আছে সকলেই কোনো না কোনোভাবে লেখক শিবিরের সাথে যুক্ত ছিলেন।"

লেখক শিবিরের সাথে সমকালীন লেখকদের জড়িত থাকা লেখা সংগ্রহের কাজ নিঃসন্দেহে সহজ করেছে, কিন্তু প্রকাশনা? এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির সাথে লেখক শিবিরের যোগাযোগ হয়েছিল কিভাবে? এ ব্যাপারে তিনি বলেন: "যুদ্ধের সময় যেহেতু আমরা একটিভ ছিলাম, সমকালীন লেখকদের সাথে সুসম্পর্ক ছিল, সবমিলিয়ে তখন আমাদের একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল। আমরা বাংলা একাডেমিতে গিয়ে প্রস্তাব দিয়েছি এবং তারা রাজি হয়েছেন, এতে তেমন অসুবিধা হয়নি।" তাঁর কথার সাথে মিল পাওয়া যায় ব‌ইয়ের শুরুতে একাডেমির তৎকালীন পরিচালক কবীর চৌধুরীর লেখায়: "প্রকাশনার দায়িত্ব নেবার জন্য আমাদেরকে অনুরোধ জানানো হলে পরে সানন্দ সম্মতি দিয়েছি, কারণ, বাংলাদেশ লেখক শিবির লেখক সংগ্রাম শিবিরের অগ্রগামী প্রগতিশীল তরুণদের দ্বারা গঠিত একটি সংগঠন। তাঁদের অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।"

এই ব‌ইয়ের প্রচ্ছদ‌ও স্মরণীয়। প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। তিনি ব‌ইয়ের প্রচ্ছদ করতেন না কিন্তু এই ব‌ইয়েরটা কেন করলেন? ঘটনাটা শুনি ফরহাদ মজহারের কণ্ঠে: "জয়নুল আবেদীনের কাছে প্রথমে ছফা গিয়েছিলো কিন্তু তিনি বললেন, আমি তো প্রচ্ছদ করি না, এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তারপর আমি আর ছফা একসাথে গেলাম। আমার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল; তিনি কিভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলির সাহায্যে রংতুলি ধরেন, তুলি ধরাতে কিভাবে বৃদ্ধাঙ্গুলির ব্যবহার করেন তা নিয়ে আমি একটা লেখা লিখেছিলাম। তিনি এই লেখাটা খুব পছন্দ করেছিলেন। তো, আমি জানতাম তিনি অনেক কাঁথা সংগ্রহ করতেন, যেগুলোতে অনেক শৈল্পিক চিত্র থাকতো। আমি বললাম, আপনার সংগ্রহ করা কাঁথা থেকে যে কোনো একটা চিত্র নিয়ে আমাদেরকে প্রচ্ছদটা করে দেন। তিনি আর না করলেন না, করে দিলেন। এটাই আমরা ব‌ইয়ের প্রচ্ছদ হিসেবে ব্যবহার করেছি। সম্ভবত, এটাই জয়নুল আবেদীনের আঁকা একমাত্র ব‌ইয়ের প্রচ্ছদ।"

এতে প্রবন্ধ আছে ১৯টি। ডক্টর এনামুল হকের মতো প্রাজ্ঞ-প্রৌঢ় থেকে শুরু করে হুমায়ুন কবিরের মতো তরুণের প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট বিষয়ে কথা বলেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের নিরিখে। অর্থাৎ, কিভাবে আমরা শুরু করতে পারি নতুন উদ্যমে, নতুন আঙ্গিকে এবং নতুন চিন্তার পরিপ্রেক্ষিতে— হতে পারে তা অর্থনীতি, সংস্কৃতি কিংবা শিক্ষানীতি। গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রবন্ধের আলাপ এখানে করতে চাই, যেন পাঠক যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশে এই সংকলনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন।

সর্বপ্রথম প্রবন্ধটি ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের 'বাঙলা দেশ: সংস্কৃতি ও সভ্যতার লক্ষ্য'। শুরুতেই তিনি লিখেছেন, "পুরনো—অতি পুরনো হলেও, বাঙলা আজ এক নতুন দেশ। নতুন রাষ্ট্র।" এই নতুন রাষ্ট্রে নাগরিকদের জাতীয়তার পাশাপাশি নৃতাত্ত্বিক পরিচয় কী হবে তা নিয়ে তিনি জরুরী আলাপ করেছেন এবং আমাদের পরিচয় চিহ্নিত করেছেন এভাবে:

"১। ভূগোল, ভাষা ও মানবগোষ্ঠীতে আমরা বাঙালী।
২। রাষ্ট্রীয় জাতীয়তায় আমরা বাঙলাদেশী বাঙালী।
৩। ধর্মে আমরা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান বাঙালী।"

এভাবে তিনটি ধাপে আমাদের প্রাথমিক পরিচয় চিহ্নিত করার পর তিনি হাজির করেছেন জরুরী নির্দেশনা: "আমাদের এই যে পরিচয়, এর কোনটি আগে, আর কোনটি পরে, কোনটি প্রধান আর কোনটিই বা অপ্রধান—এ জাতীয় প্রশ্ন এখানে একান্তই অবান্তর। কেননা, এর সব কয়টি বৈশিষ্ট্য একসাথে মিলে মিশে আমরা আমরাই, আর কেউ ন‌ই।" বাস্তবতা হলো, স্বাধীনতার জন্মলগ্নে এনামুল হক যে প্রশ্নকে 'অবান্তর' বলেছেন আজ ৫২ বছর পর‌ও এই 'অবান্তর' প্রশ্ন নিয়ে আমাদের মধ্যে বড় ধরনের কুতর্ক তৈরি হয় এবং ফল হিসেবে পাওয়া যায় নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ। স্বাধীনতার জন্মলগ্নে ঘোষিত 'অবান্তর' প্রশ্নের মধ্যে অর্ধশতাধিক বছর ধরে ঘুরপাক খাওয়া থেকে বোঝা যায়, মানসিকভাবে আসলে আমরা এগিয়েছি না পিছিয়েছি।

দ্বিতীয় প্রবন্ধটি ফরহাদ মজহারের। তিনি মূলত তিনটি 'সমস্যা সমাধানের জন্য বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের আত্মোৎসর্গের সমান অমানুষিক পরিশ্রমের' কামনা করেছেন। বিষয় তিনটি হলো— ১. নৃতাত্ত্বিক, ভৌগলিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে আমাদের আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান চালানো। ২. বিজ্ঞানজাত মানসিকতা ও সুস্থ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হবার চেষ্টা। ৩. আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সাংগঠনিক আমূল পরিবর্তন করা এবং যে শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানবিক সত্ত্বা গড়ে উঠবে এবং সমাজে তার প্রতিফলন ঘটবে সেই শিক্ষার বন্দোবস্ত করা। বিশেষত শিক্ষানীতির প্রসঙ্গে যদি বলি, প্রাবন্ধিক স্বাধীনতার জন্মলগ্নে শিক্ষানীতির যে যৌক্তিক দাবিটি তুলে ধরেছেন তা আজ ৫২ বছর পর‌ও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এর ফলে বছরের পর বছর বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে এবং হতাশাগ্রস্থ যুবকদের আত্মহত্যার খবর প্রায় প্রতিদিনই পড়তে হচ্ছে খবরের কাগজে।

শিক্ষানীতি নিয়ে ঘুরেফিরে আলোচনা এসেছে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আলোচনা করেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষা কিভাবে ব্যবহার হবে তার উপর। তাঁর প্রস্তাব ছিল, ইংরেজিকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে একটি বিষয়ে আমাদেরকে বিশেষভাবে সজাগ থাকতে হবে, সেটি হল উদ্দেশ্য। ইংরেজি শিখব নকলের নয়, সৃজনের উদ্দেশ্যে। অনুকরণের জন্য নয়, আবিষ্কারের জন্য। এই প্রস্তাবের ৫২ বছর পর নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আমরা এখন ইংরেজি শিখি সৃজনের উদ্দেশ্যে নয়, নকলের উদ্দেশ্যে ; আবিষ্কারের জন্য নয়, অনুকরণের জন্য। শিক্ষাব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি সংস্কারের জন্য ১৯৭১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সম্মেলনে দশটি দাবী উত্থাপন হয়েছিল।

এই দশটি দাবী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন আহসানুল হক। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাংগঠনিক ইতিহাস নিরূপণে এই প্রবন্ধটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞানের যথার্থ অন্তর্ভুক্তি স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য কতটা জরুরী তা ফুটে উঠেছে ডক্টর হিরন্ময় সেনগুপ্ত ও অজয় রায়ের প্রবন্ধে। বলা যায়, সম্পাদকদ্বয় আক্ষরিক অর্থেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, একটি জাতিরাষ্ট্র মজবুত বুনিয়াদের উপর দাঁড়াতে শিক্ষাব্যবস্থা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের উক্ত অনুধাবনের ফলেই আমরা পেয়েছি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এমন চমৎকার কিছু প্রবন্ধ, প্রস্তাব, পরামর্শ যা আজ অর্ধশতাধিক বছর পর‌ও আমাদেরকে পথ দেখাতে পারে।

সাংস্কৃতিক দিক থেকে জরুরী প্রবন্ধ ছিল আহমদ ছফার। তিনি লিখেছেন পশ্চিম বাংলার সাথে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক লেনদেনের সম্পর্ক নিয়ে। সবেমাত্র পশ্চিম বাংলা থেকে বাংলাদেশে ফেরত আসা একজন লেখক হিসেবে এমন সেনসিটিভ বিষয়কে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে দেখা যে কতটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার তা বলাই বাহুল্য। তিনি সে সময়েই বলতে পেরেছিলেন, "জাতীয় আশা আকাঙ্ক্ষার নিরিখে বিচার করলে দেখা যাবে বাঙলাদেশের মানুষ ভাবে বাঙালী হিসেবে এবং পশ্চিম বাঙলার জনগণকে ভারতবাসী হিসেবে ভাবতে হয়।" অর্থাৎ, তখন‌ই তিনি কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে যে রাষ্ট্রীয় দূরত্ব ও স্বতন্ত্রতা আছে তাকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন।

এই রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্রতা রক্ষার স্বার্থে তিনি এই প্রবন্ধে বলেছিলেন, 'পশ্চিম বাঙলার পত্রপত্রিকা অবাধে আসতে থাকলে এদেশে নূতন সাময়িক পত্রিকার প্রকাশ নানা কারণে ব্যাহত হবে। আমাদের নূতন রাষ্ট্রের যা দাবী গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি তা আমাদেরকে এই দেশেই সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের যা প্রয়োজন পশ্চিম বঙ্গ দিতে পারে না—পশ্চিম বঙ্গের সে ক্ষমতা নেই।' অর্থাৎ, নতুন রাষ্ট্রে অন্য সবকিছুর মতো সাংস্কৃতিকভাবেও নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলেছিলেন ছফা, সেখানে পশ্চিম বঙ্গ যেন আমাদের নির্ভরতার জায়গায় পরিণত না হয়। স্বাধীনতার জন্মলগ্নে উচ্চারিত এই সাংস্কৃতিক সতর্কবার্তা কতটা জরুরী ছিল তা আজ হারে হারে টের পাচ্ছি।

বলা অসঙ্গত হবে না যে, স্বাধীন কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে এ সংকলন অবতীর্ণ হয়েছিল দিকনির্দেশকের ভূমিকায়। সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি— সকল বিষয়েই ছিল পাকিস্তান আমলের খতিয়ান থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন রাষ্ট্রে নতুনভাবে চিন্তা করার আহ্বান। স্বাধীনতার জন্মলগ্নে এমন একটি সংকলন কতটা জরুরী ছিল তা একমাত্র নীতিনির্ধারকরাই বুঝতে পারবেন ভালোভাবে। মোদ্দাকথা হলো, সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর আমরা যেন সুন্দর, বাসোপযোগী একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে পারি তা নিয়ে সে সময়ের বুদ্ধিজীবীগণ কতটা চিন্তা করতেন তার সাক্ষী হিসেবে হাজির করা যেতে পারে এই সংকলনকে। 

Comments

The Daily Star  | English
rooppur-nuclear-power-plant

Gridline woes delay Rooppur Power Plant launch

The issue was highlighted during an International Atomic Energy Agency (IAEA) inspection in March

4h ago