‘কোথাও রয়েছে পড়ে শীত পিছে, আশ্বাসের কাছে তারা আসিয়াছে’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ট্রান্সপোর্ট লেকে অসময়ের অতিথি পাতি সরালি। ছবি: ঔরিত্র সাত্তার

রুক্ষ শীত বিদায় নিয়েছে বেশ আগেই। এখন 'সৌরভের শিখা জাগা' এ বসন্তে সবুজঘেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাহারি সব ফুলের চেনা চমকের পাশাপাশি 'অসময়ে' নতুন চমক হয়ে উড়ে এসেছে ঝাঁক ঝাঁক পাতি সরালি।

শীত মৌসুম ছাড়াও বছরের অন্যান্য সময়ে জাহাঙ্গীরনগরে পাতি সরালির আগমনের বিষয়টি এমনিতে স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু এটি চমক হয়ে উঠেছে এই কারণে যে, গত ছয় বছর ধরে ক্যাম্পাসের লেকগুলোতে বর্জ্যের আধিক্য ও পাতি সরালির প্রধান খাদ্য ডাকউইড প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। যে কারণে শীতে অন্যান্য পরিযায়ী পাখির পাশাপাশি পাতি সরালির আনাগোনাও নেমে এসেছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়।

কিন্তু চলতি বছরে ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের ট্রান্সপোর্ট লেকের পরিবেশ পুনরুদ্ধারের একটি প্রকল্প হাতে নেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা ডাকউইড ছেড়ে দেন লেকে। এতে খাবারের সংস্থানসহ দ্রুত লেকের পরিবেশ আবার পাখির জন্য উপযোগী হয়ে ওঠে। পাখিরা পেয়ে যায় ফিরে আসার আশ্বাস।

সরালির ফিরে আসার এ ঘটনা মনে করিয়ে দেয় জীবনানন্দ দাসের 'পাখিরা' কবিতার কয়েকটি লাইন—'কোথাও জীবন আছে—জীবনের স্বাদ রহিয়াছে,/কোথাও নদীর জল রয়ে গেছে—সাগরের তিতা ফেনা নয়,/খেলার বলের মতো তাদের হৃদয়/এই জানিয়াছে—/কোথাও রয়েছে পড়ে শীত পিছে, আশ্বাসের কাছে/তারা আসিয়াছে।'

পাখিদের বসার সুবিধার জন্য লেকের ওপর বসানো হয়েছে মাচা। ছবি: ঔরিত্র সাত্তার

পাতি সরালি দেশের সুলভ আবাসিক পাখি। তবে শীতে অনেক পরিযায়ী পাতি সরালি এদেশে আসে। এটি ছোট সরালি বা গেছো হাঁস নামেও পরিচিতি। এটি নিশাচর স্বভাবের পাখি। দিনে জলমগ্ন ধানখেত ও জলাশয়ের আশপাশে দল বেঁধে থাকে। রাতে খাবারের সন্ধানে চরে বেড়ায়।

এদের প্রধান খাবার জলজ গুল্ম, নতুন কুঁড়ি, শস্যদানা, ছোট মাছ, ব্যাঙ, শামুক, কেঁচো ইত্যাদি। এরা মূলত জুটি বেঁধে দুর্গম বিল-হাওরে বসবাস করে। তাই শীত ছাড়া এদের একত্রে তেমন একটা দেখা যায় না।

জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী ও আবাসিক বাসিন্দারা বলছেন, গত ছয় বছর ধরে শীত শেষের আগেই বেশিরভাগ পাতি সরালি উধাও হয়ে যাচ্ছিল। এই শীতে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে। গত বছরের নভেম্বরের শুরুর দিকে প্রথমবারের মতো আল-বেরুনি এক্সটেনশন লেকে তাদের দেখা মিললেও, অনেক হাঁস ডিসেম্বরের আগেই চলে যায়। আর ট্রান্সপোর্ট লেকে এদের দেখাই যায়নি।

কিন্তু এ বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে এই চিত্র পাল্টে যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে শুরু করে সরালিরা।

ছবি: ঔরিত্র সাত্তার

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের সঙ্গে। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'লেকে বর্জ্যের আধিক্য এবং হাঁসের প্রধান খাদ্য ডাকউইড (duckweed) বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে গিয়েছিল। এর ফলে ট্রান্সপোর্ট লেকটি তাদের জন্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।'

এই সংকট মোকাবিলায় ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে অধ্যাপক জামাল উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ট্রান্সপোর্ট লেকের পরিবেশ পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করার কথা জানান একই বিভাগের শিক্ষার্থী ঔরিত্র সাত্তার। বলেন, 'প্রকল্পের আওতায় শুরুতেই বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাকউইড ট্রান্সপোর্ট লেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ডাকউইড দ্রুত বর্ধনশীল, ফলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই লেকটি আবার সমৃদ্ধ খাদ্যভাণ্ডারে পরিণত হয়।'

ঔরিত্র আরও বলেন, 'এটি (ডাকউইড) শুধু পরিযায়ী পাখির খাদ্য নয়, বরং প্রাকৃতিক ফিল্টার হিসেবেও কাজ করে। এটি অ্যামোনিয়াম, নাইট্রেট ও ফসফরাসের মতো দূষক শোষণ করে, যা জলদূষণ ও ইউট্রোফিকেশন ঘটায়। এসব দূষণকারী উপাদান কমে যাওয়ায় লেকটি আবার পাতি সরালিসহ পরিযায়ী পাখিদের বসবাসের উপযোগী হয়ে ওঠে।'

ডাকউইড ছড়ানোর পর লেকের পরিবেশগত ভারসাম্য ফিরে আসার প্রমাণও মেলে দ্রুত। গত ৬ মার্চ গবেষক ও সংশ্লিষ্টরা পয়েন্ট কাউন্টিং পদ্ধতিতে ট্রান্সপোর্ট লেকে ২৮০টির মতো পাতি সরালির উপস্থিতি রেকর্ড করেন। পরের কয়েকদিনে এই সংখ্যা সাড়ে তিনশতে পৌঁছায়।

গবেষকরা আরও দেখতে পান, হাঁসগুলো মূলত ডাকউইড ও শাপলা সমৃদ্ধ অঞ্চলে জড়ো হয়েছে। কিছু সরালি আশ্রয় নিয়েছে আগে থেকেই পেতে রাখা বাঁশের মাচায়।

ঔরিত্র সাত্তারের ভাষ্য, এই সাফল্য প্রমাণ করে যে পরিকল্পিত পরিবেশগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোকে পরিযায়ী পাখিদের জন্য আবারও নিরাপদ আশ্রয়ে রূপান্তর করা সম্ভব। এক্ষেত্রে  বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন ও সংশ্লিষ্টরা একসঙ্গে কাজ করলে আগামী বছরগুলোতে ট্রান্সপোর্ট লেকসহ আশপাশের জলাভূমিতে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা আরও বাড়বে।

Comments

The Daily Star  | English
Janata Bank’s bad loans taken by seven firms

Janata Bank reports massive Tk 3,066cr loss in 2024

The bank’s net interest loss amounted to Tk 3,042 crore last year

55m ago