গুড় কি চিনির চেয়ে ভালো?

গুড় নাকি চিনি
ছবি: সংগৃহীত

চিনি শরীরের জন্য ক্ষতিকর সবার জানা। তাই অনেকে খাবারে চিনির পরিবর্তে গুড় ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু গুড় কি আসলেই চিনির চেয়ে ভালো? 

এ বিষয়ে জেনে নিন ইউএস বাংলা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে পুষ্টিবিদ মাহফুজা নাসরিন শম্পার কাছ থেকে।

মাহফুজা নাসরিন শম্পা বলেন, গুড় ও চিনি দুটিই সাধারণত আখ বা খেজুরের রস থেকে তৈরি হয়। তবে প্রক্রিয়াজাতকরণের পার্থক্যের কারণে এদের পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্যগত প্রভাব ভিন্ন হয়ে থাকে। গুড় প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয় এবং এতে কিছু ভিটামিন ও খনিজ উপাদান থাকে, যা পরিশোধিত চিনিতে অনুপস্থিত। অন্যদিকে, চিনি বেশি মাত্রায় প্রক্রিয়াজাতকরণের ফলে কেবল সুগার (সুক্রোজ) ধারণ করে, যা নিয়মিত গ্রহণ করলে শরীরের বিভিন্ন ক্ষতি হয়।

গুড় ও চিনির পার্থক্য বুঝতে হলে এটি তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে হবে।

গুড় তৈরির পদ্ধতি

গুড় সাধারণত আখ বা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে ঘন করে তৈরি করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় কোনো রাসায়নিক সংযোজন করা হয় না এবং এতে থাকা খনিজ ও ভিটামিনগুলো প্রায় অপরিবর্তিত থাকে।

চিনি তৈরির পদ্ধতি

চিনি মূলত আখের রস থেকে তৈরি হয়। তবে এটি অধিক পরিশোধিত ও রাসায়নিকভাবে পরিমার্জিত। চিনির প্রক্রিয়াজাতকরণে সালফার ডাইঅক্সাইড, ফসফরিক অ্যাসিড ও ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইড ব্যবহার করা হয়, যা চিনিকে সাদা ও পরিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে। কিন্তু এতে থাকা প্রাকৃতিক খনিজ উপাদান নষ্ট হয়ে যায়।

পুষ্টিগুণের তুলনা

১. গুড়ে চিনির তুলনায় বেশি খনিজ ও ভিটামিন থাকে। যেমন আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাসিয়াম।

২. গুড় রক্তস্বল্পতা (অ্যানিমিয়া) প্রতিরোধে সহায়ক। কারণ এতে উচ্চমাত্রার আয়রন থাকে।

৩. গুড়ের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) চিনির তুলনায় কম। ফলে এটি রক্তে শর্করার পরিমাণ ধীরে বাড়ায়, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য তুলনামূলকভাবে ভালো হতে পারে।

৪. চিনি শুধু ফাঁকা ক্যালরি সরবরাহ করে। এতে কোনো ভিটামিন বা খনিজ উপাদান নেই।

১০০ গ্রাম গুড় ও চিনির যেসব পুষ্টি উপাদান রয়েছে তা হলো-

গুড়

ক্যালরি: প্রায় ৩৮৩ ক্যালোরি

সুক্রোজ: প্রায় ৭০ গ্রাম

ফ্রুক্টোজ: প্রায় ১০ গ্রাম

প্রোটিন: ০.৪ গ্রাম

চর্বি: ০.১ গ্রাম

আয়রন: ১১ মিলিগ্রাম

ম্যাগনেসিয়াম: ৭০-৯০ মিলিগ্রাম

পটাসিয়াম: ১.৫৬ মিলিগ্রাম

ম্যাঙ্গানিজ: ০.২-০.৫ মিলিগ্রাম

ভিটামিন: ভিটামিন এ, সি, ই

চিনি

ক্যালরি: প্রায় ৩৯৭ ক্যালরি

সুক্রোজ: প্রায় ৯৯ গ্রাম

প্রোটিন, চর্বি ও খনিজ: উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নেই

গুড়ের স্বাস্থ্য উপকারিতা

হজম সহায়ক

গুড় প্রাকৃতিকভাবে পাচক এনজাইম সক্রিয় করে, যা হজম শক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে। ভারি খাবার খাওয়ার পর গুড় খেলে এটি অন্ত্রের গতিশীলতা বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সহায়তা করে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি

গুড়ে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও মিনারেল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এটি ঠান্ডা-কাশির বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারে।

রক্ত বিশুদ্ধকরণ

গুড় রক্ত পরিশোধন করতে সাহায্য করে এবং নিয়মিত খেলে ত্বক পরিষ্কার ও দীপ্তিময় হয়।

ডিটক্সিফাইং এজেন্ট

গুড় লিভারকে ডিটক্স করতে সহায়তা করে। বিশেষ করে এটি শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে।

আয়রনের ভালো উৎস

গুড় রক্তস্বল্পতা প্রতিরোধে সাহায্য করে। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে, যা রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ায়।

হাড় শক্তিশালী করে

গুড়ে থাকা ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

চিনির ক্ষতিকর দিক

ওজন বৃদ্ধি: অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ করলে এটি ফ্যাটে রূপান্তরিত হয়, যা ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।

ডায়াবেটিসের ঝুঁকি: চিনি দ্রুত রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা ইনসুলিন প্রতিরোধের কারণ হতে পারে।

দাঁতের ক্ষতি: চিনি ব্যাকটেরিয়ার জন্য উৎকৃষ্ট খাবার, যা দাঁতের ক্ষয় ও ক্যাভিটি তৈরি করে।

হার্টের সমস্যা: অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ করলে এটি উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

লিভারের ওপর চাপ: চিনি বেশি পরিমাণে খেলে এটি ফ্যাটি লিভার ডিজিজের কারণ হতে পারে।

তাহলে কোনটি স্বাস্থ্যসম্মত?

গুড় চিনির তুলনায় স্বাস্থ্যসম্মত। কারণ এতে খনিজ উপাদান বেশি থাকে, এটি হজম ভালো করে, আয়রনের ভালো উৎস এবং শরীর ডিটক্স করতে সাহায্য করে। তবে গুড় হতে হবে ভেজালমুক্ত। বর্তমানে গুড় তৈরিতে চিনি বা কেমিক্যাল মেশানো হয়। এ ধরনের গুড় শরীরের জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে, চিনি সম্পূর্ণ পরিশোধিত এবং এটি শরীরের জন্য কোনো অতিরিক্ত পুষ্টিগুণ সরবরাহ করে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।

যদি বিকল্প বেছে নিতে হয়, তবে গুড়ই ভালো। কিন্তু অবশ্যই পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মনে রাখবেন, অতিরিক্ত গুড়ও শরীরের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অতিরিক্ত গুড় খাওয়া উচিত নয়। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য পরিশোধিত চিনির পরিমাণ কমিয়ে গুড় বা অন্যান্য প্রাকৃতিক মিষ্টি উপাদান ব্যবহার করাই ভালো সিদ্ধান্ত।

 

Comments

The Daily Star  | English
chief adviser yunus confirms election date

Election in February

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus last night announced that the general election will be held before Ramadan in February 2026, kickstarting the process of handing over the power to an elected government.

6h ago