শত বছরে জসীম উদ্দীনের 'কবর'

বহুমাত্রিক সৃজনশীল ব্যক্তি জসীম উদ্দীন। তাঁর ব্যক্তিত্বে ফুটে উঠেছিল প্রকৃতির মতোই সহজ-সরল-নিপাট স্নিগ্ধতা। পল্লির উপাদান ব্যবহারে তিনি ছিলেন যথার্থই একজন আধুনিক কবি। আমাদের বাঙালি সত্তার একজন সত্যিকার মহৎ কবি হিসেবেই তিনি বরণীয়। ঐতিহ্যবাহী বাংলা কবিতার মূল ধারাটিকে নগর সভায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব জসীম উদ্দীনের।
'কবর' কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে কবি জসীম উদ্দীনের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। অগণিত পাঠকের হৃদয়জয়ী এ কবিতাটি শতবর্ষে পদার্পণ করেছে। ১৯২৫ সালে 'কবর' কবিতাটি প্রথম কল্লোল পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। 'কবর' কবিতাটি প্রকাশিত হলে যাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, তাঁদের মধ্যে ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জসীম উদ্দীন 'প্রথম যখন বাংলাদেশ ও গ্রাম্য বিষয়বস্তু নিয়ে আরম্ভ করেন, তখন অতি আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টির উল্লাসমত্ততা, ছিমছাম নাগরিক জীবন, এলিয়ট ও এজরা পাউন্ডের মতো লিখতে চায় এমন নতুন কবির দল- এ সব কিছুই তাঁর মনে তাঁর নিজের সম্বন্ধে দারুণ সন্দেহ এনে দেয়। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলা থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আশ্বস্ত করেন' (আল মাহমুদ)।
কবি সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিএ ক্লাসের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তাঁর এ কবিতাটি প্রবেশিকা বাংলা সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়। কবি হিসেবে এটি তাঁর এক অসামান্য সাফল্য। ছাত্রাবস্থায় কবিতাটি পাঠ্যপুস্তকে স্থান পাওয়ায় ব্যাপক আলোচনার সূত্রপাত হয়। জসীমউদ্দীন কবি খ্যাতির শীর্ষে ওঠে যান। আনিসুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, 'বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে জসীম উদ্দীনের আত্মপ্রকাশ বলা যায় ১৯২৫ সালে, কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত 'কবর' কবিতা দিয়ে।
আমরা জানি, ১৯২৩ সালে কল্লোলের প্রতিষ্ঠা ঘটে।... কল্লোলের দ্বিতীয় বর্ষে পরপর দু সংখ্যায় তাঁর দুটি কবিতা প্রকাশ পায়, তবে তা পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। কিন্তু ওই পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় 'গ্রাম্য কবিতা' পরিচয়ে মুদ্রিত 'কবর' প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। কী ছিল সেই কবিতায় যাতে তা কল্লোলে স্থান পায় এবং অচিরেই তাঁর ছাত্রাবস্থায়ই অন্তর্ভুক্ত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্যে পাঠ্য বাংলা সাহিত্যসংকলনে?' এর উত্তর- 'কবর' কবিতা কল্লোল পত্রিকায় ছাপা হলে সেটা পড়ে দীনেশচন্দ্র সেন 'অ্যান ইয়াং মোহামেডান পোয়েট' শিরোনামে একটি আলোচনা লিখেছিলেন ফরওয়ার্ড পত্রিকায়; সেখানে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আরও এক জায়গায় আমরা এর উত্তর খুঁজে পাব- জসীম উদ্দীন তাঁর আত্মস্মৃতিতে বর্ণনা করেছেন, দীনেশচন্দ্র সেন একদিন এমএ ক্লাসের সাহিত্যের বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'জসীম উদ্দীনের মতো কবির শিক্ষক হতে পারা তাঁর জন্যে বড় গৌরবের বিষয়। শেলি, কিট্স, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ- বিশ্বসাহিত্যের এই মহারথীদের কবিতার চেয়েও জসীম উদ্দীনের কবিতা তাঁকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল' (জসীম উদ্দীন ২০০০)।
'কবর' জসীম উদ্দীন বিরচিত বাংলা সাহিত্যের একটি বহুল পঠিত কবিতা। এটি মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত। কবিতাটি কবির রাখালী কাব্যে স্থান পেয়েছে। এ ধরনের কবিতাকে বলা হয় ড্রামাটিক মনোলগ বা একাকী কথন। একজন গ্রামীণ বৃদ্ধের একে একে সকল প্রিয়জন হারানোর বেদনা কবি জসীম উদ্দীন দক্ষ বর্ণনায় ফুটিয়ে তুলেছেন। দীর্ঘ এ কবিতার চরণ সংখ্যা ১১৮। কবিতাটি ঊষবমু বা শোক কবিতা। বাঙালির প্রাণের আবেগ অতি নিবিড়ভাবে মিশে আছে এ শোক-প্রকাশক কবিতাটির পঙক্তিতে পঙক্তিতে।
বাংলা সাহিত্যে যেসব মর্মস্পর্শী কবিতা আছে, তার মধ্যে কবর একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। কবিতাটিতে শুধু প্রিয়জনদের জন্য শোকই নয়, বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের গাঢ় বেদনা আর ভালবাসার রঙে আঁকা পল্লীজীবনের অসাধারণ ছবি অঙ্কিত হয়েছে। জীবনের ক্ষণিক আলো আর ভালোবাসার অপূর্ণতা এমন গভীরভাবে তুলে ধরলে, শব্দগুলো কেবল কবিতা নয়, মনে হয় যেন আত্মার আর্তনাদ। মৃত্যু আর শূন্যতার এই মিশ্রণে ভালোবাসার আবেদন যেন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। এমন লেখা হৃদয়ে এক অমোচনীয় ছাপ রেখে যায়। কবিতাটির প্রথম স্তবক এরকম :
এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে,
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
কবিতাটিতে কাহিনী বর্ণনাকারী এক গ্রামীণ বৃদ্ধ দাদু। আর শ্রোতা হলো তাঁর নাতি। নাতিকে উদ্দেশ্য করে বৃদ্ধ দাদু তাঁর জীবনের সকল প্রিয়জনকে হারানোর আকুতি ক্রমে ক্রমে ব্যক্ত করেছেন। যে পাঁচজন স্বজন হারানোর ব্যথা বৃদ্ধ দাদু এক এক করে বর্ণনা করেছেন তারা হলেন : বৃদ্ধের স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, নাতনী ও মেয়ে। এরা নাতির দাদী, পিতা, মাতা, বোন ও ছোট ফুপু। বৃদ্ধের কাছে মনে হয় জীবনের নির্মম পথ তিনি আর চলতে পারছেন না।
কবিতার শেষ স্তবকে তিনি নাতিকে বলছেন: 'ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে,/ অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে'। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত এ কবিতাতে সৃষ্ট হয়েছে বিষাদকরুণ সাঙ্গেতিকতা। তিরিশের দশকে যখন ইউরোপীয় আধুনিক কাব্যের আদলে বাংলা কাব্যে আধুনিক কবিতার সূত্রপাত হয় একই সময়ে জসীম উদ্দীন রচনা করেছিলেন 'কবর'। 'কবর' কবিতায় ব্যবহৃত ছন্দকে বলা হয় ষান্মাত্রিক মাত্রাবৃত্ত। এ কবিতার প্রতি চরণে ৩টি পূর্ণ পর্ব ও ১টি অপূর্ণ পর্ব আছে। পূর্ণ পর্বের মাত্রা ৬ ও অপূর্ণ পর্বের মাত্রা ২। মাত্রা বিন্যাস ৬+৬+৬+২=২০।

জসীম উদ্দীনের জন্ম ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে। এটি ছিল তাঁর নানার বাড়ি। নিজের বাড়ি ছিল গোবিন্দপুর গ্রামে। বাবা আনসার উদ্দীন মোল্লা এবং মা আমিনা খাতুন ওরফে রাঙাছুট। পাঁচ সন্তানের মধ্যে জসীম উদ্দীন ছিলেন চতুর্থ। তাঁদের পরিবারকে কৃষিজীবীই বলা যেতে পারে। যদিও তাঁর পিতা ছিলেন ফরিদপুর হিতৈষী এমই স্কুলের শিক্ষক। কবি যে ঘরে থাকতেন সে বাড়ির সামনে সিঁড়ি, সিঁড়ির দু'দিকে লেবু গাছ, মাঝখানে ডালিম গাছ। এই জায়গাটিই তাঁর 'কবর' কবিতার সৃষ্টির উৎসভূমি। জসীম উদ্দীনের কবি প্রতিভা বিকশিত হয় শৈশবেই।
তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ নকশীকাঁথার মাঠ কাব্যে এক পল্লীকিশোরীর বেদনা-মধুর প্রেম কাহিনীর অপূর্ব কাব্যিক রূপ প্রকাশ পেয়েছে। এ গ্রন্থটি মিসেস ই.এম. মিলফোর্ড দি ফিল্ড অব এমব্রয়ডার্ড কুইল্ট নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এছাড়াও বাঙালীর হাসির গল্প গ্রন্থটি ফোক টেল্স অব ইষ্ট পাকিস্তান নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। গ্রন্থদুটি জসীম উদ্দীনকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কবি করে তোলে। কবি জসীম উদ্দীন ছোটদের ভালোবাসতেন। ছেলেবেলায় শিশুতোষ রচনার ছন্দে যাঁরা শিশুদের মন কেড়েছিলেন, সেই মদনমোহন, রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের পাশাপাশি আরও একটি নাম আমাদের খুব মনে পড়ে, তিনি জসীমউদ্দীন।
কবি ছিলেন লোকসংস্কৃতির একান্ত অনুরাগী। তাঁর কবিতা ও গানে এই অনুরাগের ছোঁয়া আছে স্পষ্টই। একসময়ে তাঁর গুরু ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনের কল্যাণে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে গীতিকা-সংগ্রাহকের দায়িত্ব পান। পাশাপাশি তিনি বাউল-মুর্শিদি-জারি-রাখালি এইসব লোকগান সংগ্রহেও মন দেন। অবশ্য এই লোকগান সংগ্রহ ছিল তাঁর নিজেরই আগ্রহ ও প্রয়োজনে। পরে তিনি এই সংগ্রহ নিয়ে বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর মুর্শিদি গানের আলোচনা প্রকাশিত হয় 'কল্লোল' পত্রিকায়। পরে বই আকারে বের হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপিকা গরংং. অ. এ. ঝঃড়পশ সম্ভবত কবির অনুরোধেই বিদেশিদের জন্য তাঁর ওপরে Jasim uddin, Poet of the Bangladesh countryside' নামে এই পুস্তিকাটি রচনা করেন ইংরেজিতে। কবি জসীমউদ্দীনের জীবন ও সাহিত্যের পরিচিতির চুম্বক এই পুস্তিকাটি। এই সংক্ষিপ্ত অথচ মূল্যবান পুস্তিকাটির কোনো উল্লেখ কোথাও এখন আর তেমন চোখে পড়ে না।
জসীম উদ্দীনের পূর্বজ ও সমসাময়িক কবিদের মধ্যে আরো অনেকেই পল্লীর জীবন ও প্রকৃতিকে তাঁদের কাব্য-কবিতার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এঁদের মধ্যে করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭৭-১৯৫৫), যতীন্দ্রমোহন বাগচী (১৮৭৮-১৯৪৮), কুমুদরঞ্জন মল্লিক (১৮৮৩-১৯৭০), কালিদাস রায় (১৮৮৯-১৯৭৫), সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৬৫), বন্দে আলী মিয়া (১৯০৬-১৯৭৯) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এঁদের কেউই পল্লীর জীবন ও প্রকৃতির রূপায়ণে জসীম উদ্দীনের সমকক্ষতা অর্জন করতে পারেননি। এঁদের কবিতায় বিধৃত গ্রামীণ প্রকৃতি ও জীবনের চিত্র অনেকটাই দূর থেকে দেখা ছবির মতো। শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে পাওয়া গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতিকে নাগরিক কোলাহলমুক্ত থাকার প্রয়াসে স্বতন্ত্র পথযাত্রার অনুষঙ্গ হিসেবে তাঁরা তাঁদের কাব্যের জন্যে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু জসীম উদ্দীনের কবিতায় বিধৃত পল্লীর চিত্র তাঁর কাছ থেকে দেখা ছবি।
জসীম উদ্দীন ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী। ছিলেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা।
আহমদ শরীফ মনে করেন : 'জসীম উদ্দীন (উনি এভাবেই লিখেছেন) বাঙলা সাহিত্যের এক অনন্য কবি, ভাবে-ভাষায়-ভঙ্গিতে তাঁকে আপাত দৃষ্টিতে লোকগাথার উত্তর সাধক ও উত্তরসূরি বলে প্রতীয়মান হলেও অঙ্গে ও অন্তরে এর রূপ-রস যে ভিন্ন তা সব সূক্ষ্ম দৃষ্টির, মার্জিত রুচির এবং প্রচ্ছন্ন রূপের ও রসের সমঝদার নিপুণ পাঠক অনুভব ও উপলব্ধি করেন। এ জন্যেই কুমুদরঞ্জন মল্লিক, করুণানিধান কিংবা যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কালিদাস রায় প্রমুখের কবিস্বভাবের থেকে তাঁর স্বভাবের ও সৃষ্টির পার্থক্যও গুহায়িত থাকে না।...যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত দুঃখবাদী কবি বলে সাধারণ্যে পরিচিত, জসীম উদদীনও অবশ্যই শোষিত-বঞ্চিত আশাহত মানুষের দরদী কবি। দুঃখী পল্লী মানুষের চিত্র কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কালিদাস রায় এবং আরও কেউ কেউ অঙ্কিত করেছেন বটে, কিন্তু জসীম উদদীনের কবিতার সাথে ওদের কবিতার ভাব-ভাষা ভঙ্গিগত পার্থক্য সুপ্রকট। বাঙলাদেশে কোন কোন কবি জসীম উদদীনের অণুকরণে ও অনুসরণে অগ্রসর হতে গিয়েও তেমন সফল হননি।
এতেও তাঁর অননুকরণীয় অনন্যতাই প্রমাণিত।' তাই পল্লীজীবনের রূপায়ণে তিনি সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ও অকৃত্রিম। এই অকৃত্রিমতা তিনি তাঁর সমস্ত সাহিত্যসাধনায় আমৃত্যু ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কোনো ধরনের মোহ বা প্রলোভন কখনো তাঁকে তাঁর মৌল পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। এখানেই জসীম উদ্দীন অনন্য।
জসীম উদ্দীন ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী। ছিলেন তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। এরূপ মানসিকতার কারণেই ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার রেডিও ও টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধের উদ্যোগ নিলে অনেকের মতো তিনিও এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি বাঙালির জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলন (১৯৬৬) এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার একজন দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। তিনি পূর্ব বাংলার সাধারণ অশিক্ষিত মানুষের জীবন নিয়ে লিখেছেন। তাঁর লেখার মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সমানে ছিল। ছিল গ্রামীণ জীবন। সেই জীবন শুধু হিন্দুর বা মুসলমানের নয়। লক্ষ করলে দেখা যাবে, জসীমউদ্দীনের নক্সী কাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থের পেছনে লেখা আছে 'দুইটি গ্রাম্য ছেলেমেয়ের ভালবাসার কাহিনী'।
তিনি দুটি মুসলমান গ্রাম্য ছেলেমেয়ের ভালোবাসার কাহিনি কথাটি লেখেননি। কারণ, সৃজনশীল জসীমউদ্দীন তাঁর যাপনে, সংস্কৃতিভাবনায় ও সৃজনকর্মে ধর্মের ভিত্তিতে এই ধরনের বিভাজন কখনো বোধ করেননি। তাঁর নির্জ্ঞান মনোজগৎও অন্য ধাতুতে গড়া ছিল, এ কথা বোধ করি অত্যুক্তি নয়। অগ্রজ কবি কালিদাস রায় এ প্রসঙ্গে বলেন, 'যতীন্দ্রমোহন ও কুমুদরঞ্জন বঙ্গের পল্লী প্রকৃতিকে দেখিয়াছেন হিন্দুর চোখে। শ্রীমান জসীম উদ্দীন বাঙালির চোখে দেখিয়াছেন অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমান উভয়ের দৃষ্টিতে দেখিয়াছেন।'
Comments