সূর্যাস্ত, মৃদু হাওয়া আর ইফতার: বুড়িগঙ্গার বুকে এক জাদুকরী সন্ধ্যা

বুড়িগঙ্গায় ইফতার

সেদিন আকাশটা ছিল নরম গোলাপি রঙের, বুড়িগঙ্গা পানির মৃদু ঢেউয়ের সঙ্গে যেন তা মিশে যাচ্ছিল। সেইসঙ্গে বয়ে যাচ্ছিল মৃদুমন্দ বাতাস, যা মনকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিচ্ছিল। ঠিক মাঝ নদীতে ভেসে থাকা নৌকায় বসে আমরা তখন ইফতারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এরই মধ্যে চারপাশের সৌন্দর্য দেখে বারবার মন হারিয়ে যাচ্ছিল। দূরের মসজিদ থেকে যখন মাগরিবের আযানের সুর ভেসে এল, সেই পবিত্র সুর যেন পুরো সন্ধ্যার বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল, যেন প্রতিধ্বনিত হলো গোধূলির আলোয়।

এটা এমন একটা সময় যখন আপনার মনে হবে সময় আরেকটু ধীর হয়ে যাক, এই চমৎকার অনুভূতি আরও কিছুক্ষণ চারপাশ ভরে রাখুক। এটা এমন একটা মুহূর্ত, যা আপনি আগে কখনও কল্পনা করেননি। আর এমন মুহূর্ত পেতে হলে চলে যেতে হবে ঢাকার সদরঘাটে, যেখানে পাওয়া এই মুহূর্ত আজীবন মনে গেঁথে থাকবে।

এই নিয়ে দ্বিতীয় দফায় বুড়িগঙ্গার বুকে ইফতার করলাম আমরা। ২০২৪ সালে যখন আয়োজন করেছিলাম তখনও দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল, কিন্তু সেসময় কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলাম। যার মধ্যে ছিল ঠিক মতো সময় ব্যবস্থাপনা করতে না পারা এবং মানসম্মত ইফতার নির্বাচন না করা। এবার তাই আমরা আরও ভালো প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম। দুই ঘনিষ্ঠ ছোটভাই রাসেল ও তরুণকে নিয়ে প্রথমে চলে গিয়েছিলাম চকবাজারে। এমনকি পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বসে যেন ইফতার করতে পারি তাই বাড়ি থেকে একটি বিছানার চাদরও নিয়ে গিয়েছিলাম আমি।

আগেরবার একটি বা দুটি দোকান থেকেই সব ইফতার কিনেছিলাম আমরা। কিন্তু এবার ঠিক করেছিলাম বিভিন্ন দোকানের খাবার চেখে দেখব এবং একেকটি আইটেম একেক জায়গা থেকে কিনব। সেজন্য ৩টা বাজতেই চকবাজারে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেসময় চকবাজারে এত ভিড় ছিল যে নড়াচড়াই কঠিন হয়ে পড়ছিল।

আমরা আতিক সুইটস অ্যান্ট কনফেকশনারি থেকে খাবার কেনার মিশন শুরু করি। সেখান থেকে আমরা কিনি পনির সমুচা, দই বড়া এবং কিমা চপ। এরপর চলে যাই পাশের বোম্বে কনফেকশনারিতে, যেখান থেকে কিনি চিকেন রোল এবং ডিমচপ। এরপর আনন্দ কনফেকশনারি থেকে কিনে নিই কাটলেট, রেশমি জিলাপি এবং বাদামের শরবত। চকবাজার শাহী মসজিদের সামনের বিভিন্ন নাম না জানা স্টল থেকে আমরা কিনি ইফতারের অত্যাবশ্যকীয় পিঁয়াজু, আলুর চপ আর বেগুনি।

বুড়িগঙ্গায় ইফতার

চকবাজার থেকে ফেরার পথে আমরা রাস্তার পাশের একটি ভ্যান থেকে একটা ছোট তরমুজ কিনলাম আর পাশের দোকান থেকে কিনলঅম এক বোতল লাবাং। এসব কিনতে কিনতে আমাদের ৫টা বেজে গিয়েছিল। ওই সময় সদরঘাটের ভিড় এড়াতে আমরা মিটফোর্ড ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা একটা রিকশায় চেপে ঘাটের দিকে এগোতেই দেখি সেখানে অপেক্ষমাণ মানুষের দীর্ঘ লাইন। বেশ খুঁজে একটি নৌকা ভাড়া করলাম, যার মালিক ৬৫ বছর বয়সী বারেক হাওলাদার।

নদী দূষণের কারণে বুড়িগঙ্গার বুকে ইফতার করার পরিকল্পনা অনেকের কাছেই অপ্রীতিকর মনে হতে পারে। শহরের উন্নয়নের প্রভাব সইতে গিয়ে বুড়িগঙ্গার পানি এখন কালো, সেখান থেকে বাজে গন্ধ ছড়ায়। তাই আমাদেরও কিছুটা সন্দেহ ছিল ইফতারের পরিকল্পনা নিয়ে। পরে একটা ছোট্ট উপায় খুঁজে পাই। আর সেটি হলো নৌকা নিয়ে বাবুবাজার ব্রিজ পেরিয়ে সদরঘাটের আগের একটি পয়েন্টে পৌঁছানো। যেখানে পানি তুলনামূলক পরিষ্কার এবং গন্ধও ততটা তীব্র নয়।

আমরা যে নৌকা ভাড়া করেছিলাম তার খরচ ছিল ঘণ্টা প্রতি ২০০ টাকা। দর কষাকষি করেই নিয়েছি, তবু ঈদের মৌসুম হওয়ার কারণে ভাড়া তুলনামূলক বেশিই পড়েছিল। নৌকায় ওঠার পর আমরা বারেক মামাকে নদীর পাড় থেকে দূরে নিয়ে যেতে বলেছিলাম। এর মধ্যে আমরা নৌকার পাটাতনে চাদর বিছিয়ে বসলাম। আর তার ওপর গুছিয়ে নিলাম আমাদের কিনে আনা সমস্ত ইফতার।

বুড়িগঙ্গায় ইফতার

আমরা খেয়াল করলাম যে, আশপাশের নৌকাগুলো খুব দ্রুত পাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তখনই বুঝে নিলাম যে মাগরিবের আযানের আর বেশি বাকি নেই। আমাদের কাছাকাছি মাত্র দুই-একটি নৌকা ছিল। আমরা নৌকাতেই ইফতারের আয়োজন করেছি দেখে পাশের নৌকার এক যাত্রী আমাদের বৃদ্ধাঙ্গুল উঁচিয়ে সাবাশি দিলেন এবং প্রশংসাসূচক হাসি দিলেন।

এরই মধ্যে আকাশটা নরম গোলাপি রঙে ভরে উঠল, নদীর ওপর দিয়ে বয়ে যেতে শুরু করল মৃদু বাতাস। মনে হচ্ছিল সময়টা এখানেই থেমে যাক। এমন সময় কাছের মসজিদ থেকে ভেসে এল মাগরিবের আযানের সুর। সঙ্গে সঙ্গে আমরা বারেক মামাকে নিয়ে ইফতার শুরু করলাম। চারপাশের দারুণ নীরবতা আমাদের ইফতারকে আরও বিশেষ করে তুলল।

ইফতার পর্ব শেষ হতেই আকাশ অন্ধকার হয়ে এল। মাথার ওপর বিশাল একটা চাঁদ আমাদের আলো দিচ্ছিল। আর দুই পাড়ের দোকানগুলোতে জ্বলে থাকা বাতির প্রতিফলন নদীতে পড়ার পর পুরো দৃশ্যটিকে অপার্থিব করে তুলেছিল।

বারেক মামা তার নিজের গল্প বলতে শুরু করলেন। জানা গেল, তিনি মূলত বরিশালের একজন কৃষক। ঈদকে সামনে রেখে কিছুটা বাড়তি উপার্জনের আশায় নৌকার মাঝি হিসেবে কাজ করতে কিছুদিনের জন্য ঢাকায় এসেছেন। তিনি গল্প বলে চললেন, আর আমরা নীরক নিঃস্তব্ধ নদীতে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা শুনতে লাগলাম।

সেদিনের পুরো অভিজ্ঞতাই আমাদের জন্য বিশেষ ছিল। শান্ত নদীর বুকে নৌকায় ঘুরে বেড়ানো, চমৎকার সূর্যাস্তের সাক্ষী হওয়া এবং একে অন্যের সঙ্গে ইফতার ভাগাভাগি করে খাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল অবিস্মরণীয়। মাঝ নদীতে আমরা যে শান্তি অনুভব করেছি, তা সারাজীবন মনের খুব গভীরে বিশেষ স্মৃতি হিসেবে তোলা থাকবে। 

ছবি: জাওয়াদ সামি নিয়োগি

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English

Tribute to July uprising: Drone show lights up Dhaka's sky

In 12 vivid motifs, the July uprising came alive, tracing the heroism of Abu Sayed and the stirring role of women in the movement

3h ago