প্রবাসে পহেলা বৈশাখ

প্রবাসে পহেলা বৈশাখ

বিদেশ-বিভূঁইয়ে নিজ বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় দিতে গিয়ে পহেলা বৈশাখের কথা বলিনি, এমনটা কখনো হয়নি। ভিনদেশের বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় বৈশাখের আমেজ, কলাভবন হয়ে চারুকলা এসব নিয়ে আলোচনা করিনি এমনটা কম হয়েছে।

আসলে নিজের দেশ আর সংস্কৃতির বিষয়গুলো আরও কাছের হয়ে উঠে যখন আমরা সম্পূর্ণ আরেক নতুন দেশ, সেখানকার সংস্কৃতিতে থাকি। আর যতই হোক, 'মাছে-ভাতে বাঙালি' তো! খেয়াল করে দেখেছি, সুদূর মার্কিন মুল্লুক কিংবা ইউরোপ, মহাসমুদ্র পেড়িয়ে যেখানেই আমরা পৌঁছাই না কেন, বাঙালির যেসব রীতিনীতি বা আমুদে অভ্যেস, সেগুলো বদলাবার নয়! তাই ভিনদেশে আছি বলে পহেলা বৈশাখে কোনো আয়োজন হবে না, তাই কি হয়!

তার ওপর সেবার বাংলাদেশি স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে আমরা নতুন কজন কমিটির সদস্য নির্বাচিত হলাম। এর আগে সাংস্কৃতিক আয়োজন হলেও, সেবারই প্রথম আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের নিমন্ত্রণ জানিয়ে পহেলা বৈশাখের আয়োজন করা হলো।

যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বৈশাখ উদযাপনের অভিজ্ঞতা কেমন, তাহলে বরাবরই আমার স্মৃতিতে চলে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সময়গুলোর কথা। কলাভবনের পেছনের গেট দিয়ে বেরুলেই তো চারুকলা, আর তার সামনে শাহবাগ। চারুকলায় যেতাম ওখানকার শিক্ষার্থীদের সপ্তাহজুড়ে পরিশ্রম, তাদের নানান আয়োজন দেখার জন্য। আর সব শেষে শাহবাগে যেতাম আমরা ফুল কিনতে, পরদিন বৈশাখের দিন পরব বলে। এরপর তো শিক্ষার্থী জীবন হিসেবে বৈশাখের অভিজ্ঞতা এই যুক্তরাষ্ট্রে। সারা বছর বৃষ্টি আর তুষারের লেক্সিংটন শহরে কোথায় কীসের বৈশাখ, চারুকলা আর বেলি ফুল! কিন্তু তারপরেও যে একটাবার আমরা বৈশাখের আয়োজন করলাম, সেটাও আমার অভিজ্ঞতায় অন্যতম একটি বৈশাখ উদযাপন।

আমরা গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীরা সারাদিন ক্লাস, ল্যাব, বাজার-রান্না শেষে নিজেদের সময় দিয়ে দু-তিন সপ্তাহ এই অনুষ্ঠানের জন্য কাজ করেছি। আমরা যারা মঞ্চের পেছনে এবং সামনে কাজ করেছি অর্থাৎ আয়োজক এবং পাশাপাশি পারফর্মার ছিলাম, তাদের চিন্তা এবং কাজ স্বাভাবিকভাবে কিছুটা বেশিই ছিল। সবার একসঙ্গে বসে সপ্তাহান্তে মিটিং, নোটস নেওয়া, কেনাকাটা আর রিহার্সাল! অনেকে গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীর পরিবার আছে। এই পরিবারের নানান দায়িত্ব শেষেও তারা সময় দিয়ে, নানান অনুশীলনে অংশ নিয়েছে। সেই দিনগুলোতে মনে হচ্ছিল, আমাদের প্রত্যেকের সময়-অবস্থা পাল্টেছে ঠিকই, কিন্তু বৈশাখ উদযাপন এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনুষ্ঠানের রিহার্সালে সময় দেওয়ার উৎসাহ এখনো আগের মতোই আছে। বেশ তো!

তাই সব পরিকল্পনামাফিক প্রায় দুশো মানুষের আয়োজন করার মহড়া চললো প্রায় কয়েক সপ্তাহ। এখনো মনে আছে, ডর্মের যে কমিউনিটি রুমে আমাদের মধ্যরাত পর্যন্ত অনুশীলন চলত, সেখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে হেঁটে গেলেও বাংলা গানের নানান লিরিক আর সুর ভেসে আসত। বিদেশে বসে দেশের নানান গান, এর একটা প্রবল টান আছে!

এদিকে কেন্টাকিতে প্রায়ই টর্নেডো হয়। তারপরেও এই ঝড়-বাদল উপেক্ষা করে জিমনেশিয়ামে চলে যেতাম নাচের অনুশীলনে। কখনো গাড়ি ভর্তি অনুষ্ঠানের কেনাকাটা শেষে খেয়াল করতাম, আরে! গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটাই তো কেনা হয়নি! আবার বাজার ঘুরে ঘুরে দেশীয় কী পাওয়া যায়, কার বাসায় নকশি কাঁথা আছে, মুখোশ আছে, জোগাড় করার পালা। এ সব মিলিয়ে গত বছরই প্রথমবারের মতন ইউনিভার্সিটি অফ কেন্টাকির গ্যাটন স্টুডেন্ট সেন্টারে আমরা আয়োজনটা করলাম।

বেশ কিছু মজার অভিজ্ঞতাও জমা হয়েছে স্মৃতির খাতায়। দেশে বৈশাখের দিন ঠিক যেমন আমরা শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে ক্যাম্পাসে হাঁটতাম রোদ মাথায় করে, ওভাবেই মার্কিন মুল্লুকে যেখানে সবাই টি-শার্ট আর শর্টস পরে গ্রীষ্মে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, আমরা কয়েকজন প্রত্যেকের মাঝে রঙিন শাড়ি, ওড়না বেঁধে নাচের জন্য হেঁটে যাচ্ছিলাম। নিজেদের এই শ্বেতাঙ্গদের ভিড়ে যে বেমানান লাগেনি তা নয়! কিন্তু কী করার! গিয়েই আমাদের মঞ্চে দাঁড়াতে হয়েছে।

আমরা বাংলাদেশি স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন চাচ্ছিলাম, আমাদের সংস্কৃতির বিষয়গুলো যতটুকু সম্ভব এই সাড়ে আট হাজার মাইল দূরের একটি স্টেটে তুলে ধরতে। নীলচে ঘাসের শহরে সবুজের পরিচয় করিয়ে দিতে। বাংলা নববর্ষ সবসময় উদযাপিত হোক সীমান্ত পেরিয়েও।

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।

 

Comments

The Daily Star  | English

July uprising: The wounds that are yet to heal, one year on

This week marks one year since 15-year-old Md Shahin Alam’s life was forever changed -- not by illness or accident, but by a bullet that tore through his left leg during a rally on August 5, 2024.

15h ago