ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: বাংলাদেশে কী প্রভাব পড়বে?

ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ,
অলঙ্করণ: আনোয়ার সোহেল/স্টার ডিজিটাল গ্রাফিক্স

কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ পর্যটক নিহতের ঘটনায় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই ইস্যুতে দেশ দুটি পরস্পরকে দোষারোপের পাশাপাশি পাল্টাপাল্টি বেশকিছু শক্ত পদক্ষেপও নিয়েছে। কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখাজুড়ে টানা তৃতীয় রাতের মতো ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। উভয় দেশের শীর্ষ নেতাদের মনোভাবে এখনো সমাধান বা উত্তেজনা অবসানের কোনো ইঙ্গিত তো পাওয়া যাচ্ছেই না, বরং একে অপরকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন।

এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—বাংলাদেশে কি এই উত্তেজনার কোনো প্রভাব পড়বে? পড়লে সেটা কী ধরনের হবে? সতর্কতামূলক প্রস্তুতি হিসেবে বাংলাদেশে করণীয় কী?

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ, কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ এবং ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আমেনা মহসিনের সঙ্গে।

তাদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই দেশের মধ্যকার চলমান উত্তেজনার প্রভাব বাংলাদেশসহ পুরো অঞ্চলেই পড়বে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অবশ্যই সর্তক অবস্থানে থাকতে হবে বলে মনে করেন তারা।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ, ফরহাদ মজহার, অধ্যাপক আমেনা মহসিন ও আলতাফ পারভেজ।

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অবস্থান নতুন না উল্লেখ করে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, 'কাশ্মীরে যখনই কিছু হয়, ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করে। আবার বেলুচিস্তানে কিছু হলে পাকিস্তান ভারতকে দায়ী করে। উভয় ক্ষেত্রেই তারা পাল্টাপাল্টি কিছু ব্যবস্থা নেয়। এখন কথা হচ্ছে, এই পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা কোথায় গড়াতে পারে? ভারতীয় জনগণের মধ্যে হাইপ সৃষ্টি হয়েছে, মিডিয়াও বড় আকারে হাইপ তুলেছে বলে ভারত সরকারের কিছু একটা করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের ইন্টেলিজেন্স যে ব্যর্থ হয়েছে, সেটায় কোনো সন্দেহ নেই। সেটা সামলানোর উপায় হলো কিছু একটা করা। সেই হিসেবে আগের মতোই টেরোরিজম বা টেররিস্ট আউটফিটের নামে কিছু সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হতে পারে।'

'এর আগেও যে তারা পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে করে মূল সমস্যার সমাধান হয়নি। সেই কারণে যারা এগুলো করে তারা পারও পেয়ে যায়।'

এই দুদেশের মধ্যে বড় আকারে যুদ্ধের সম্ভাবনা তেমন নেই উল্লেখ করে এই বিশ্লেষক বলেন, 'দুটো দেশেরই পারমাণবিক সক্ষমতা আছে। কিন্তু তাদের জনগণ বড় ধরনের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বলে মনে করি না। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলব, তারা বড় যুদ্ধে জড়াবে না। হয়তো পাল্টাপাল্টি ওই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।'

বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন, তাদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, 'এই ঘটনায় ড. ইউনূস ইতোমধ্যে নিন্দা জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন। অন্য কেউ যেন অযাচিত মন্তব্য করে না ফেলেন, সেই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ অযথা মন্তব্য করে বাড়তি ঝামেলা আনার প্রয়োজন নেই। এ ধরনের ঘটনায় যেহেতু ইমোশনও জড়িত, তাই যাতে একটা সমাধান আসে, সেই ভূমিকাই রাখতে হবে।'

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার। 'কারণ, উপমহাদেশের যেকোনো ঘটনার প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ওপর থাকে এবং দেশের নাগরিকদের মধ্যেও এর নানাবিধ প্রতিক্রিয়া হয়।' 

তিনি বলেন, এই উত্তেজনার কারণে উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও আরেকটু জটিল হলো। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রথমেই ভারত একটা আন্তর্জাতিক চুক্তি (সিন্ধু পানি চুক্তি) স্থগিত করেছে। ভারতের দিক থেকে এটা আন্তর্জাতিক আইনেরও লঙ্ঘন হলো।

ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কথা উল্লেখ করে তিনি ব্যাখ্যা করেন, আগামী বছর বিজেপি বিহার ও পশ্চিমবাংলার ক্ষমতায় আসার জন্য যে জনমতটা তৈরি করতে চাচ্ছে, তার জন্য মুসলমানবিরোধী রাজনীতির দিকে এগোচ্ছে। ফরহাদ মজহার মনে করেন, এটা বাংলাদেশের জন্য জটিলতা বাড়াবে। কারণ মাত্রই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে এসেছে দেশটি।

'বাংলাদেশের প্রতি দিল্লির যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেখানে কূটনৈতিক কোনো সহনশীলতা যেমন নেই, তেমনি কোনো দূরদৃষ্টিও নেই। ফলে এটা বাংলাদেশকে অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।'

রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সত্যিকার অর্থে দায়িত্বশীল না। এখানে ধর্মীয় জাতিবাদী গোষ্ঠীগুলোরও কোনো ভূরাজনৈতিক কম্প্রিহেনসিভ দৃষ্টিভঙ্গি নেই। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের পক্ষে কাজ করতে কীভাবে বলতে হয়, কোন ভাষায় বলতে হয়, এটা নিয়ে সত্যিকার অর্থে তারা সচেতন না। সব মিলিয়ে আমি চিন্তিত যে, কীভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে। আমাদের আরও অনেক বেশি বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, সহনশীলতা ও সংবেদনশীলতা দরকার।'

সতর্কতামূলক প্রস্তুতি হিসেবে বাংলাদেশের করণীয় নিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, 'ভারতের মুসলিম বা কাশ্মীরিদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটা সুস্পষ্ট নীতি দরকার যে, আমরা ভারতের কাশ্মীর নীতিকে সমর্থন করি না। ড. ইউনূসের এটা দ্রুতই করা উচিত। পরিষ্কার করে বলতে হবে, ভারতের সংবিধানে দেওয়া কাশ্মীরের "বিশেষ মর্যাদা" তারা বাতিল করেছিল। সংখ্যালঘুদের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার বিষয়ে ড. ইউনূস ভারতকে যে বার্তা দিয়েছেন, সেটার জন্য তিনি প্রশংসার দাবিদার। এই কথা বলতে যথেষ্ট সাহস লাগে। আশা করব, তিনি বলবেন, কাশ্মীরি জনগণের প্রতি আমাদের সংহতি আছে।'

'সঠিক তথ্য যেহেতু এখনো পরিষ্কার নয়, আমরা যেন প্রোপাগান্ডায় বিভক্ত বা বিভ্রান্ত না হই। নিরীহ-নিষ্পাপ মানুষকে হত্যা করার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। এটার মধ্যে ইসলামের কোনো গৌরব বা মহিমা নেই। এটা অত্যন্ত অন্যায় কাজ হয়েছে এবং আমরা এর নিন্দা জানাই। সবমিলিয়ে জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা পড়েছি। আমাদেরকে ঠান্ডা মাথায় সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে আমি মনে করি না যে ঠান্ডা মাথায় দূরদৃষ্টি নিয়ে কাজ করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ সক্ষম মানুষ সরকারে রয়েছে। কিংবা থাকতেও পারে, যেটা আমার জানা নেই।'

আলতাফ পারভেজ বলেন, ভারত-পাকিস্তানের এই উত্তেজনায় পুরো অঞ্চলে সামরিকায়ন বেড়ে যাচ্ছে। তারা যেহেতু পাল্টাপাল্টি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সামরিক ব্যয় বাড়াচ্ছে, বাংলাদেশের ওপরও সামরিক ব্যয় বাড়ানোর একটা চাপ তৈরি হতে পারে। এখন দরিদ্র দেশগুলোতে সামরিক ব্যয় বাড়া মানেই হলো গরিব মানুষের হিস্যা থেকে কিছু বরাদ্দ ওই দিকে চলে যাওয়া। এটা একটা বিপদের দিক।'

চলমান ট্যারিফ যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ক এই গবেষক বলেন, বিশ্বে চলমান ট্যারিফ-যুদ্ধে এখন প্রয়োজন ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নিজেদের ভেতর বাণিজ্য বাড়ানো। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় তো এইটাও হবে না।

'অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার একটা লক্ষ্য দেখা যায়। এই উত্তেজনায় সেটাও দূরে চলে গেল। সবমিলিয়ে এই বিষয়গুলো বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক। আবার ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনোজগতকেও প্রভাবিত করে। এই ইস্যুতে বাংলাদেশের মানুষও কোনো না কোনো পক্ষ নিয়ে নেয় মনোজাগতিকভাবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ তো খারাপ। ফলে একটা যুদ্ধে সহিংসতার মনোভাব কিন্তু সমাজতাত্ত্বিকভাবে ডেভেলপ করে যায়। আবার এই দুই দেশের সঙ্গেই আমাদের খেলাধুলা এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে সম্পর্ক, আসন্ন দিনগুলোয় সেগুলোও ব্যাহত হবে। এগুলোর ফলে আমাদের জন্য দ্রুত একটা ক্ষতির ব্যাপার আছে।'

দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই দেশের চলমান উত্তেজনা ঘিরে এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা উচিত বলে মনে করে আলতাফ পারভেজ। 'বাংলাদেশের উচিত জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোকে বলা যে, ভারত-পাকিস্তানের উচিত কাশ্মীর ইস্যুর সমাধান করা কিংবা ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটির উচিত এখানে মধ্যস্থতা করা। কারণ এই উত্তেজনা পুরো অঞ্চলের জন্যই ক্ষতিকর।'

এই ইস্যুতে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর মনোভাব নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এই উত্তেজনায় বিশ্বের সুপার পাওয়ার দেশগুলো নীরব দর্শক হয়ে আছে। শীতল যুদ্ধটা যেন এশিয়ার দিকে চলে আসছে।

'কিন্তু এখন বাংলাদেশের উচিত ওআইসিসহ অন্যান্য ফোরামগুলোকে বলা যে, কাশ্মীর ইস্যুটা স্থায়ীভাবে সমাধান করা উচিত। তাহলে এই অঞ্চলে উত্তেজনার উৎসটা বন্ধ হবে। এই মুহূর্তেই বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটা রাখতে হবে, শুধু দর্শক হয়ে থাকলে হবে না। আন্তর্জাতিক পরিসরে সক্রিয়ভাবে ভয়েস রেইজ করতে হবে। আমি বলব আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের উচিত ভাবমূর্তিটা এমনভাবে তৈরি করা যে, ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের মধ্যে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হওয়ার শঙ্কা তৈরি করছে।'

ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনার প্রভাব পুরো দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে পড়বে উল্লেখ করে অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন, আমরা আন্তঃসংযোগের কথা বলছি, সার্কের কথা বলছি। কিন্তু এই উত্তেজনার কারণে তো এখন এসব বিষয় আড়ালে চলে যাবে। এটা একটা বড় ব্যাপার। আবার যেসব গোষ্ঠী এই ধরনের হামলা চালায়, তাদের তো নির্দিষ্ট কোনো বাউন্ডারি বা বর্ডার থাকে না। তাই আমাদেরও সতর্ক হতে হবে।

'এর আগে কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলা হয়নি। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের কাছে আতিথেয়তা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাই সেখানে প্রথমবারের মতো পর্যটকদের ওপর হামলায় সেখানকার সাধারণ মানুষের মধ্যেও এক ধরনের ভিন্ন প্রতিক্রিয়া এসেছে।'

বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের নেতিবাচক প্রচারণার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা সাম্প্রদায়িক রূপ নেওয়ার ব্যাপারটিও আছে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতে বাংলাদেশ সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক প্রচারণার বিষয় লক্ষ্য করা গেছে। এখন এই উত্তেজনা ঘিরে সেটা আরও বাড়তে পারে।

সর্বোপরি বাংলাদেশকে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে উল্লেখ করে অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন, এরকম ঘটনা যেকোনো রাষ্ট্রেই ঘটতে পারে। সেই ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। সবদিক বিবেচনায় বাংলাদেশকে যথাযথভাবে সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Exports under strain as India slaps more restrictions

Industry insiders say the new restrictions could deepen Bangladesh's export woes at a time when global demand remains fragile and other sectors—from garments to processed foods—also face trade hurdles

14m ago