ট্রাম্প কি পারস্য উপসাগরের নাম বদলাতে পারেন?

ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ছবি: এএফপি

উপসাগরটির এক পাশে পারস্য, অন্যপাশে আরব উপদ্বীপ। প্রাচীনকাল থেকে এই উপসাগরটি পারস্য উপসাগর হিসেবে পরিচিত। হাল আমলে ইরানের সঙ্গে রাজনৈতিক-ধর্মীয় সংঘাতের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী আরব দেশগুলো চেষ্টা করছে উপসাগরটির নাম বদলাতে। যদিও আরব সাগর পৃথিবীর বৃহত্তম সাগর হিসেবে সুবিদিত।

নিজ দেশে মেক্সিকো উপসাগরের নাম বদলে আলোচনায় আসা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আসছেন মধ্যপ্রাচ্যে। সফরের ঠিক আগে পারস্য উপসাগরের নাম পরিবর্তন করে 'আরব উপসাগর' রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। সন্দেহ নেই এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে ইরানের জনগণ।

গত বুধবার ওভাল অফিসে ট্রাম্প বলেছিলেন, 'আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি কারো অনুভূতিতে আঘাত দিতে চাই না। জানি না কেউ এতে কষ্ট পাবে কি না।'

গত সপ্তাহে এপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প আসন্ন আরব দেশগুলো সফরের সময় উপসাগরটির নাম পরিবর্তনের ঘোষণা দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। এসব দেশ দীর্ঘদিন ধরে এই নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করে আসছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়।

পারস্য উপসাগরের ঐতিহাসিক পটভূমি ও এর নাম বদলের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে গত রোববার দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়, ফিরোজা-নীল এই জলরাশিকে পারস্য উপসাগর নামে ডাকা হচ্ছে কমপক্ষে খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ সাল থেকে। তখন সাইরাস দ্য গ্রেটের অধীনে পারস্য সাম্রাজ্য ভারত থেকে পশ্চিম ইউরোপের প্রান্ত পর্যন্ত বিশাল এলাকা শাসন করত। সেই প্রাচীন পারস্যই আজকের আধুনিক ইরান। এর পুরো দক্ষিণ উপকূল এই পারস্য উপসাগরকে ঘিরে আছে।

রেজা শাহের আমলের প্রাক-ইসলামি বিপ্লব যুগ থেকে শুরু করে ইরানের সরকারগুলো পারস্য উপসাগর নামটিকেই একমাত্র বৈধ ও গ্রহণযোগ্য নাম হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। একইভাবে, দেশের ভেতরে ও বাইরে থাকা ইরানিদের কাছেও এই নামটি তাদের জাতীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এই নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব তাই সব ইরানিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। রাজনৈতিক, আদর্শিক ও ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে সব মানুষ বিবৃতি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্পের এই প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা করছেন।

ট্রাম্প কি উপসাগরটির নাম বদলাতে পারেন?

যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ব্যবহৃত ভৌগোলিক নাম পরিবর্তনের আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আছে। কিন্তু, আন্তর্জাতিকভাবে অন্য দেশ তার এই আদেশ মানতে বাধ্য নয়।

সম্প্রতি ট্রাম্প নির্বাহী আদেশে যুক্তরাষ্ট্রের জিওগ্রাফিক নেমস ইনফরমেশন সিস্টেম হালনাগাদ করার কথা বলেন। এতে মেক্সিকো উপসাগরের সমস্ত উল্লেখ পরিবর্তন করে আমেরিকা উপসাগর করা হয়। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউদিয়া শেইনবাম সম্প্রতি জানিয়েছেন, এই আদেশ মেনে চলার জন্য তারা গুগলের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস বোর্ড অন জিওগ্রাফিক নেমস সরকারি কাজে 'পার্সিয়ান গালফ বা পারস্য উপসাগর' নামটিই ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়।

বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক সীমানা নির্ধারণ ও চার্ট করার দায়িত্বে থাকা ইন্টারন্যাশনাল হাইড্রোগ্রাফিক অর্গানাইজেশন অবশ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছে, সামুদ্রিক অঞ্চলের নামকরণের জন্য আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক চুক্তি বা প্রোটোকল নেই।

ইরানিদের প্রতিক্রিয়া

ট্রাম্পের ওই প্রস্তাব দলমত নির্বিশেষে সব ইরানিদের এক করেছে। সবাই এই প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া-আর্ভাইনের পার্সিয়ান স্টাডিজ সেন্টারের পরিচালক ও ইতিহাসবিদ তুরাজ দারিয়ায়ি বলেন, 'এটি রাজনীতির ঊর্ধ্বে, ধর্মীয় বিভেদ এবং মতাদর্শের ঊর্ধ্বে—এটি জাতি ও এর ইতিহাস সম্পর্কিত। তাই এটি মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।'

তিনি আরও বলেন, প্রাচীনকাল থেকেই ইরানিরা তাদের দেশকে 'আব ও খাক' বলে অভিহিত করে আসছে। এর অর্থ 'পানি ও মাটি'। দক্ষিণের পারস্য উপসাগর এবং উত্তরের কাস্পিয়ান সাগর—এই দুটি জলরাশি ইরানি জাতিসত্তার প্রতীক হিসেবে তাদের মানসিকতায় গভীরভাবে প্রোথিত।

তেহরানের বিশ্লেষক আহমাদ জেইদাবাদি সামাজিকমাধ্যম এক্স-এ লিখেছেন, 'শুধু ট্রাম্পের ইচ্ছা আর খামখেয়ালিপনার কারণে মেক্সিকো উপসাগর "আমেরিকা উপসাগর" হয়ে যাবে না, কানাডা যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দেবে না, গ্রিনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের সম্পত্তি হবে না, আর পারস্য উপসাগরও কোনো ভুয়া নাম ধারণ করবে না।'

ইরানের জাতীয় ফুটবল দল তাদের অফিসিয়াল ইনস্টাগ্রাম পেজে পারস্য উপসাগরের মানচিত্র ও #ForeverPersianGulf নামে ট্রেন্ডিং হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে এই ইস্যুতে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।

ইরানের বিরোধীদলের নেতারাও তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

ইরানের ক্ষমতাচ্যুত রেজা শাহের ছেলে রেজা পাহলভি সামাজিকমাধ্যমে লিখেছেন, 'ইতিহাস বিকৃত করার ট্রাম্পের এই কথিত সিদ্ধান্ত যদি সত্য হয়, তবে তা ইরানের জনগণ ও আমাদের মহান সভ্যতার প্রতি অপমান।'

তিনিই একসময় ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ইরানের বর্তমান সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক বিষয় ত্যাগ করতে তাকে উৎসাহিত করেছিলেন।

পারস্য উপসাগরের ইতিহাস

পারস্য উপসাগর নামটি ইতিহাসের শুরু থেকেই ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে গ্রিক ও ব্রিটিশ যুগ পর্যন্ত—মানচিত্র, নথিপত্র ও কূটনীতিতে এই নামটিই ছিল। এই অঞ্চল দীর্ঘকাল পারস্য সাম্রাজ্যের আধিপত্যে ছিল। এ থেকেই উপসাগরটি 'পারস্য উপসাগর' নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সময় থেকে উপসাগরটিকে 'আরব উপসাগর' নামে ডাকার চাপ ধীরে ধীরে জোরালো হতে শুরু করে।

জাতিসংঘ পারস্য উপসাগর শব্দটি ব্যবহার করে। জাতিসংঘের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপের ২০০৬ সালের এক গবেষণাপত্রে এই শব্দটির বিষয়ে ঐতিহাসিক দলিলপত্রে ঐকমত্য পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে পারস্য সম্রাট দারিয়ুস এই নামটি প্রবর্তন করেছিলেন।

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু আলোচনায় প্রভাব পড়বে?

ইরানের পরমাণু কর্মসূচির অগ্রগতি নিয়ে ওমানের মধ্যস্থতায় ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র তিন দফা আলোচনা করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র চায়, ইরান যেন তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে অস্ত্রের দিকে না নিয়ে যায়। অন্যদিকে ইরান চায় তাদের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নেওয়া হোক।

ইরানের সাবেক কূটনীতিক ও ২০১৫ সালে দেশটির পরমাণু আলোচক দলের সদস্য সাইয়্যেদ হোসেন মুসাভিয়ান বলেছেন, ট্রাম্প যদি পারস্য উপসাগরের নাম পরিবর্তন করেন, তবে তা পরমাণু আলোচনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

তিনি আরও বলেন, 'এটি অনাস্থা তৈরি করবে। ইরানের কট্টরপন্থিদের উৎসাহিত করবে। তারা বলে আমেরিকার ওপর বিশ্বাস রাখা যায় না।'

Comments

The Daily Star  | English

India curbs import of Bangladeshi jute, woven fabrics, yarn

However, the products will be allowed to be imported only through Nhava Sheva seaport in Maharashtra

1h ago