শৈশবের ট্রমা যেভাবে বিবাহিত জীবনে প্রভাব ফেলে

শৈশবের ট্রমা যেভাবে বিবাহিত জীবনে প্রভাব ফেলে
প্রতীকী ছবি: এআই জেনারেটেড

আমরা যারা প্রাপ্তবয়স্ক এখন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই জন্মের পর থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করে এসেছি। প্রথমে শব্দ উচ্চারণ করেছি, এরপর হাঁটতে শিখেছি, স্কুলে ভর্তি হয়েছি, স্নাতক করেছি, এরপর কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছি এবং সবশেষে বিয়ে করে সংসারী হয়েছি।

অনেকের জন্যই এই ধারাবাহিকতায় বিবাহিত জীবন সুখে-শান্তিতে কাটানোর এক অদৃশ্য চাপ থাকে, যা তারা অনেকটা উত্তরাধিকারসূত্রে পান। আর জীবনের ঠিক এই পর্যায়ে এসে খুলে যায় শৈশব থেকে আটকে রাখা এক অন্ধকার কুঠুরি, যা বিবাহিত জীবনে নিয়ে আসে ঝগড়া, চিৎকার, লড়াই কিংবা একেবারে নিস্তব্ধতা। নিজেদের সেরা ভার্সনটা হতে গিয়ে আমরা প্রায়ই শৈশবে ফেলে আসা এক অস্থিরতার মুখোমুখি হই। অতীতের ভয়াবহ সেইসব ট্রমা বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করে ফাটল তৈরি করতে চায়। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি সেই ট্রমার মুখোমুখি হচ্ছেন, ততক্ষণ এটি আপনার পারিবারিক জীবনকে অস্থির করেই রাখবে। অথচ একটি সুখী পরিবার তো সবার জন্যই প্রত্যাশিত।

একটি শিশুর মানসিক গঠন বা মানচিত্রটি তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি দেখা ও তার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে। সেখানে যদি সে মানসিক যন্ত্রণা পেতে দেখে, বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া দেখে, নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে করতে থাকে, কারো অন্যায় আচরণের শিকার হয় কিংবা অবহেলার শিকার হয় তাহলে তার মানসিক গঠনটি হয় যন্ত্রণাভিত্তিক। সাধারণত একজন মানুষ যে বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়, সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই পৃথিবীকে দেখে। আর তার বিশ্বাস তৈরি হয় শৈশবে সে কেমন শৃঙ্খলিত পরিবেশে বড় হয়েছে তার ওপর। তা সেটি সঠিক হোক, আর না হোক।

তাদের মানসিক মানচিত্র এমনভাবে তৈরি হয় যা তাদের প্রথম সম্পর্কের অস্থিরতা মোকাবিলা করতে সহায়তা করে। এটিই নির্ধারণ করে যে, পরবর্তী জীবনে কীভাবে প্রেম, বিশ্বাস এবং বিশ্বস্ততার প্রতি তাদের বোঝাপড়া তৈরি হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু তাদের মানসিক মানচিত্র বদলে যায় না। বরং ধীরে ধীরে হলেও তা ফিরে আসে এবং অবশ্যই ফিরে আসে। বহু বছর আগে বিয়ে বা দাম্পত্য সম্পর্কে যে ধারণা তাদের মধ্যে গেঁড়ে বসেছিল, তারা সেটির মধ্যেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। অথচ এই ধারণা তখন তৈরি হয়েছিল যখন বিয়ে বা দাম্পত্য বোঝার মতো বয়সই হয়তো তাদের হয়নি।

বিয়ের প্রথম সময়

বিয়ের পর প্রাথমিক দিনগুলোয় সম্পর্কটি নিয়ে দম্পতির মধ্যে নানা ধরনের আশা থাকে। এই সময়টাকে বলা হয় হানিমুন পিরিয়ড। এসময় দুজনে স্বপ্ন বোনেন, নানা পরিকল্পনা করেন, চলে অন্তহীন কথোপকথন। সেসময় মনে হয়, অতীতের অভিজ্ঞতা ফিরে আসবে না, সেসব বাদ দিয়েই জীবন কেটে যাবে। কিন্তু অতীত ফিরে আসেই।

অনেক সময় দেখা যায়, সঙ্গীদের একজন তার সহকর্মীর সঙ্গে কথা বললেও অন্যজন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি এমন হয় যে, একজনের মনে হয়, তার সঙ্গী তাকে আর ভালোবাসছেন না। আর ঠিক সেই সময়ই ফিরে আসে শৈশবের সেই ভয়।

অনেক সময় দেখবেন রাতের খাবারের পরিকল্পনা করা নিয়ে সামান্য মতবিরোধ থেকে তুমুল তর্ক শুরু হয়ে যায়। অন্যদের কাছে হয়তো এটি তুচ্ছ ভুল বোঝাবুঝি। কিন্তু যার আছে শৈশবের ট্রমা, তার জন্য এই মতবিরোধ প্রত্যাখ্যান বা নিজেকে হারিয়ে ফেলার মতো গুরুতর।

মনোবিকাশ ফাউন্ডেশনের মনোচিকিৎসক ডা. আব্দুল হামিদ বিষয়টি বুঝিয়ে বলেন।

তিনি বলেন, শৈশবের অমীমাংসিত ট্রমা নীরবে বিভিন্ন মানসিক প্রতিক্রিয়াগুলোকে পরিচালিত করে। এটা এমনভাবে কাজ করে যে একজন মানুষ তা বুঝতেই পারেন না। মানুষ তার পুরোনো মানসিক মানচিত্রের সঙ্গেই নতুন সম্পর্কটিকে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করে। নতুন সম্পর্কে যখন মতবিরোধ দেখা দেয় তখন পুরোনো ট্রমা তার যুদ্ধক্ষেত্র খুঁজে পায়। যা দম্পতিদের এমন এক দ্বন্দ্বের চক্রে ফেলে দেয়, যেটি তাদের কাছে অপরিচিত মনে হয়, আবার হয় ভীষণ বেদনাদায়কও।

বাইরে থেকে দাম্পত্যের এই সংকট সবসময় বোঝা যায় না। ঢাকার মতো শহরে যেখানে সামাজিক প্রত্যাশা অনেক বেশি এবং প্রায়ই বর্ধিত পরিবারের মতামত নবদম্পতির ব্যক্তিগত সময়ের ওপর হস্তক্ষেপ করে, সেখানে মানসিক দুর্বলতা স্বীকার করে নেওয়া অনেকটা পরাজয় বরণের মতোই মনে হয়।

দাম্পত্যে তৈরি হওয়া এই দূরত্বকে অনেকেই খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখেন। তারা স্বাভাবিকভাবে ঘরের কাজ করেন, সন্তানকে স্কুলে আনা-নেওয়া করেন, খুব সাবধানে চলেন যেন আত্মীয়স্বজনের সামনে দুজনের মধ্যকার দূরত্বটা প্রকাশ না হয়ে যায়।

নীরবে চলার ফলে দেখা যায়, সঙ্গীদের মধ্যে মানসিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে। অবিশ্বাস থেকে নয় বরং আশ্বস্ত হওয়ার জন্য সঙ্গীদের মধ্যে একজন মরিয়া হয়ে ওঠেন। তখন অনেকটা শিশুসুলভভাবেই তিনি অন্য সঙ্গীর সোশ্যাল মিডিয়া মোবাইল ফোনের পাসওয়ার্ড চেয়ে বসতে পারেন।

নিজের হতাশার কথা বলতে গিয়ে বুটিক ব্যবসায়ী মৌনি বলেন, 'আমি আমার স্বামী আলীর কাছ থেকে কখনও খুব বেশি কিছু চাইনি। আমরা বেশ ভালোই ছিলাম। যখন তার নতুন চাকরি হলো, তখন তা আমাদের সম্পর্কের মাঝে চলে এলো। ওর অনেক পরিবর্তন হলো। আমার মনে হচ্ছিল যে আমি আর তার অগ্রাধিকার তালিকার শুরুতে নেই। আমরা প্রায়ই ঝগড়া করতাম। আমি স্ত্রী হিসেবে তার ওপর আমার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করলাম। যেদিন তাকে আল্টিমেটাম দিই, সেদিনই আমরা আলাদা হয়ে যাই।'

বিচ্ছেদের পর মৌনি বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করেন। এজন্য তাকে চিকিৎসকের কাছেও যেতে হয়।

তিনি বলেন, 'এটা স্বীকার করতে আমার খারাপ লাগে যে আমার মধ্যে পরিত্যক্ত হওয়ার তীব্র ভয় রয়েছে। আমি তার সবকিছু হতে চেয়েছিলাম। এসব শুরু হয়েছিল খুব ছোটবেলায়, আমার মা চলে যাওয়ার মুহূর্ত থেকে। অথচ বড় হয়েও আমি সেই শিশুটিই রয়ে গেলাম। কেবল বয়স বেড়েছে, গলায় জোর বেড়েছে এবং আমি আরও বেশি মরিয়া হয়েছি। আমি আলীকে যতটুকু সম্ভব আমার কাছে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার শৈশবের নিরাপত্তাহীনতা উল্টো তাকে আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে গেছে।'

এ ধরনের দাম্পত্যে বিপরীত পাশে যিনি থাকেন, তিনি বেশিরভাগ সময় জানেনই না যে তার সঙ্গী কেন এই আচরণ করছেন বা তার ভেতরে কেমন ক্ষত তৈরি হয়ে রয়েছে। তার কাছে বরং সঙ্গীর আচরণ নিয়ন্ত্রণমূলক মনে হয়। তাই সেখান থেকে তিনি সরে আসতে চান।

ডা. হামিদ বলেন, 'যারা ছোটবেলা থেকে অবহেলার মধ্যে বড় হয়েছেন, নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে লড়াই করেছেন তার জন্য সম্পর্কের মধ্যে নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা, স্বচ্ছতা বা অতি দৃশ্যমানতাই ভালোবাসার প্রমাণ হয়ে ওঠে। সঙ্গীর ঘনিষ্ঠ হওয়ার আকুতি থেকে যা শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। যেখানে পাশাপাশি কয়েক ইঞ্চি দূরত্বে শুয়েও দুজন সঙ্গী আদতে বাস করেন আলাদা পৃথিবীতে।'

শৈশবের প্রভাব

কিশোর বয়সে মানসিক আঘাতের মুখোমুখি হওয়া বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় বিরল নয়। নানাভাবেই এটি হতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে আর্থিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লিঙ্গবৈষম্য এবং পুরুষতন্ত্র। পিতৃতান্ত্রিক রীতিনীতি অনেক পরিবারের স্বাভাবিক গতিকেই বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

অনেক শিশুই এই ধারণা নিয়ে বড় হয় যে তাদের চাহিদা সংসারে গৌণ। কারো কারো কাছে মনে হয় তার অস্তিত্বই বুঝি পরিবারের জন্য বোঝা। তাদের মনের এই ক্ষতগুলোর যদি চিকিৎসা না করা হয় তাহলে তা ব্যক্তির মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কেবল যখন ওই শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়ায় তখন ক্ষতগুলো হিংস্রভাবে প্রকাশিত হয়।

এই ধরনের বিশ্বাসের ফলে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে একজন ব্যক্তি কোনো সম্পর্কে জড়ালে সেখানে পরিত্যক্ত হওয়ার ভয় পান। বিশেষ করে তাদের মধ্যে এ সংকট দেখা যায়, যারা শৈশবে বাবা-মায়ের মধ্যে বিরোধ দেখে বড় হয়েছেন।

কখনও কখনও ঝগড়ার সময় বাবা-মায়ের বলেন, 'সন্তান না থাকলে আমি এই সংসার থেকে চলে যেতাম' কিংবা 'আমাদের সন্তানের যত্ন নেওয়ার জন্য আমি ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়েছি'।

এসব কথা হয়ত বাবা-মা সন্তানকে আঘাত দেওয়ার জন্য বলেন না। কিন্তু এগুলো সন্তানের মনে গভীর ক্ষত রেখে যেতে পারে। এই কথাগুলো প্রায়ই শিশুর স্মৃতিতে গেঁথে যায়। শিশুর কানে এটি ভালোবাসার মতো শোনায় না। বরং এসবের জন্য সে নিজেকে দায়ী করতে শুরু করে। সে ভেবে নেয়, বাবা বা মায়ের ক্ষতির কারণ সে নিজেই। শিশুটি যেহেতু বড়দের সম্পর্কের জটিলতা বুঝতে পারে না, ফলে নিজের দোষ ভেবে গভীর অপরাধবোধে ভুগতে থাকে এবং তার মধ্যে আত্মমূল্যায়নের এক বিকৃত অনুভূতি তৈরি হয়।

ডা. হামিদ বলেন, 'এই শিশুরা এটা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, বাবা-মায়ের কষ্ট এবং ত্যাগের কারণ তারা। বাবা-মায়ের দ্বন্দ্বের পেছনের কারণ বোঝার জন্য তারা আকুল হয়ে চেষ্টা করে এবং প্রতিবারই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে এসব সংকটের জন্য তারাই দায়ী।'

চাকরীজীবী মনসুরা বলছিলেন তার সংগ্রামের কথা।

তিনি বলেন, 'আমি সবসময় পেছনে পড়ে থাকি। সবসময় মনে হয় এটা আবার হবে। বলতে পারেন, এই ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখে হওয়া অত্যন্ত বেদনাদায়ক। যখন কেউ একজন আপনার সঙ্গে আর একমত হন না, সময়মতো মতো মেসেজের উত্তর দেন না কিংবা ভুলে যান যে আমিও একটি মানুষ যে তার সঙ্গে এক ঘরেই আছি। এসব বুকের ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করে। আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি।'

তিনি নিজেকে বোঝান যে, তার সঙ্গীর আর তাকে প্রয়োজন নেই। তিনি আর সঙ্গীর জন্য যথেষ্ট নন।

'তাই আমি আগেই চলে যাই। আঘাত পাওয়ার আগেই চলে যাওয়া ভালো। এখন পর্যন্ত তিনবার আমার সঙ্গে এসব ঘটেছে। বিয়ে আমার কাছে এমন একটি পরীক্ষার মতো যেখানে আমি ব্যর্থ হবই। সম্ভবত এর কারণ আমার বাবা, যিনি কখনও আমাদের সঙ্গে যথেষ্ট সময়ের জন্য থাকেননি এবং শর্তহীন ভালোবাসা কেমন হয় তা আমাদের শেখাননি', বলেন মনসুরা।

এখান থেকেই হারিয়ে ফেলার বা পরিত্যক্ত হওয়ার অনুভূতির শুরু। এ সময় মানুষ তার নিজের মূল্য এবং পরিচয়ের বোধ হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে তার ধারণা আরও বাস্তব হয়ে উঠতে থাকে। শৈশবের এই অমীমাংসিত ট্রমা তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের নতুন সম্পর্কের ওপর আঘাত হানে। পরিত্যক্ত হওয়ার তীব্র ভয় থেকে তারা সম্পর্কে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের এই আচরণের পেছনে লুকিয়ে থাকে একটি আহত শিশু। যে কারো ছেড়ে যাওয়ার কারণ হতে ভয় পায়।

লিঙ্গভিত্তিক অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশের নারীরা পুরুষদের তুলনায় ভিন্ন ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন। যার মধ্যে রয়েছে বডি শেমিং, বর্ণবাদী আচরণ এবং সমাজের অতিরিক্ত প্রত্যাশা। অন্যদিকে পুরুষদের সামাজিকভাবে শক্ত থাকার ভান করতে হয়, নিজের দুর্বলতা দমন করতে হয় এবং পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হয়। এমনকি এর জন্য যদি জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে হয়, তাতেও তাদের পিছপা হওয়ার উপায় নেই। এই দমন-পীড়নের জীবনে যখন দাম্পত্য সম্পর্ক আসে তখন সেখানে দুজনের মধ্যে এক দেয়াল দাঁড়িয়ে যায়, যা ভেঙে ফেলার উপায় দুজনের কেউই জানে না।

সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রেজাকে সবাই সরল মানুষ হিসেবেই জানেন। স্বভাবের কারণে স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগে এবং তার প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করতে তাকে বেশ সংগ্রাম করতে হয়।

তিনি বলেন, 'ভালোবাসার প্রকাশ বা আবেগ দেখানো আমার জন্য কঠিন কাজ। আমার এই বৈশিষ্ট্যটি জীবনের অনেক ক্ষেত্রে কাজে লাগলেও সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাজে আসেনি।'

তিনি আরও বলেন, 'এটা মূলত চারপাশের প্রাপ্তবয়স্কদের কারণেই হয়েছে। আমি যখন কাঁদতাম, তারা বলত আমি নরম। আবার আমি যদি রেগে যেতাম তাহলে তারা বলত আমি হিংস্র হয়ে উঠছি। সেই সময় আমি মায়ের কোলে গিয়ে আশ্রয় চাইতাম। আবার তাকে খুব বেশি আঁকড়ে ধরার জন্যও আমাকে তিরস্কার করা হতো।'

এসব কারণে আবেগ প্রকাশের দক্ষতাকে রেজা নিজেই নষ্ট করেছেন বলে জানালেন।

তিনি বলেন, 'এখন আমার এত কষ্ট হয়! আমি স্ত্রীর প্রতিও ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি না। অথচ তাকে আমি সত্যিই ভালোবাসি। কিন্তু সে মনে করে যে আমি তার যত্ন নিই না, আমি আবেগ প্রকাশে অক্ষম।'

'কারও ব্যথায় বা কষ্টে আবেগ প্রকাশ করা আমার জন্য কষ্টকর। আমি মনে করি তারাও আমার মতোই ভাবে। আবেগকে চেপে রাখে যতক্ষণ না তা বিরক্ত না করে। আমি কখনোই ভাবিনি যে ভালোবাসা প্রকাশ বা যত্নশীল হওয়ার মতো একটা সাধারণ জিনিসও আমার জন্য অধরা হয়ে উঠবে। অথচ আমি আমার স্ত্রীকে সত্যিই ভালোবাসি কিন্তু জানি না যে তা কীভাবে প্রকাশ করতে হয়', যোগ করেন তিনি।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দুনিয়া যখন কোনো দম্পতির ঝকঝকে ছবি দেখছে, আনন্দময় ক্যাপশন দেখছে আর তাদের দাম্পত্য উদযাপনের খবর পড়ছে তখন হয়তো এদের মধ্যেই কেউ কেউ বন্ধ দরজার আড়ালে নীরবে কষ্ট করছেন, অতীতের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের না আছে কথা বলার জায়গা, না আছে ক্ষত নিরাময়ের সুযোগ।

দাম্পত্যে যোগাযোগের অভাব কেবল ঝগড়ার কারণেই হয় এমন নয়, নীরবতার কারণেও হয়। একে অন্যের প্রতি রাগ, অভিমান জমা হতে হতে ঘৃণা নয় বরং একসময় দ্বিধা চলে আসে। জীবন মাঝে মাঝে এমন নাটকের মতো হয় যেখানে অভিনেতারা তাদের ডায়লগ ভুলে গেলেও নিখুঁতভাবে অভিনয় চালিয়ে যান।

যে সমাজে মানসিক স্বাস্থ্যকে এখনও বিলাসবস্তু হিসেবে দেখা হয়, সেখানে খেরাপি খোঁজা অনেকের জন্য কঠিন। এখাদে দুর্বলতাকে ভুল বোঝা হয়, থেরাপিকে তো দেখা হয় একেবারেই অপ্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে।

আরোগ্যের পথে

ডা. আব্দুল হামিদ জোর দিয়ে বলেন যে, সত্যিকার অগ্রগতি তখনই শুরু হয় যখন দম্পতিরা একে অন্যকে শত্রু হিসেবে দেখা বন্ধ করে এবং আসল প্রতিপক্ষ বা শৈশবের সেই ক্ষতকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখতে শুরু করে। যা হয়তো তারা দুজনেই বহন করে চলছিল। একটু অন্যভাবে কথা বলা শুরুর মধ্য দিয়েই এই ক্ষত নিরাময় সম্ভব। অভিযোগ দিয়ে নয় বরং কৌতূহলের সঙ্গে এবং সততার মাধ্যমে তা সম্ভব।

সঙ্গীর সঙ্গে যখন মতবিরোধ তুঙ্গে উঠবে, তখন আপনাকে ভেবে নিতে হবে এই কান্না বা রাগ আসলে বিয়ে বার্ষিকীর ডিনার ভুলে যাওয়ার কারণে নয়। বরং এর পেছনে রয়েছে একটি আহত শিশু, যে আরও একবার পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। যে আশঙ্কা থেকেই তার রাগের সৃষ্টি।

আকাশচুম্বী অট্টালিকা তৈরির পাশাপাশি ঢাকার সংস্কৃতির বিবর্তন হচ্ছে, বিয়ের সংস্কৃতিতেও আসছে পরিবর্তন। সবকিছুকে চাপা দেওয়ার পুরোনা সংস্কৃতিকে পেছনে ফেলে বিকশিত হচ্ছে প্রশ্ন করার বা বোঝার সংস্কৃতি। দম্পতিরা বুঝতে শুরু করেছে যে, যদি অতীতের কোনো ক্ষত থাকে তাহলে কেবল ভালোবাসাই সুন্দর দাম্পত্যের জন্য যথেষ্ট নয়।

এই সমস্যা সমাধানের একক কোনো উপায় নেই, সহজ কোনো পন্থাও নেই। শৈশবের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত দাম্পত্য সম্পর্ক ঠিক করার পথটি অরৈখিক, অগোছালো এবং অত্যন্ত ব্যক্তিগতও বটে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সততা। আর তা কেবল সঙ্গীর প্রতি নয়, নিজের প্রতিও। প্রতিটি ব্যক্তিকে তার সেই শৈশবের জন্য শোক প্রকাশ করতে বলা যেতে পারে, যেখানে সে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। একইসঙ্গে তাকে শিখতে বলা প্রিয়জনের বিশ্বাস কীভাবে অর্জন করতে হয়, কীভাবে ভালোবাসতে হয় এবং নিরাপদে থাকতে হয়।

কারণ দিনশেষে বিয়ে কেবল দুটি জীবনের মিলন নয়, এটি দুজনের অতীতেরও মিলন। যতক্ষণ না সেই অতীতকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, তাকে মেনে নেওয়া হচ্ছে ততক্ষণ তা ঠিকই ভেতরে ভেতরে গুমরে মরতে থাকে।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English
BNP protests for Ishraque Hossain in Dhaka

Ishraque supporters protest in different parts of Dhaka

Protesters assembled at Matsya Bhaban, Kakrail and Jatiya Press Club, demanding that Ishraque be immediately sworn in as the mayor of the DSCC

1h ago