‘গৌরীপুর জংশন’ দুঃখী মানুষের আখ্যান

হুমায়ূন আহমেদ আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন লেখক। কারণ খুবই সোজা। তার মানুষ দেখার চোখ আমাকে মুগ্ধ করে৷ সমাজের নানা পেশার, মতের ও পথের মানুষকে জানতে হুমায়ূন পাঠ গাইডবুক হতে পারে নিঃসন্দেহে। সমাজে বসবাসকারী সব স্তরের মানুষ সম্পর্কে তার আলোকপাত ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের লেখা ক্যান্টারবেরী টেইলসের কথা স্মরণ করায়, যেখানে সমাজের প্রায় সব পেশার মানুষকে নিজ নিজ পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চারটি করে গল্প বলতে উদ্বুদ্ধ করেন কথকের মাধ্যমে।
'গৌরীপুর জংশন' হুমায়ূন আহমেদের অনবদ্য সৃষ্টি। উপন্যাসিকা। বড় গল্পও বলা যায়। ঘর-বাড়ি, সংসার ও বন্ধনহারা, এতিম ও উদ্বাস্তু কিছু মানুষের গল্প এটা। যাদের থাকা খাওয়া, বেড়ে উঠা, ক্ষুধা, প্রেম, রোগ, শোক ও মৃত্যু সবকিছুই রেলস্টেশন ঘিরে। একটি সমাজকে বুঝতে রেলস্টেশন যেকোনো মাপকাঠিতে কেন গুরুত্বপূর্ণ, সে প্রশ্নের উত্তর এই উপন্যাসে মিলবে৷
'গৌরীপুর জংশন'র মূল চরিত্র জয়নাল। মৃত্যুর সময় তার বাবা তাকে স্টেশনে রেখে যায়। রেলস্টেশনে ভিক্ষে করতো তার বাবা। জয়নাল স্টেশনে কুলির কাজ করে। অন্য দশজন যুবকের মতো স্বাভাবিক সব সাধ আহ্লাদ ছিল তার। জীবনীশক্তির কমতি ছিল না। বিয়ে করেছিল অনুফাকে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, বেচারা মাল বোঝাই করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়, আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। অনুফা আরেকজনের হাত ধরে চলে যায়। এ যেন জীবনের অনিবার্য পরিণতি।
স্ত্রী হারানোর খবরে হাসপাতাল ফেরত জয়নাল বাঁচার আশা প্রায় ছেড়ে দেয়। স্টেশনে শুয়ে-বসে মৃত্যুর কথা ভাবতে থাকে। কিন্তু দুজন ভালো মানুষ তাকে মরতে দেয় না। চিকিৎসা করান তারা। এভাবে জয়নাল সুস্থ হয়ে ওঠে কিছুটা। জয়নাল ভাবে, 'দুনিয়াটা এখনো ভালো মানুষের'।
রেলস্টেশন নানারকম অপরাধ আর দুর্বৃত্তায়নের স্থান—সেটা উপমহাদেশে রেলের আবির্ভাবের পর থেকেই। আবার ঘরহারা, বাঁধনহারা, নেশাগ্রস্ত মানুষের আশ্রয়স্থলও এই স্টেশন। এখানে কেউ কুলির কাজ করে, আবার কেউ পকেটমারে, কেউবা চুরিচামারি করে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জয়নাল হালাল উপায়ে আয় করে না। এটা সত্য। আবার সে মনের দিক থেকে উদারনৈতিক। জয়নাল স্টেশনে এখানে সেখানে ঘুরাঘুরি করা বজলু নামের এতিম ছেলেটাকে আশ্রয় দেয়।
প্রথম দিকে বকাঝকা করলেও শেষে আপন করে নেয়৷ প্রিয়তমা স্ত্রী তাকে ছেড়ে গেলেও তার প্রতি জয়নালের কোনো অনুযোগ নেই। অনুফার দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিয়ে টিকে না। সে যৌনকর্মী হিসেবে স্টেশনের আশেপাশে থাকে। সে পাড়ার ছেলেদের তিরস্কার ও টিটকারির শিকার হলেও জয়নাল তাকে খারাপ মনে করে না। এটাই তার চরিত্রের ভালো দিক। অনুফাকে এটা-সেটা কিনে দেয়। দেখতে যায় মাঝেমধ্যে। দুজনের মধ্যে কত দূরত্ব, আবার আত্মিক একটা সম্পর্ক লালন করে। জয়নাল প্রমাণ করে, ভালোবাসা সত্য ও চিরন্তন।
লেখক হিসেবে হুমায়ূনের কৃতিত্বের জায়গা হলো, তিনি মানুষের হৃদয়ের কথা শুনতেন আর সেটা কলমে পুঁতে দিতেন। মানুষের ভাষা তার অনেক কিছুই প্রকাশ করে। রেলস্টেশনে মানুষ খুব গালিগালাজ করে, রূঢ় আচরণ করে একে অপরের সঙ্গে। কিন্তু এরা একে অপরকে ভালোবাসে। দুর্দিনে হাত বাড়ায়। মধ্যবিত্তের যে শ্রেণি ক্রাইসিস, সেটা এদের মধ্যে নেই। এরা জগতের বঞ্চিত। সব বঞ্চিত এক হয়ে যায় নিজেদের দুঃসময়ে।
হুমায়ূনের সঙ্গে ফ্রান্সিস বেকনের একটা জায়গায় অন্যরকম মিল। সেটা হলো তাদের লেখার ধরন। প্রতিটি কথা যেন একটা প্রবচন। অমোঘ সত্য। 'গৌরীপুর জংশনে' হুমায়ূনের প্রবচনের ব্যবহার পাঠকের মুগ্ধতা দাবি করে।
বজলু এতিম। তার চাচা তাকে স্টেশনে ফেলে চলে যায়। ভিটেমাটি হারা, এতিম মানুষের জন্য জীবন কঠিন। বড়ই। কারণ মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর ও লোভী। এই ব্যাপারে হুমায়ূন বলছেন, 'এই দুনিয়া কঠিন জায়গা। দুই সুতা জায়গাও কেউ কাউকে ছাড় দেয় না।'
কথায় আছে অর্থই সকল অনর্থের মূল। কথাটা অনেকাংশে সত্য। সহজে, বিনা যোগ্যতায় অর্থসমাগম হলে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আবার টাকাপয়সা মানুষের মানসিক আঘাত কাটাতে নিরাময় হিসেবে কাজ করে। এ ব্যাপারে লেখক মন্তব্য করছেন, 'কাঁচা পয়সার ধর্ম হচ্ছে মানুষের মন ভালো করা। সবসময় দেখা গেছে যার হাতে কাঁচা পয়সা তার মন ভালো।'
হুমায়ূনের কোনো একটা লেখায় পড়েছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বাসায় ভালো খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। ধারণা করা যায়, ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ ভোজনরসিক ছিলেন। 'গৌরীপুর জংশনে' তার একটা নমুনা পাওয়া যায়। 'মলামাছের এরকম স্বাদের তরকারি সে এই জীবনে চাখেনি। ভাত খেতে খেতে সে ভাবছিল মজিদ ভাইয়ের পা ছুঁয়ে সালাম করবে। যে এমন তরকারি রাঁধতে পারে তাকে সালাম করা যায়।' চুরির মাল বিক্রি করে পাওয়া টাকায় দীর্ঘদিন পর ভালো খেতে পেরে জয়নাল এমনটা ভাবে। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বেঁচে থাকা উপভোগ করা অথবা ইংরেজ কবি এন্ড্রু মার্বেলের 'টু হিজ কয় মিস্ট্রেস' কবিতায় উল্লেখিত 'Carpe diem' অথবা বর্তমানে যা কিছু পাও, লুফে নাও—কথাটাকে প্রতিধ্বনিত করে।
লোকে বলে, রাগী মানুষের মন ভালো। এরা মুখে দুনিয়ার গরল উগরে দেয়, আর ভেতরে আন্তরিক। মালবাবু, যিনি স্টেশনে মালের তালিকাভুক্তকরণ করেন, তার খুব মুখ খারাপ। কথায় কথায় সে জয়নালকে ধুয়ে দেয়—গালিগালাজ করে, অভিশাপ দেয়। কিন্তু অন্তরে লালিত করে জয়নালের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা। এ প্রসঙ্গে হুমায়ূন বলেন, 'যাদের মুখ খারাপ তাঁদের মনটা থাকো ভালো। যা কিছু খারাপ মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। জমে থাকছে না।'
অন্যদিকে তথাকথিত ভদ্রসমাজ সুশীলতার আড়ালে হাসি দিয়ে সাময়িকভাবে এড়িয়ে গেলেও তারা আখেরে অপরের ক্ষতি করার জন্য উন্মুখ থাকে। লেখকের ভাষায়, 'ভদ্রলোকরা খারাপ কিছুই মুখ দিয়ে বলেন না। সব জমা হয়ে থাকে। তাদের জামাকাপড় পরিষ্কার, কথাবার্তা পরিষ্কার, চালচলন পরিষ্কার আর মনটা অপরিষ্কার। এমন অপরিষ্কার যে সোডা দিয়ে জ্বাল দিলেও পরিষ্কার হবার উপায় নেই।'
আশাবাদী মানুষ দুঃখের মাঝেও সুখের রেশ খুঁজে বেড়ান। ঘনঘোর মেঘের ভেতর সূর্যের দেখা মিলবে, এই আশা মনে চাষ করে অনেকে। রেলস্টেশনে কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশ এসে নম্বরী কুলিদের নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সেটা আদর করে নয় নিশ্চয়। মার ছাড়া কথা বলে না তাদের সঙ্গে। তো, এরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়ে আমাদের মূল চরিত্র জয়নালের উপলব্ধি হলো, 'অন্তত পুলিশের কারণে হলেও বাপ- মা'র কথা মনে পড়ে।' পুলিশের নির্যাতনের মধ্যেও সে কিছুটা ইতিবাচকতা খোঁজার চেষ্টা করে। আসলে এ হচ্ছে জীবনে কিছু একটা করে চালিয়ে যাওয়ার নামান্তর।
আত্মীয়-স্বজনহীন মানুষ জয়নাল। স্টেশনই তার আত্মীয়। বাসস্থান। কর্মস্থলও বলা চলে। জয়নাল এখানে একা। তার মতো শত বাউণ্ডুলে মানুষের বসবাস এই গৌরীপুর জংশন। আর কে নারায়ণের দ্য গাইড উপন্যাসের রাজু'র সঙ্গে কিছু জায়গায় মিলে যায় জয়নালের। তবে অমিল বেশি। রাজু পায়, আর জয়নাল হারায়। দুজনেরই জীবন রেলস্টেশন নির্ভর।
রেলস্টেশনে জীবন কেমন, সেখানে যাদের জীবন অতিবাহিত তাদের কথা, যাপন ও দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার একটা মোক্ষম সুযোগ হুমায়ূন আহমদের 'গৌরীপুর জংশন' পাঠ।
Comments