‘কখনো এসেছ নুহাশ পল্লীতে?’

Humayun Ahmed
হুমায়ূন আহমেদ। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

শ্রাবণ মাস। প্রথমবার নুহাশ পল্লীতে গিয়েছি। সঙ্গে আছেন আলোকচিত্রী এটিএল আকাশ। নন্দিত লেখক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হুমায়ূন আহমেদের সহকারী পরিচালক জুয়েল রানা পরিচয় করিয়ে দিলেন কথার জাদুকরের সঙ্গে।

প্রথম দেখাতেই তিনি বললেন, 'আগে কখনো এসেছ নুহাশ পল্লীতে?'

বললাম, না, স্যার। আসিনি।

তিনি মৃদু হেসে বললেন, 'তাহলে চলো, তোমাদের নুহাশ পল্লী ঘুরিয়ে দেখাই। এখানকার গাছের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। জানো তো, এখানে অনেক প্রজাতির ঔষুধি গাছ আছে।'

আমি বললাম, নুহাশ পল্লীর গাছ সম্পর্কে আপনার লেখায় পড়েছি।

একটি গাছ দেখিয়ে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, এই গাছটির নাম রসুন্দি। গাছের পাতার গন্ধ আর রসুনের গন্ধ একই।

একটা পাতা ছিঁড়ে হাতের তালুতে ঘষে দেখতে বললেন তিনি। তাই করে দেখলাম, সত্যি সত্যি রসুনের মতোই গন্ধ।

আরেকটি গাছের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, এই গাছের পাতায় সব মসলার স্বাদ আছে। একদিন মুরগির মাংসের সঙ্গে মসলা হিসেবে দিয়ে রান্না করেছিলাম। ভারী সুস্বাদু।

ওই গাছেরও একটি পাতা হাতের তালুতে নিয়ে ঘষে অবাক হলাম! সত্যি সত্যি মনে হলো যেন সব মসলা একত্রে করা হলো হাতের মুঠোয়।

এক ফাঁকে আলোকচিত্রী আকাশ ভাইকে কানে কানে বললাম, যত পারেন ছবি তুলে রাখেন। আকাশ ভাই ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

এবার অন্য একটি গাছের কাছে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, 'এই গাছের একটি পাতা মুখে নিয়ে চিবোতে থাকো, চিনির মতো স্বাদ পাবে।' আবারও অবাক হলাম। মনে মনে মনে ভাবলাম, কেবল কথা নয়, তিনি তো গাছেরও জাদুকর!

বৃহদাকারের একটি লজ্জাবতী গাছ দেখিয়ে তিনি জানতে চাইলেন, এমন গাছ কখনো দেখেছি কি না।

বললাম, স্যার, শহর কিংবা গ্রামে ছোট আকারের লজ্জাবতী গাছ অনেক দেখেছি। কিন্তু এইরকম বড় লজ্জাবতী গাছ কখনো দেখিনি।

এরপর একে একে কমলা, জাম্বুরাসহ বেশকিছু ফলের গাছ চেনালেন। একটি ছোট্ট জাম্বুরা ছিঁড়ে সঙ্গে থাকা পুত্র নিষাদকে দিলেন।

অন্য একটি গাছ দেখিয়ে বললেন, এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুব কাজের। আরেকটি গাছ দেখিয়ে বললেন, এটি মাদ্রাজ থেকে আনা। মাদ্রাজিরা তরকারি রান্না করার সময় মসলা হিসেবে এটা ব্যবহার করে।

এভাবে প্রায় ঘণ্টাখানেক হেঁটে হেঁটে নানা ধরনের গাছের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। পুরো সময়টা কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। স্বপ্নের লেখকের সঙ্গে প্রথমবারের সাক্ষাৎ। মনে এক ধরনের ভয়-দ্বিধা কাজ করছিল। এত সাবলীলভাবে তিনি কথা বলছিলেন, বিশ্বাসই হচ্ছিল না। প্রথম দেখাতেও মুহূর্তেই কত আপন করে নিলেন তিনি! যেভাবে নুহাশ পল্লী ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন, মনে হলো কত দিনের পরিচয় আমাদের! কত স্নেহ!

হাঁটতে হাঁটতে আচমকাই জিজ্ঞেস করলেন, 'বলো তো, গাছের যে প্রাণ আছে, তা কে আবিষ্কার করেছিল?'

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে লেখক।

বললাম, জগদীশ চন্দ্র বসু। এরপর আমি বললাম, স্যার একটা প্রশ্ন করতে পারি?

হেসে বললেন, করো।

বললাম, স্যার, এই নির্জন জায়গাটি কেন পছন্দ হলো আপনার?

জানালেন, একটিই কারণ। একসঙ্গে এই পরিমাণ জমি সেখানেই পেয়েছেন। তা ছাড়া আর কোনো কারণ নেই।

গাছ দেখার পর্ব শেষ হতেই একজন এসে বললেন, স্যার সেট রেডি।

শুটিং করার জন্য লীলাবতী দিঘির পাড়ে গেলেন তিনি। আমরাও সঙ্গে গেলাম। দিঘির ওপর একটি কাঠের ব্রিজ আছে। তার ওপর শুটিং হবে।

শুটিংয়ের সময় হুমায়ূন আহমেদ। ছবি সৌজন্য: শাহ আলম সাজু

হুমায়ূন আহমেদ বললেন, পেছনের তাঁবুটা ভালো লাগছে না, খুলে ফেল।

তাঁবু খোলার দৌড়ঝাঁপ শুরু হলো।

তিনি ছবি তোলার জন্য একজনকে ক্যামেরা আনতে বললেন। দ্রুত ক্যামেরা চলে এলো। তাঁবু ঠিক হচ্ছে, আর এদিকে তিনি পুত্র নিষাদকে নিয়ে একটু দূরে ঘাসের ওপর বসলেন।

নিষাদকে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসতে বললেন। তিনি কয়েকটি ছবি তুললেন। উনার ছবি তোলার ছবি তুলতে বললাম আলোকচিত্রী আকাশ ভাইকে।

এদিকে তাঁবু তুলে ফেলার কাজ শেষ। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন মেহের আফরোজ শাওন ও মীর সাব্বির। তারা দাঁড়ালেন কাঠের ব্রিজের ওপর। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় দাঁড়ালেন যেখানে তাঁবু ছিল সেখানটায়।

মনিটরে চোখ রাখলেন হুমায়ূন আহমেদ। আমাকে বললেন, 'শুটিং কেমন লাগছে?'

ভালো লাগছে বলে জানালাম।

এবার তিনি কাজে মনোনিবেশ করলেন। নির্দেশনা দিতে শুরু করলেন। শুরু হলো দৃশ্য ধারণের কাজ। বেশ ভালোভাবেই দৃশ্যটি ধারণ শেষ হলো।

মীর সাব্বির বললেন, 'স্যার, আরেকবার সংলাপ দেবো?'

তিনি বললেন, 'লাগবে না, গুড শট।'

সহকারী পরিচালক জুয়েল রানা বললেন, 'স্যার পরের দৃশ্যগুলো ঘাটের কাছে করব। বৃষ্টি পড়ার দৃশ্যটি করব।'

হুমায়ূন আহমেদ বললেন, সেট রেডি করো। লাঞ্চ ব্রেক দিয়ে দাও। লাঞ্চের পর বাকি শুটিং হবে।

সেই ফাঁকে আমি বললাম, স্যার, আপনার সঙ্গে ছবি তুলতে পারি?

তিনি বললেন, অবশ্যই।

ফের গাছের কাছে গেলেন। আমরা অনেকগুলো ছবি তুললাম। স্যারের একক ছবিও তুললাম। ছবি তোলা শেষে তিনি দুপুরের খাবার খেতে বললেন।

কথা বলতে বলতেই নিয়ে গেলেন খেজুর গাছের কাছে। বললেন, এই গাছগুলো শখ করে লাগিয়েছি। বিদেশে যদি এসব খেজুর গাছ হতে পারে, তাহলে আমাদের এখানে হবে না কেন?

তার কথায় হাসলাম।

দুপুরের খাবারের জন্য ডাক এলো। স্যার বললেন, দুপুরের খাবার খেয়ে নাও।

লাঞ্চের পর কিছুটা সময় তিনি বিশ্রাম নিলেন। বিকেলে পুনরায় শুটিং শুরু হলো। মীর সাব্বির, শাওন, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় রেডি হচ্ছেন শুটিংয়ের জন্য।

শ্রাবণ মাসের সুন্দর বিকেল। আমার স্বপ্নের লেখক হুমায়ূন আহমেদ পুত্র নিষাদকে নিয়ে নুহাশ পল্লীর ভেতরে হাঁটছেন। আমি ও আলোকচিত্রী আকাশও পেছনে পেছনে হাঁটছি।

হাঁটতে হাঁটতেই জিজ্ঞেস করলেন, 'কেমন লাগলো তোমাদের?'

নিজের অভিব্যক্তি জানালাম।

তিনি বললেন, 'মন চাইলেই এখানে চলে এসো।'

সারা বিকেল শুটিং দেখলাম। সন্ধ্যা হওয়ার আগে বললাম, স্যার, আমরা তাহলে ঢাকায় ফিরি।

বললেন, 'আবার এসো।'

নুহাশ পল্লী থেকে ফেরার সময় সেদিন মনে হচ্ছিল, কথার জাদুকরের সঙ্গে কি সত্যিই একটি বিকেল কাটিয়ে ফিরছি? নাকি স্বপ্ন দেখলাম? মনের মধ্যে এক ধরনের ঘোর নিয়েই সেদিন নুহাশ পল্লী থেকে ফিরেছিলাম ঢাকায়।

আজ ১৯ জুলাই। ২০১২ সালের এই দিনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই বরপুত্র। এই বছর তার ১৩তম প্রয়াণ দিবস। অথচ এখনো মনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় নুহাশ পল্লীতে ১৫ কিংবা ১৬ বছর আগে কাটানো সেই বিকেল। মনে হয়, এই তো সেদিন!

প্রয়াণ দিবসে বাংলা সাহিত্যের এই সম্রাটকে স্মরণ করি শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। তিনি আছেন এখনো, আমাদের হৃদয়ে। থাকবেন চিরঞ্জীবী হয়ে, লাখো মানুষের অন্তরে, ভাবনায়।

Comments

The Daily Star  | English
jamaat-ameer-shafiqur

'Second uprising, this time against corruption'

Says Jamaat chief at party's grand rally at Suhrawardy Udyan

28m ago