‘স্বপ্ন দেখলেই একদিন তা বাস্তবায়িত হবে’

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ছবি: সংগৃহীত

আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সঙ্গে সারাদিন আড্ডা দেবো—এটা ভাবতেও স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। প্রস্তাবটি প্রথম পাই সময় প্রকাশনের কর্ণধার ফরিদ আহমেদের কাছ থেকে। সাদরে তা গ্রহণ করি।

তখন ছিল হেমন্তকাল, ভীষণ সুন্দর প্রকৃতি। আকাশ ছিল সাদা ও নীলে ভরা। দুপুরের আগেই পৌঁছে যাই রাজধানীর কাছেই পূর্বাচলের ছুটি রিসোর্টে।

ওখানে পৌঁছে দেখতে পাই, সাদা পাঞ্জাবি পরা সদা হাস্যোজ্জ্বল আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে ঘিরে ভিড় লেগে আছে। তুমুল আড্ডা শুরু হয়েছে। আড্ডায় অংশ নিই।

একজন আলোকিত মানুষকে ঘিরে সবার চোখ। স্যার কথা বলছেন, আমরা শুনছি। একটার পর একটা গল্প বলেই যাচ্ছেন। তার ধৈর্য দেখে আমরা অবাক! তবে, ঘোর ও বিস্ময় কাটছে না। কেননা, এত কাছ থেকে, এত দীর্ঘ সময় নিয়ে তার কথা আগে কখনো শুনিনি।

হেমন্তকাল বলে কথা। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার গল্প করছেন, আর ওদিকে নানারকম পিঠা চলে এসেছে। খেতে খেতে তিনি বললেন, বুড়ো হওয়ার এই এক সমস্যা, সব খাবার বেশি বেশি খাওয়া যায় না। খেতে ইচ্ছে করলেও সম্ভব না।

বলেই তিনি হাসলেন, আমরাও হাসলাম।

এরপর বললেন, আমরা হচ্ছি উৎসব-প্রিয় জাতি। যেকোনো ঋতুতে আমাদের কোনো না কোনো উৎসব লেগেই থাকে। এটা ভালো। মানুষে মানুষে এক ধরনের ভালোবাসা তৈরি হয়।

মজার মজার গল্প শুনছি স্যারের কাছ থেকে। তিনি বললেন, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বয়স কিন্তু কম হলো না আমার! বেঁচে থাকলে কয়েক বছর পর বলতে পারব, আমি কবিগুরুর থেকেও সিনিয়র। বলেই হাসলেন তিনি।

আমরা মন্ত্রমুগ্ধের তার কথা শুনছি।

কেউ একজন বললেন, স্যার, আপনার আরও বেশি করে লেখালেখি করা দরকার ছিল।

স্যার বললেন, তোমার কথা ঠিক আছে। কিন্তু একটি সংগঠন করতে গেলে যে রকম সময় ও শ্রম দিতে হয়, তাতে করে লেখালেখির জন্য সময় বের করা মুশকিল।

স্যারের সঙ্গে আড্ডায় আমরা যারা ছিলাম, তাদের একজনকে দেখিয়ে বললেন, 'শুনো, ও কিন্তু আমার সরাসরি ছাত্র ছিল ঢাকা কলেজে। একবার হয়েছে কী, ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চিন্তায় পড়ে গেলাম, কী করা যায়? তারপর ওর বাড়িতে আরও দুজন ছাত্র পাঠিয়ে দিলাম। বলে দিলাম, ধরে নিয়ে আসবে। তারপর ধরে নিয়ে এলো। আসার পর বললাম, কী ব্যাপার হে? ক্লাস বাদ দিয়ে কোথায় হাওয়া হয়েছিলে? জবাবে ও বলল, স্যার ঢাকায় থাকার জায়গা নেই। তারপর ওর জন্য থাকার ব্যবস্থা হলো। খুব মেধাবী ছিল। সম্ভবত, প্রথমবারেই বিসিএসে চান্স হয়ে যায়।'

আড্ডায় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

এদিকে দুপুর গড়িয়ে আসছে। একটু পর দুপুরের খাবার খেতে হবে। প্রকাশক ফরিদ আহমেদ বললেন, স্যার আমরা কি এখন দুপুরের খাবার খেতে যেতে পারি? নাকি আরেকটু পর?

স্যার বললেন, খেতে যখন হবেই, তাহলে চলো এখনই...

অনেক সময় চেয়ারে বসেছিলেন। কয়েকজন স্যারকে উঠাতে এলেন। তিনি বাধা দিলেন। বললেন, এখনো একা একা উঠতে পারি। ভেবো না, পড়ে যাব না। বুড়ো হয়েছি, কিন্তু ওইটুকু শক্তি তো আছে।

দুপুরের খাবার খাওয়ার আগে কয়েক মিনিট সময়ে নিলেন স্যার। পুরো রিসোর্টটি ঘুরে দেখলেন। বড় বড় তালগাছ দেখে বললেন, 'শহর থেকে একটু দূরে এতবড় তালগাছ পাব ভাবিনি। জায়গাটা চমৎকার। অনেকদিন পর একটা জায়গা আমাকে আকৃষ্ট করেছে।'

ততক্ষণে রিসোর্টটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমগীর ফেরদৌস চলে এসেছেন। ফরিদ আহমেদ স্যারের কাছে নিয়ে গিয়ে আলমগীর ফেরদৌস ও আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

ফরিদ আহমেদ বললেন, স্যার, ওরা দুজন ছোটবেলার বন্ধু।

স্যার ভালো করে তাকালেন এবং  বললেন, 'কী ব্যাপার? তোমরা দুজন বন্ধু, অথচ একজনের চুল পুরোটা পেকে গেছে, আরেকজনের পাকেনি?'

স্যারের কথায় হাসলাম আমরা।

স্যার জানতে চাইলে বললেন, রিসোর্টের নাম ছুটি কেন?

আলমগীর ফেরদৌস জানালেন, রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্প থেকে নামটি নিয়েছেন।

স্যার বললেন, নামটা দারুণ। তারপর জানতে চাইলেন, তোমাদের দুজনের বাড়ি কোথায়?

আমরা বললাম, সখীপুর।

স্যার জানতে চাইলেন, কোন সখীপুর?

বললাম, টাঙ্গাইল জেলার সখীপুর।

স্যার বললেন, 'আমার আব্বা করটিয়া কলেজে শিক্ষকতা করতেন। ওখানে বেশ কবছর কেটেছে আমার ছেলেবেলায়। সখীপুর গিয়েছি অনেক আগে। তখন একবার রাস্তার মধ্যে বাঘ দেখেছিলাম।'

দুপুরের খাবার দেওয়া হয়েছে।

সবাই ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছি। স্যারের সঙ্গে তার মেয়েও ছিলেন। খেতে খেতে বললেন, খাবার ভালো হয়েছে। এখানকার সবকিছুই ভালো লাগছে।

খাবার শেষ করার পর স্যারের জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হলো। এক ঘণ্টা তিনি বিশ্রাম নিলেন। শেষ বিকেলে স্যার আবারও আড্ডা শুরু করলেন সবুজ ঘাসের ওপর রাখা চেয়ারে বসে।

হেমন্তের বিকেলে চা দিয়ে আড্ডা শুরু হলো।

আড্ডায় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।

চা খেতে খেতে স্যার বললেন, আড্ডা জীবনের অংশ। আড্ডার দরকার আছে। তবে, সত্যিকারের নির্মল আড্ডা হতে হবে। আড্ডা ছাড়া চলে নাকি! ভালো আড্ডা থেকে কত ভালো ভালো কাজের পরিকল্পনা বের হয়ে আসে।

কেউ একজন বললেন, স্যার, পুরান ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একটি ভবন হলে ভালো হতো।

স্যার বললেন, হবে। তারপর হাসতে হাসতে বললেন, না হলেও বলতে হবে যে হবে। স্বপ্ন দেখতে হবে। স্বপ্ন দেখাতে হবে। স্বপ্ন দেখলেই একদিন তা বাস্তবায়িত হবে। স্বপ্ন দেখতে দেখতেই আমরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র করেছি।

অন্য একজন স্যারকে বলছেন, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের বইয়ের গাড়িগুলো নাকি সরকার নিতে চাচ্ছে। এটা কি সত্যি স্যার?

তিনি বললেন, প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু আমরা রাজি হইনি। এই কাজ ওদের দিলে আর বই পড়াতে হবে না।

আড্ডায় বেশকজন লেখক যেমন ছিলেন, বেশ কজন প্রকাশকও ছিলেন।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। স্যার বললেন, এবার উঠতে হবে। এখানে একটা দিন কাটিয়ে দেবো চিন্তাও করিনি। ভালো লেগেছে বলেই উঠতে ইচ্ছে করেনি।

স্যারকে জানানো হলো, তার সম্মানে সন্ধ্যায় পিঠা উৎসব হবে এবং ফানুস উড়ানো হবে। স্যার শুরুতে রাজি না হলেও সবার অনুরোধে না করলেন না।

স্যারের সামনেই পিঠা তৈরি হচ্ছে এবং আমরা সবাই খাচ্ছি। স্যারও অল্প অল্প খাচ্ছেন। এরপর ফানুস উড়ানো হলো। তিনি খুশি হলেন।

ফেরার পালা। তিনি বললেন, সত্যিই আজ মন খুলে আড্ডা দিলাম। এইরকম আড্ডার দরকার আছে। সময় পেলে আবারও একদিন আসব।

সবশেষে রিসোর্টের এমডি আলমগীর ফেরদৌস ও আমাকে বললেন, তোমরা ভালো থেকো। বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই আরেকদিন এরকম আড্ডা দেবো।

তারপর স্যার বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবেন, তখন রিসোর্টে আসা কয়েকজন অতিথি স্যারের সঙ্গে সেলফি তোলার জন্য এলেন। তিনি না করলেন না।

এখানেও দাঁড়িয়েই তিনি আড্ডা দিতে লাগলেন। আলোকিত মানুষের আড্ডা যেন শেষ হয় না!

আজ ২৫ জুলাই অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের জন্মদিন। নির্মল এই মানুষটির জন্মদিনে তার জন্য অসংখ্য শুভ কামনা। বাকি জীবন তিনি এভাবেই আমাদের আলোকিত করে যাবেন, সেই প্রত্যাশাই করি।

Comments