জুলাই ৩৩: ‘দ্রোহযাত্রা’ থেকে সরকারের পদত্যাগ দাবি, বিক্ষুব্ধ জনতার দখলে রাজপথ

শুরুতে এই কর্মসূচির নাম ঠিক করা হয় 'শোকযাত্রা'। পরে বিভিন্ন স্তরের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে কর্মসূচি ঘোষণার এক দিনের মাথায় নাম পরিবর্তন করে 'দ্রোহযাত্রা' রাখা হয়।
উদ্যোক্তাদের ধারণা ছিল, ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে চব্বিশের ২ আগস্ট অর্থাৎ ৩৩ জুলাইয়ের এই কর্মসূচিতে বড়জোর হাজার দুয়েক মানুষের জমায়েত হতে পারে।
কিন্তু সেই ধারণা ভেঙে দিয়ে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পাশাপাশি আটক সব শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিককে ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে সেদিনের 'দ্রোহহযাত্রা'য় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিল্পী, আইনজীবী, উন্নয়নকর্মী, মানবাধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন।
এর পাশাপাশি যুক্ত হন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও প্রেসক্লাব এলাকায় 'বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ'- এর এই কর্মসূচিতে সেদিন জনতার ঢল নামে।
এই কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সেখান থেকে কোটা আন্দোলন ঘিরে দেশজুড়ে প্রাণহানির দায় নিয়ে সরকারকে 'ক্ষমা চেয়ে' পদত্যাগ করার দাবি জানান তিনি।
দ্রোহযাত্রা শুরুর আগে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে আনু মুহাম্মদ বলেন, 'যারা হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল তাদের বিচার করতে হবে। এ হত্যাকাণ্ডের দায় শিকার করে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। আমাদের প্রধান আলোচ্য বিষয়, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে।'
আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, '৫২ সালের পর থেকে অনেক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু মাত্র কয়েকদিনে এ রকম হত্যাযজ্ঞ কেউ করেনি। সরকার ভেবেছিল এরকম নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালালে আন্দোলন দমে যাবে। কিন্তু প্রতিবাদ আরও বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের পাশে শিক্ষক, অভিভাবক ও নাগরিক সমাজ দাঁড়িয়েছে।'
দেশকে এ সরকারের কাছ থেকে 'মুক্ত করতে' শিক্ষক-শিক্ষার্থী, নারী-পুরুষ একত্রিত হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন আনু মুহাম্মদ। বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আর কাউকে 'ব্যবসা' করতে দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে জনতার হাতে আনতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রকৃত জায়গায় ফিরিয়ে নিতে হবে।

সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী বিকাল পৌনে চারটায় জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দিকে রওনা হয়।
মিছিলকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর প্রবেশমুখে পুলিশের ব্যারিকেড সরিয়ে ফেলে। সেখানে শ খানেক পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা বাধা দেয়নি।
সবাই বৃষ্টির মধ্যেই প্রায় আড়াই ঘণ্টা শহীদ মিনারে অবস্থান নিয়ে 'শহিদের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না', 'লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই', 'শেখ হাসিনার গদিতে, আগুন জ্বালাও একসাথে', 'রক্তের দাগ দিচ্ছে ডাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক'- বলে স্লোগান দেন।
এদিন খুলনায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশের একজন কনস্টেবল নিহত হন। হবিগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মোশতাক মিয়া (২৫) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যুর খবর আসে।
এছাড়া আন্দোলন ঘিরে শিক্ষার্থী হত্যার বিচার এবং গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রাজধানীর সায়েন্সল্যাব, ইসিবি চত্বর, মিরপুর-১০, উত্তরা, পল্টনসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকরাও নেমে আসেন রাস্তায়। উত্তরায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
উত্তরায় গলিতে গলিতে ঢুকে আন্দোলনকারীদের মারধর
এদিন ঢাকার উত্তরায় বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ।
এ সময় ১১ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন গলিতে ঢুকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে পুলিশ ও সরকার সমর্থকরা।
বিকেলে মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় হেলমেটধারী কিছু ব্যক্তি।

চট্টগ্রামে জুমার নামাজের পর গণমিছিল
শুক্রবার জুমার নামাজের পর চট্টগ্রাম নগরের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ থেকে গণমিছিল বের করেন মুসল্লিরা।
প্রথমে মসজিদের সামনে পাঁচ থেকে ১০ মিনিট অবস্থান করে টেরিবাজার ও লালদীঘি হয়ে মিছিল এগিয়ে যায়।
পরে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যান বিক্ষোভকারীরা।
বৃষ্টি কমে এলে নিউমার্কেট এলাকায় জড়ো হয়ে অবস্থান নেন তারা।
সিলেটে গণমিছিলে টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড
শিক্ষার্থী হত্যা ও গণগ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সিলেটে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলনে নামলে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে পুলিশ।
এদিন বিকেল ৩টা থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকেন।
সেখানে শাহজালালের পাশাপাশি সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, লিডিং ইউনিভার্সিটি, মেট্রোপলিটন, টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, এম সি কলেজে, সিলেট সরকারি কলেজ, মদন মোহন কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেন।
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও ওই মিছিলে অংশ নিতে দেখা যায়। পরে গণমিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে সিলেটের মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের সামনে গেলে পুলিশ পেছন থেকে টিয়ারগ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
এসময় শিক্ষার্থীরাও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন।

ধানমন্ডিতে শিল্পীসমাজ ও বনানীতে অভিভাবকদের অবস্থান
'দ্রোহযাত্রা' কর্মসূচির পাশাপাশি ২ আগস্ট ঢাকার ধানমন্ডির আবাহনী মাঠের সামনে 'গণহত্যা ও নিপীড়নবিরোধী শিল্পীসমাজ'- এর ব্যানারে ছাত্র-জনতার হত্যার প্রতিবাদে শামিল হন শিল্পীরা। সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই এই সমাবেশ হয়।
শিল্পীদের মূল বক্তব্য ছিল বিক্ষোভের সময় নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে এবং তাতে যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর বিচার করতে হবে।
তারা বলেন, কারফিউ জারির পর থেকে নিরাপত্তা বাহিনী নির্বিচারে গ্রেপ্তার করছে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে। রাত-বিরাতে বাসা থেকে ছাত্রদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এটার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান।
শিল্পীদের ওই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে স্থানীয় বাসিন্দা ও পথচারীদেরও অংশ নিতে দেখা যায়।
এদিন বনানীতে শিক্ষার্থীদের দাবির পক্ষে ও সব হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে অবস্থান নেন অভিভাবকরাও।
যৌথ বিবৃতিতে নাহিদরা জানালেন—ভিডিও বার্তা তারা স্বেচ্ছায় দেননি
ডিবি কার্যালয় থেকে ১ আগস্ট ছাড়া পেয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির ছয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও নুসরাত তাবাসসুম।
২ আগস্ট রাতে এই সমন্বয়করা গণমাধ্যমে একটি যৌথ বিবৃতি পাঠান। এতে বলা হয়, আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা-সংক্রান্ত ডিবি কার্যালয় থেকে প্রচারিত ভিডিও বিবৃতিটি তারা স্বেচ্ছায় দেননি।
এতে বলা হয়, 'আন্দোলন প্রত্যাহার করে ডিবি অফিস থেকে প্রচারিত ছয় সমন্বয়ককের ভিডিও স্টেটমেন্টটি আমরা স্বেচ্ছায় দেইনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সিদ্ধান্ত ডিবি অফিস থেকে আসতে পারে না। সারাদেশের সকল সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ব্যতীত কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গৃহীত হবে না।'
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'ডিবি অফিসে আমাদের জোর করে খাবার টেবিলে বসিয়ে ভিডিও করা হয়। আমাদের ছেড়ে দেবার আশ্বাস দিয়ে পরিবারকে ডেকে ১৩ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয় এবং মিডিয়ায় মিথ্যা স্টেটমেন্ট দেওয়ানো হয়। আমাদের শিক্ষকরা দেখা করতে আসলে, দেখা করতে দেওয়া হয়নি।'
সহিংসতায় ৩২ শিশু নিহতের তথ্য দিলো ইউনিসেফ
২ আগস্ট বাংলাদেশে কোটা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় অন্তত ৩২ শিশু নিহত হওয়ার তথ্য দিয়ে এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ।
সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্রধান সঞ্জয় উইজেসেকেরা এক বিবৃতিতে বলেন, ইউনিসেফ নিশ্চিত হয়েছে যে জুলাই মাসের আন্দোলনে সংঘটিত সহিংসতায় অন্তত ৩২ শিশু নিহত এবং আরও অনেক শিশু আহত ও আটক হয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার কনভেনশনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিশুদের আটকের প্রভাব নিয়ে গবেষণার ভিত্তিতে, ইউনিসেফ সব ধরনের শিশুদের আটক বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছে। নিছক উপস্থিতির ভিত্তিতে বা তাদের ধর্ম, পরিবারের সদস্যদের কাজ বা বিশ্বাসের কারণে শিশুদের গ্রেফতার বা আটক করা উচিত নয়।
সারাদেশে ৭৮ এইচএসসি পরীক্ষার্থীর জামিন
কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে সহিংসতা ও নাশকতামূলক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ৭৮ এইচএসসি পরীক্ষার্থী এদিন দেশের বিভিন্ন আদালত থেকে জামিন পায়।
এদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের ৫৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগের ১৪ জন, খুলনা বিভাগের ছয় জন ও রংপুর বিভাগের তিন জন পরীক্ষার্থী ছিল।
Comments