মোদির ভারতে মুঘলরা ‘বিদেশি শত্রু’, ইতিহাসবিদ রিচার্ড ইটনের ‘প্রতিবাদ’

লাল কেল্লা

ভারতে ইদানীং প্রায়ই মুঘল সাম্রাজ্যকে 'বিদেশি' শক্তি হিসেবে চিত্রিত করা হয়। নতুন ইতিহাস শেখাতে দেশটির কয়েকটি রাজ্যে স্কুল-কলেজের পাঠ্যবই সংশোধন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময় ভারতীয় গণমাধ্যমেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

সমালোচকদের মতে, পাঠ্যবই সংশোধনের মাধ্যমে ভারতের বহুত্ববাদী অতীতকে মুছে ফেলে একটি হিন্দুত্ববাদী বয়ান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে বর্তমান বিজেপি সরকার।

করোনা মহামারির সময় শিক্ষার্থীদের সিলেবাসের বোঝা কমানোর কথা বলে পাঠ্যবই থেকে মুঘলদের ইতিহাসের ওপর লেখা অধ্যায়গুলো কাটছাঁট করা হয়। শুধু মুঘলদের ইতিহাসই নয়, কোপ পড়ে মহাত্মা গান্ধীর হত্যার ঘটনার বিবরণেও। সংশোধিত বইয়ে গান্ধীকে হত্যাকারী নাথুরাম গডসের সঙ্গে হিন্দু মহাসভা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সংশ্লিষ্টতার ইতিহাসও বাদ দেওয়া হয়।

সেই সঙ্গে, দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে মুঘল দরবারের ৩০ পৃষ্ঠার পুরো অধ্যায় মুছে ফেলা হয়। মুঘলদের চিত্রিত করা হয় 'শোষক ও বর্বর' হিসেবে। মহীশুরের টিপু সুলতানকে আখ্যা দেওয়া হয় 'হিন্দুদের গণহত্যাকারী' হিসেবে।

এমনকি, ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান রাজস্থানের হলদিঘাটিতে হিন্দু রাজপুত মহারানা প্রতাপের সঙ্গে মানসিংহের নেতৃত্বে আকবরের সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে রাজপুতরা পরাজিত হলেও সেই রাজ্যের মাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ে বলা হয়, যুদ্ধের ফলাফল 'অমীমাংসিত' ছিল।

মুঘলদেরকে শত্রু হিসেবে হাজির করা নতুন এই বয়ানের সঙ্গে একমত নন মার্কিন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক রিচার্ড এম ইটন।

ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে গবেষণার জন্য খ্যাতিমান এই অধ্যাপকের মতে—মুঘলরা বিদেশি নয়, বরং পুরোপুরিভাবে ভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা এই দেশের মাটি-সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল।

সম্প্রতি ভারতের সংবাদমাধ্যম 'দ্য ওয়্যার'-কে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।

রিচার্ড এম ইটন

ইটনের ভাষ্য—ষোড়শ শতকে যখন মুঘলরা ক্ষমতায় আসে, তখন 'দেশি' ও 'বিদেশি' সংজ্ঞা বা আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের অস্তিত্বই ছিল না। তিনি বলেন, 'সময়টা জাতিরাষ্ট্রের ছিল না। প্রজাদের আনুগত্য ছিল ব্যক্তির প্রতি; রাজা বা তার বংশের প্রতি।'

তাই আধুনিক মানদণ্ডে মুঘলদের বিদেশি হিসেবে বিচার করা 'ঐতিহাসিক ভুল' বলে মনে করেন তিনি।

মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর উজবেকিস্তানের ফারগানায় জ্ঞাতি ভাইদের হাতে পরাজিত হয়ে আফগানিস্তানের দিকে অগ্রসর হন। কাবুল জয় করার পর তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারে দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদীর বাহিনীকে আক্রমণ করেন। দিল্লির অদূরে হরিয়ানার পানিপথের যুদ্ধে তিনি লোদীকে পরাজিত করে দিল্লির মসনদে বসেন। তার হাত ধরে ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয় মুঘল সাম্রাজ্য। তার প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে 'ভারতীয়' হয়ে উঠেছিল, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইটন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে মুঘলদের মৌলিক পার্থক্যও তুলে ধরেন।

ইটনের মতে, এই পার্থক্যই মুঘলদের ভারতীয় পরিচয়ের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। তিনি বলেন, 'মুঘলরা তাদের সম্পদ ভারতেই বিনিয়োগ করেছেন। তারা তাদের স্থাপত্য এখানে তৈরি করেছেন। তাদের সমাধিও এখানেই। ভারতই ছিল তাদের স্বদেশ।'

এর বিপরীতে ব্রিটিশদের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, ব্রিটিশরা ভারতের সম্পদ শোষণ করে ইংল্যান্ডে পাচার করেছে। এটাই হলো মৌলিক পার্থক্য। ব্রিটিশদের একটি 'মেট্রোপোল' বা মূল কেন্দ্র (ইংল্যান্ড) ও একটি 'কলোনি' বা উপনিবেশ (ভারত) ছিল। কিন্তু মুঘলদের জন্য ভারতই ছিল মেট্রোপোল।'

অধ্যাপক ইটনের বক্তব্য—মুঘলরা শুধুমাত্র শাসনই করেনি, বরং এদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। তারা রাজপুতদের মতো স্থানীয় শক্তিগুলোর সঙ্গে বৈবাহিক ও সামরিক জোট তৈরি করে একটি স্থিতিশীল ও দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। এর মাধ্যমে রাজপুতরা মুঘল সাম্রাজ্যের 'সহ-অংশীদার' হয়ে ওঠেন।

একইসঙ্গে মুঘলরা এদেশের শিল্প, স্থাপত্য, সংগীত ও সাহিত্যের বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এর ফলে একটি অনন্য মিশ্র সংস্কৃতির জন্ম হয়, যা তাদের ভারতীয় পরিচয়কেই শক্তিশালী করে।

ভারতে যখন মুঘল শাসকদের 'অত্যাচারী বিদেশি' হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন রিচার্ড ইটনের এই বিশ্লেষণ নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

'মুঘলদের বিচার তাদের জন্ম-পরিচয় দিয়ে নয়, বরং উপমহাদেশে তাদের তিন শতাব্দীরও বেশি সময়ের শাসন, সাম্রাজ্যের বিনির্মাণ ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার দিয়ে করা উচিত,' বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

When homes become killing grounds

Husbands killed 19 women on average each month this year

1h ago