‘আমার জানাজায় যেন কেউ না কাঁদে’

মৃত্যুর আগে দুটো ইচ্ছের কথা জানিয়েছিলেন সাংবাদিক মারিয়াম আবু ডাগ্গা। একটা তার সহকর্মীদের কাছে—তার জানাজায় যেন কেউ না কাঁদে। আরেকটা তার ১৩ বছরের ছেলে গাইথের জন্য— 'মা গর্ব করতে পারে এমন কিছু যেন ছেলে করে।'
গতকাল ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় দক্ষিণ গাজায় একটি হাসপাতালে কমপক্ষে ২০ জন মারা গেছেন। প্রথমে হাসপাতালটিতে বোমা ফেলা হলে আহতদের উদ্ধারে সেখানে ছুটে যান আশেপাশের উদ্ধারকারী ও সাংবাদিকরা। ১৫ মিনিট পর একই লক্ষ্যস্থলে আবারো হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। হামলায় অন্যান্যদের সঙ্গে যে পাঁচজন সাংবাদিক মারা যান মারিয়াম তাদের একজন।
মারিয়াম না চাইলেও তার জানাজায় তার সহকর্মীরা চোখের পানি আটকাতে পারেননি। আল-নাসের হাসপাতালে এক সহকর্মী আহত হওয়ার খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন মারিয়াম। এই হাসপাতাল থেকেই বেশিরভাগ সময় গাজা যুদ্ধের সংবাদ পুরো বিশ্বকে জানিয়েছেন তিনি।
'তার বিদায়ের সময় কেউ জানি আমরা না কাঁদি এটাই ওর ইচ্ছা ছিল। ও চেয়েছিল যেন শেষ সময়টা কথা বলি ওর সাথে, কিছুটা সময় কাটাই, ওকে আমরা অন্তর দিয়ে অনূভব করি,' দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন মারিয়ামের কাছের বন্ধু ২১ বছর বয়সী ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক সামাহির ফারহান।
গাজায় ফারহানের মতো আরও অনেক সাংবাদিকের জন্য অনুপ্রেরণা ছিলেন ফটোসাংবাদিক মারিয়াম। তারা তার ক্লান্তিহীন রিপোর্টিংকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। যদিও যুদ্ধের সময় মারিয়ামকে ব্যক্তিগতভাবে গভীর ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছিল।
সাংবাদিক হিসেবে তার পরিচিতি এসেছিল এক ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে। ২০১৮ সালে গাজার 'গ্রেট মার্চ অফ রিটার্ন' বিক্ষোভোর সময় তিনি একজন বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর দৃশ্য ধারণ করেছিলেন, যাকে গুলি করে হত্যা করেছিল ইসরায়েলি সেনারা। বিক্ষোভে ইসরায়েলি বাহিনী গাজা সীমান্তের দিকে এগিয়ে যাওয়া বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছিল, যাতে ২২০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত এবং ৯ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়।
মারিয়াম পরে জানতে পারেন, গুলিবিদ্ধ নিহত সেই বিক্ষোভকারী ছিলেন তার ভাই।
গত ২২ মাস ধরে চলমান গাজা যুদ্ধে তিনি সাংবাদিকতা করে গেছেন অবিচলভাবে। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেছেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এবং ইন্ডিপেনডেন্ট আরাবিয়া-র সঙ্গে।
ইন্ডিপেনডেন্ট আরাবিয়া তাকে আখ্যা দিয়েছে 'অঙ্গীকার ও পেশাদারত্বের উজ্জ্বল উদাহরণ' হিসেবে। তাদের মতে, তিনি 'ক্যামেরা হাতে যুদ্ধের ময়দানের একেবারে মাঝখানে পৌঁছে যেতেন'। বেসামরিক নাগরিকদের দুর্ভোগ ও ভুক্তভোগীদের কণ্ঠস্বরকে বিরল সততা ও সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন মারিয়াম।
তার ছবি ও প্রতিবেদনে সবসময় মানবিক দিকটিই উঠে এসেছে, বিশেষ করে গাজার বেসামরিক মানুষের কষ্ট-দুর্দশা আর ভয়াবহতার চিত্র।
তার একটি ছবিতে দেখা যায় পাঁচ বছর বয়সী জামাল আল-নাজ্জারকে। ছোট্ট শিশুটি মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে না খেতে পেয়ে, অপুষ্টিতে মারা গেছে। শিশুটির ছোট দেহটি একটি সাদা কাপড়ে মোড়ানো ছিল এবং আলতো করে ইটের ওপর রাখা হয়েছিল যাতে মাটিতে স্পর্শ না করে। অন্য একটি ছবিতে দেখা যায়, গাজার দক্ষিণে একটি ত্রাণের ট্রাক থেকে খাবার পাওয়ার আশায় শতাধিক মানুষ একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
সহকর্মীদের কাছে মারিয়াম তার মানবিকতা এবং নিষ্ঠার জন্যও পরিচিত ছিলেন।
ফারহান বলেন, 'মারিয়াম অত্যন্ত দয়ালু, কোমল এবং তার কাজের প্রতি ভীষণ নিষ্ঠাবান ছিলেন। তিনি তার মা এবং তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আবু আনাসকে হারিয়েছিলেন, তবুও তিনি একদিনের জন্যও যুদ্ধের খবর দেওয়া থামাননি।'
তার খ্যাতি ছিল নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে—গাজার সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকাতেও মারিয়াম রিপোর্ট করেছেন।
গাজার অন্যান্য সাংবাদিকদের মতো তিনিও এই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সাংবাদিক হওয়ার বিপদ সম্পর্কে জানতেন। দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় সাংবাদিকদের জন্য এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়ংকর সময়, যেখানে ১৯২ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের গাজায় সাংবাদিকদের প্রকাশ্যে হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস। তবে সোমবার পাঁচ সাংবাদিক নিহতের ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা 'সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করে না।'
সহকর্মীরা জানান, মারিয়াম তার ছেলেকে প্রায় দেড় বছর ধরে দেখেননি। ছেলে তার বাবার সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আশ্রয় পেয়েছে।
'মারিয়াম তার ছেলেকে আবার দেখার জন্য, জড়িয়ে ধরার জন্য আকুল ছিলেন। সেই স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই তিনি চলে গেলেন,' বলেন ফারহান।
তবে তার ছেলের জন্য মারিয়াম তার শেষ ইচ্ছা রেখে গেছেন। সে যেন তার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করে।
মারিয়াম তার ছেলে গাইথকে এক চিঠিতে লিখেছেন, 'আমি চাই তুমি সফল হও, নিজেকে প্রমাণ করো এবং একজন বড় ব্যবসায়ী হয়ে ওঠো। যখন তুমি বড় হবে, বিয়ে করবে এবং তোমার একটি মেয়ে হবে তার নাম আমার নামে মরিয়াম রেখো। তুমি আমার ভালোবাসা, আমার হৃদয়, আমার ভরসা, আমার আত্মা এবং তুমি আমার ছেলে যাকে নিয়ে আমি গর্বিত।'
Comments