দোষ কি সব আইএমএফের?

ফেসবুকসহ পত্র-পত্রিকায় আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আইএমএফের বিরুদ্ধে ব্যাপক মুণ্ডপাত চলছে। অনেকের ধারণা, সংস্থাটির ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেওয়ার জন্যই নাকি সরকার তেলের দাম নজিরবিহীনভাবে বাড়িয়েছে। হ্যাঁ এটা সত্যি, সবসময় জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে এর মূল্য নির্ধারণ করার প্রস্তাব দেয় আইএমএফ। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, ঋণ দেওয়ার জন্য আইএমএফ কোনো শর্ত সরকারকে এখনও দেয়নি। এরপরও সরকার তেলের দাম বাড়িয়েছে। আর আকার-ইঙ্গিতে এর দায়ভার দেওয়া হচ্ছে আইএমএফকে।
রয়টার্স ফাইল ফটো

ফেসবুকসহ পত্র-পত্রিকায় আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আইএমএফের বিরুদ্ধে ব্যাপক মুণ্ডপাত চলছে। অনেকের ধারণা, সংস্থাটির ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেওয়ার জন্যই নাকি সরকার তেলের দাম নজিরবিহীনভাবে বাড়িয়েছে। হ্যাঁ এটা সত্যি, সবসময় জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে এর মূল্য নির্ধারণ করার প্রস্তাব দেয় আইএমএফ। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, ঋণ দেওয়ার জন্য আইএমএফ কোনো শর্ত সরকারকে এখনও দেয়নি। এরপরও সরকার তেলের দাম বাড়িয়েছে। আর আকার-ইঙ্গিতে এর দায়ভার দেওয়া হচ্ছে আইএমএফকে।

কেন তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করার কথা বলে আইএমএফ? এই বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। যদি তেলের ওপর ভর্তুকি দেয় সরকার, তাহলে ওই টাকা শেষ পর্যন্ত জনগণের পকেট থেকেই যায়। জনগণের দেওয়া ট্যাক্সের টাকা থেকেই সেই ভর্তুকির টাকা আলাদা করা হয়। ফলে তাদের পরামর্শ হচ্ছে, ভর্তুকি কমানোর মাধ্যমে সেই ট্যাক্সের টাকা যাতে জনগণের কাছ থেকে না নেওয়া হয়। কিন্তু, আমাদের সরকারগুলো কি তা করে? ফলে ভর্তুকি প্রত্যাহার নিয়ে আইএমএফের যুক্তির বিষয়ে আমরা অর্ধেকটা জানি।

২০১২ সালে আইএমএফ এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ দিয়েছিলো বাংলাদেশকে। শুধু ভর্তুকি প্রত্যাহার নয়। এর পাশাপাশি আরও অনেকগুলো শর্ত তারা জুড়ে দিয়েছিল। এর অংশ হিসেবে সরকারকে ২০১৩ সালে গোটা ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করতে হয়েছিল। এছাড়াও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এক পরিবার থেকে দুইজনের বেশি পরিচালক না থাকা, দুই মেয়াদের বেশি ডাইরেক্টরদের বোর্ডে থাকতে না পারা ইত্যাদি বিষয় আইনে এসেছিল। পাশাপাশি নয় মাসের মধ্যে ঋণ ফেরত না দিলে মন্দ মানের খেলাপি ঋণ হয়ে যাওয়া সহ ঋণ পুনঃতফশিলের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে নীতিমালা পরিবর্তন করতে হয়েছিল। ব্যাংকে করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারত এসব নিয়ম। আমরা দেখেছি, আইএমএফের ঋণ পুরোটাই পাওয়ার পর সরকার আবার সেইসব নিয়মকানুন পরিবর্তন করে আগের জায়গায় চলে গিয়েছে। ২০১৮ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন আবার পরিবর্তন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গোষ্ঠীতন্ত্র। সুবিধা দেওয়া হয়েছে অভ্যাসগত খেলাপিদের।

শুধু তাই নয়, আইএমএফ দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে ঋণের ওপর নয় শতাংশ সুদের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়ার জন্য। এই ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেওয়া হলে চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কট অনেকাংশে সহজভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এটি একটি বড় হাতিয়ার। এই মুহূর্তে ঋণের সুদহার বাড়লে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে কম ধার করবে। ফলে বাজারে টাকার সরবরাহ কমবে। আমদানিও কমবে। কারণ, আমদানি অর্থায়নে ঋণের সুদহার নয় শতাংশ থেকে বেড়ে যাবে।

আইএমএফ দীর্ঘদিন বলে আসছে, টাকা ও ডলারের বিনিময় রেট বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার জন্য। যদি আমরা আগে থেকে তা করতাম, আজকে টাকার ব্যাপক অবমূল্যায়ন ঠেকাতে পারতাম। কারণ আমরা টাকাকে কৃত্রিমভাবে শক্তিশালী করে রেখেছিলাম, নিজেদের মিথ্যা সুনামের জন্য। ফলে সঙ্কট আসা মাত্র আমরা বড়ো রকমের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি।

তেলের দামে ফিরে আসা যাক। আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে সত্যিকার অর্থে সমন্বয় করা হলে ভোক্তাদেরও লাভ হতো। করোনাভাইরাস মহামারীর সময় তেলের দাম বিশ্ববাজারে ব্যারেলপ্রতি ৩০ ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। এর আগেও অনেক বছর ধরে স্থানীয় বাজারে তেলের দাম বিশ্ববাজার থেকে বেশি ছিল। কিন্তু, আমাদের দেশের সরকার ওই অনুপাতে তেলের দাম কমায়নি। ফলে আমাদেরই পকেট কাটা গেছে। এর মানে তেল থেকে সরকার ব্যাপক লাভ করেছে। আর লোকসান হয়েছে জনগণের। যদি সেসময় তেলের দাম কমানো হতো, তাহলে আমাদের সঞ্চয় হতো। সেই টাকা দিয়ে আমরা এই দুঃসময় মোকাবিলা করতে পারতাম। অথচ তেলের দাম এমন এক সময়ে বাড়ানো হলো, যখন মানুষের জীবনের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। এখন শুনছি, সয়াবিন তেলের দামও বাড়ানোর পায়তারা করছে ব্যবসায়ীরা। একদিকে ভোজ্য তেলের ব্যবসায়ী আর অন্যদিকে জ্বালানি তেলের ব্যবসায়ী (সরকার)। দুই ব্যবসায়ীর খপ্পর থেকে মানুষ যাবে কোথায়? বাংলাদেশের মানুষের নাকি সহ্য করার ক্ষমতা ব্যাপক। কিন্তু, এই ধরনের এক তরফা সহ্য করার সব ভার যেন মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের উপর। উচ্চবিত্তদের সুযোগ দেওয়ার জন্য এসব তথাকথিত বুলি বন্ধ হওয়া দরকার।

আজকের এই পরিস্থিতি আমাদের অযৌক্তিক পলিসি ও অব্যবস্থাপনার জের ধরে উদ্ভব। আমাদের পকেট থেকে নেওয়া টাকা দিয়েই যেমন ভর্তুকির টাকা আলাদা করা হয়, তেমনি তেলের বর্ধিত মূল্যও আমাদের থেকে নেওয়া হয়। ফলে তেলের ভর্তুকি নিয়ে আইএমএফের এসব কথা অযৌক্তিক কিনা সেটা ভাববার বিষয়। তবে নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য সুনির্দিষ্ট খাতে অবশ্যই ভর্তুকির বণ্টন থাকা উচিত।

গত এক দশক ধরে আইএমএফের প্রেস কনফারেন্সসহ একাধিক প্রোগ্রামে আমি ছিলাম। ওইখানে তারা একাধিকবার স্বীকার করে বলেছে, ওই শর্তগুলো বেশ কঠিন। তাদের মতে, ঋণ নেওয়া দেশের করপোরেট সুশাসন উন্নত করার জন্যই ওইসব শর্ত দেওয়া হয়।

এ কে এম জামীর উদ্দীন: সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার
 

Comments

The Daily Star  | English

Trade at centre stage between Dhaka, Doha

Looking to diversify trade and investments in a changed geopolitical atmosphere, Qatar and Bangladesh yesterday signed 10 deals, including agreements on cooperation on ports, and overseas employment and welfare.

3h ago