রাজনৈতিক দলের মতামত বদলে গেলে, ভোটের ফলও তো বদলে যেতে পারে
'গড়মিল' 'ভুল' 'অসত্য' 'মিথ্যা' 'জালিয়াতি' 'অসততা' 'অনৈতিক' 'বেআইনি' কোন শব্দটির ব্যবহার সঠিক হবে?
প্রশ্নটি রেখেই নির্বাচন কমিশন বিষয়ে কিছু কথা বলার তাগিদ অনুভব করছি।
'ইভিএম: রাজনৈতিক দলের মতামত যেভাবে বদলে দিল নির্বাচন কমিশন' (দ্য ডেইলি স্টার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২)।
সাংবাদিক মোহাম্মদ আল- মাসুম মোল্লার করা এই প্রতিবেদনটিতে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে গুরুতর কিছু অভিযোগ আনা হয়েছে। ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে নির্বাচন কমিশন আয়োজিত সংলাপে যোগ দিয়েছিল ২৯টি। নির্বাচন কমিশন একটি রোডম্যাপ প্রকাশ করেছে।
সংলাপে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ইভিএম বিষয়ে যে মতামত জানিয়েছিল, রোডম্যাপে নির্বাচন কমিশন তা বদলে দিয়েছে। যেসব দল ইভিএমের সরাসরি বিপক্ষে অবস্থান জানিয়েছিল, তাদেরকে সরাসরি ইভিএমের পক্ষে দেখানো হয়েছে।
রোডম্যাপে নির্বাচন কমিশন উল্লেখ করেছে, ২৯টির মধ্যে ১৭টি রাজনৈতিক দল কোনো না কোনোভাবে ইভিএমের পক্ষে মত দিয়েছে। সত্যি কি ঘটনাটা এমনই?
দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এই ১৭টির মধ্যে ৪টি দল সরাসরি ইভিএমের বিরুদ্ধে অবস্থান জানিয়েছিল। বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন সংলাপে অংশ নিয়ে সরাসরি ইভিএমের বিরুদ্ধে মতামত জানিয়েছিল। সেই সময় নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া লিখিত প্রস্তাবেও তারা ইভিএমের বিরুদ্ধে অবস্থান স্পষ্ট করেছিল। দ্য ডেইলি স্টারকে এখনও তারা তাদের সেই কথাই পুনর্ব্যক্ত করেছেন। অথচ রোডম্যাপে নির্বাচন কমিশন এই ৩টি দলকেই ইভিএমের পক্ষে দেখিয়েছে। যা প্রকৃত ঘটনা ও সত্যের শতভাগ বিপরীত।
জাকের পার্টিকে ইভিএমের পক্ষে দেখানো হয়েছে। জাকের পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, যে অবস্থান নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছি, তাতে আমাদেরকে ইভিএমের পক্ষে দেখানোর সুযোগ নেই।
১৪ দলের শরীক ওয়ার্কার্স পার্টি ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে 'ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেল (ভিভিপিএটি)' সংযুক্তির শর্ত দিয়েছিল। এই শর্ত পূরণ না করেই ওয়ার্কার্স পার্টিকে ইভিএমের পক্ষে দেখিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
এসব রাজনৈতিক দলকে এখন ইভিএমের পক্ষে দেখালেও, সংলাপ চলাকালীন নির্বাচন কমিশনের অবস্থান ভিন্ন ছিল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালের সেই সময়ে একটি বক্তব্য স্মরণ করলেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, 'ইভিএম নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সমর্থন পেয়েছি। অধিকাংশ দল ইভিএম বিশ্বাস করছে না। এর ভেতরে কী জানি একটা আছে। আমরা অনেককেই আস্থায় আনতে পারছি না।' চ্যানেল ২৪, ৩১ জুলাই ২০২২)।
সিইসি যখন এ কথা বলেছিলেন তখন গণমাধ্যমের সংবাদ ছিল সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগসহ ৪টি দল সরাসরি ইভিএমের পক্ষে। এই ৪টি দলের মধ্যে তরিকত ফেডারেশন ও সাম্যবাদী দল ১৪ দলীয় মহাজোটের অংশ। বিকল্প ধারার সঙ্গেও আওয়ামী লীগের এক ধরনের ঐক্য আছে। সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে ছিল ১০টি দল। শর্তসাপেক্ষে ১২ টি দল ইভিএমের পক্ষে অবস্থান জানিয়েছিল। এই ১২টি দল যেসব শর্ত দিয়েছিল তার মধ্যে ছিল, ইভিএম নিয়ে সব বিতর্কের অবসান ঘটাতে হবে, ভিভিপিএটি সংযুক্ত করতে হবে, যান্ত্রিক ত্রুটি ও সব ধরনের জটিলতা নিরসন করতে হবে। ছিল আরও কিছু শর্ত। এসব শর্তের কোনোটিই পূরণ হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতামত জানানোর একটি উদ্যোগ নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন ভবনে ইভিএম দেখে ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এবং ড. কায়কোবাদ বলেছিলেন, 'এটি (ইভিএম) পারফেক্ট ও নির্ভরযোগ্য মেশিন।' (যুগান্তর, ২৫ মে ২০২২)।
এরপর ড. কায়কোবাদ দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'ওই স্বল্প সময়ে ইভিএম আমরা নিজেরা কিন্তু পরীক্ষা করে দেখিনি। তারা মেশিন দেখিয়ে যা বলেছে এবং আমরা আমাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে ইভিএম সম্পর্কে কথা বলেছি।' (২৯ মে ২০২২)।
'শর্তসাপেক্ষে ইভিএমের পক্ষে'র দলগুলোর দেওয়া শর্তের একটিও পূরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি।
ফলে এই ১২টি দলকে 'কোনো না কোনোভাবে' লিখে ভাষাগত কৌশলেও ইভিএমের পক্ষে বলার সুযোগ থাকছে না।
বাংলাদেশের সব নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কমবেশি অভিযোগ আছে। সরকারের আজ্ঞাবহতার অভিযোগ আছে, ভোটারবিহীন নির্বাচনের অভিযোগ আছে, ৫ শতাংশ ভোটকে ৪০ শতাংশ বানানোর অভিযোগ আছে। তবে সব অভিযোগকে অতিক্রম করে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল বিগত কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছিল। রাতে ভোটের অভিনব অভিযোগও তাদের বিরুদ্ধে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনও নির্বাচনের আগেই নজিরবিহীন অভিযোগে অভিযুক্ত হলো। রাজনৈতিক দলগুলোর ইভিএম বিষয়ক অবস্থান তারা নিজেদের মতো করে বদলে দিলো। কেন বদলে দিলো? ইভিএমে নির্বাচন করার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো যাবে? ইভিএমের প্রতি এমন মরিয়া আচরণে প্রশ্ন আসছে, নির্বাচন কমিশন কি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায়, না তৃতীয় কারও এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়?
লেখার শুরুতে ৮ টি শব্দ উল্লেখ করেছি। ঘটনাক্রম পর্যালোচনা করলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, 'গড়মিল' বা 'ভুল' শব্দ ২টি নির্বাচন কমিশনের এই আচরণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। নির্বাচন কমিশন জেনে-বুঝে রাজনৈতিক দলের মতামত বা অবস্থান বদলে দিয়েছে। ফলে অন্য ৬টি শব্দই সম্ভবত নির্বাচন কমিশনের এই কর্মের জন্যে প্রযোজ্য ও কার্যকর।
একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এত বড় অপবাদ কীভাবে সামাল দেবে নির্বাচন কমিশন?
এই প্রশ্ন সঙ্গতভাবেই আসে যে, নির্বাচন কমিশন যদি রাজনৈতিক দলের বক্তব্য ও লিখিত মতামত বদলে দিতে পারে, তারা নির্বাচনের ফল বদলে দেবে না, তার নিশ্চয়তা কী? এই আশঙ্কা বা প্রশ্নের স্বচ্ছ উত্তর কি নির্বাচন কমিশনারদের কাছে আছে? যদি না থাকে, তবে কি তাদের পদে বা দায়িত্বে থাকার কোনো নৈতিক অধিকার থাকে?
এমন একটি নজিরবিহীন অসততা, অনিয়মে রাজনৈতিক দলের মতামত বদলে দেওয়ার মতো নজির তৈরি করার পর তাদের কাছে আশা করার আর কিছু কি অবশিষ্ট রইল?
Comments