পশু-পাখির প্রতি নিষ্ঠুরতা এক ধরনের মানসিক বিকৃতি
নীল মাছরাঙা পাখির দ্বিখণ্ডিত দেহ ও তার ডিমগুলোর ছবি যখন ফেসবুকে ভাইরাল হয়, তখন নিজেকেই অপরাধী মনে হয়েছিল। কারণ, আমি দর্শক হয়ে এই ছবিটি দেখেছি এবং আমারই মতো একজনের জন্য ছোট্ট মা পাখিটি বহু চেষ্টা করেও তার অনাগত সন্তানদের বাঁচাতে পারেনি।
পাখিটির কী দোষ ছিল আমি জানি না। খবরে দেখলাম, মাছরাঙ্গা পাখিটির বাসায় হামলা চালিয়ে মা পাখিটির মাথা ছিঁড়ে আলাদা করে সেই হত্যাকারী এবং মাথাটি ডিমগুলোর পাশে রেখে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করেছে।
এর থেকে প্রমাণিত হলো, কেবল মানুষই পারে কোনো কারণ ছাড়াই নিজের নির্মম চেহারা প্রকাশ করতে।
মাত্র ২ দিন আগে ঢাকা কলেজের ভেতরে একটি কুকুরকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে শিক্ষার্থী ও স্থানীয় দোকানদারদের বিরুদ্ধে। কলেজের শিক্ষার্থী ও কর্মচারীকে কামড় দেওয়ার অভিযোগ এনে কুকুরটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় বলে জানা গেছে। পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি গাড়ি ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়ে মৃত কুকুরটিকে নিয়ে যায়। ওই সময় আরও কয়েকটি জীবিত কুকুরকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এই খবর দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনে প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, কুকুরটিকে পিটিয়ে না মেরে সিটি করপোরেশনকে খবর দিলে তারা এসে নিয়ে যেতো বা পশু সংরক্ষক কোনো গ্রুপকে খবর দিলেও তারা একটা ব্যবস্থা নিতে পারতো। তবে, অধিকাংশ মানুষই মনে করেন, শিক্ষার্থী-দোকানদাররা কুকুরটিকে পিটিয়ে মেরে বেশ করেছে। অনেকে বলেছেন, যেমন কর্ম তেমন ফল। কুকুর কামড়ালে কি আদর করবে তাকে? অধিকাংশ মানুষই কুকুর হত্যার পক্ষে।
যাইহোক, প্রসঙ্গত একটা বিষয় জানতে চাই। গত বছর পাকিস্তানে যে ৫ জন মানুষ একটি অন্তঃসত্ত্বা ছাগলকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছিল, এটাকে আমরা কী বলবো? এখানেও কি আমরা ছাগলটিকেই অপরাধী করবো এবং বলবো এইভাবে হত্যা করাটা ঠিক হয়েছে। মনে রাখা উচিৎ, মানুষ পশুর চেয়ে অনেক বেশি হিংস্র হয়ে উঠতে পারে।
অভিযুক্ত কুকুরকে সরানোর জন্য কর্তৃপক্ষ আগেই সিটি করপোরেশনকে খবর দিতে পারতেন। কুকুর কামড়ালে এখন কেউ মারাও যায় না এবং ১৪টা ইনজেকশনও দেওয়া হয় না বা মানুষের পেটে কুকুরের বাচ্চাও হয় না। কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর আঁচড় কাটলে বা কামড়ালে বিনা পয়সায় মহাখালীর সরকারি হাসপাতালে ইনজেকশন দেওয়া হয়, যা খুব কার্যকর।
একটি সমাজের জন্য পিটিয়ে মারার প্রচলনটা খুব খারাপ। আজ আমরা কুকুর ক্ষতি করেছে বলে তাকে পিটিয়ে মারছি, কাল যে একজন মানুষ ক্ষতি করলে তাকে পিটিয়ে বা গলাটিপে মারব না, তাতো নয়। 'পিটিয়ে হত্যা' এক ধরনের ভয়াবহ প্রবণতা।
কিছুদিন আগে ঢাকা কলেজের সামনেই শিক্ষার্থীদের একাংশের সঙ্গে দোকানদারদের সংঘর্ষে একজন কুরিয়ার কর্মীকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কুকুর হত্যার সংবাদের নিচে আমি এই প্রসঙ্গ আনায় অনেককে দেখলাম কুরিয়ারে কর্মরত ওই ছেলেটিকে পিটিয়ে মারার ব্যাপারটিকেও সমর্থন করছেন। বলছেন, ছেলেটির দোষ ছিল বলেই তাকে মরতে হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ কেন কোনো কারণ ছাড়াই পশুপাখি হত্যা করে? যে তরুণরা টিলার ওপরে আশ্রয় নেওয়া শিয়াল, বাগডাসকে মারলো, যারা বন্যার সময় ঘরে আশ্রয় নেওয়া হরিণটিকে খেয়ে ফেললো, যারা গন্ধগোকুলকে মেরে ফেলল, যারা কুকুরের হাত-পা ভেঙে দিলো, বিড়ালকে দড়িতে ঝুলিয়ে ফাঁসি দিলো, আহত শামুকখোল পাখিদের রান্না করে খেয়ে ফেললো, বিষ খাইয়ে মাছ, বানর ও পাখি মেরে ফেললো—এরা আসলে খুনি। আজ এরা বিনা প্রয়োজনে পশুপাখি খুন করছে, কাল মানুষ খুন করবে। যেমনভাবে খুন করেছে আবরার, তসলিমা রেনু, বিশ্বজিৎ দাস, দীপণ, অভিজিৎ রায় ও নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়কে।
পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা এক ধরনের মানসিক বিকৃতি বা অসুস্থতা। স্কুলে থাকতে একটা বইয়ে পড়েছিলাম, মানুষই এই জীবজগতে সবচেয়ে বেশি নৃশংস। কারণ একমাত্র মানুষই পারে অপ্রয়োজনে বা তুচ্ছ কারণে ভয়ংকরভাবে মানুষ ও পশুপাখিকে হত্যা করতে। আর কোনো জীব তা পারে না। এমনকি খুব বিষধর সাপও হঠাৎ মানুষকে আক্রমণ করে না।
মানুষের প্রতি মানুষের 'ভায়োলেন্স' বা সহিংসতার সূত্রপাত হয় পশুপাখির প্রতি 'ভায়োলেন্স' থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই একটা প্রতিবেদনে বলেছিল, তাদের দেশে অধিকাংশ সিরিয়াল কিলারদের 'অ্যানিমেল অ্যাবিউজ' করার 'ব্যাকগ্রাউন্ড' আছে। যদি ছোটবেলা থেকে প্রাণীদের ওপর নির্যাতন করার প্রবণতা কারো থাকে এবং কেউ যদি এ নিয়ে শিশুকে সাবধান না করে, তাহলে তারা বড় হয়ে মানুষের প্রতিও অমানবিক আচরণ করে থাকে।
বাংলাদেশে যখন পশুপাখির ওপর নির্দয় আচরণ করা হয়, তখন কখনো দেখিনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়, ব্যবসায়ী মহল, রাজনীতিবিদ, আমলা, তারকা বা অন্য পেশাজীবী এ নিয়ে উদ্বেগ বা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং অপরাধীর বিচার দাবী করেছেন। পশুপাখি সংরক্ষণে ১৯২০ সালে প্রণীত একটি আইন থাকলেও এর তেমন কোনো কার্যকারিতা চোখে পড়ে না। এই আইনটিকে আধুনিক করা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে প্রয়োজন জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।
পশুপাখি, গাছপালা মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত। পশুপাখি কখনো বুদ্ধি খাটিয়ে কারো ক্ষতি করে না বা কাউকে হত্যা করে না। মাঝেমধ্যে যা করে, সেটা তাদের সহজাত প্রবৃত্তির বশেই করে। অন্য কোনো প্রাণী আক্রান্ত না হলে সাধারণত অন্যকে আঘাত করে না, কিন্তু মানুষ করে। আমরা অনেকেই জীবজগতকে ভালবাসতে শিখিনি। এই একই কারণে মানুষকেও ঠিকমতো ভালবাসতে পারিনি। পশুপাখির পাপ-পুণ্যের হিসাব হয় না, কিন্তু মানুষের হয়। কুকুর পাগল হয়ে মানুষকে কামড়াতে পারে, মানুষ কুকুরকে বা অন্য প্রাণীকে এভাবে কামড়াতে পারে না।
আমাদের সমাজে ছোটবেলা থেকে সাধারণত পশুপাখির প্রতি দয়া দেখানোর কথা শেখানো হয় না। অবশ্য মানুষের প্রতিও দয়া বা ভালবাসা দেখানোর উদাহরণও খুব কম। পরিবারে, স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে মানুষ, বৃক্ষ ও জীবকে সমানভাবে দয়া করার কথা।
জীবের প্রতি দয়ার কথা আমাদের সেভাবে শেখানো হয় না বলেই অসংখ্য নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটছে মানব সমাজে এবং প্রকৃতিতে। শ্রীমঙ্গলে ধান খেত থেকে আহত অবস্থায় একটি মেছোবাঘ উদ্ধার করা হয়েছিল। যার কোমরে কেউ লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে। এরমধ্যে সীমান্ত ঘেঁষা নাগর নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল ছোট্ট একটি নীলগাই। স্থানীয়রা নীলগাইটি দেখে এমনভাবে ধাওয়া করে যে সেই ধাওয়ায় পালাতে গিয়ে সেটি মারা যায়। ফেনীর সোনাগাজীতে গভীর রাতে কৃষকের একটি অন্তঃসত্ত্বা গাভী চুরি করে চামড়াসহ গাভীর মাথাটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা। এরকম আরও অনেক ঘটনার কথা খবর হয়ে আসে। যেখানে পশুপাখিগুলো কোনো কারণ ছাড়াই মানুষের বর্বরতার শিকার হয়।
একটা মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করলে তার যে কষ্ট হয়, একটা পশুরও তাই হয়। দেশে নৃশংসভাবে পশু হত্যার হার ব্যাপকভাবে বাড়ছে, বাড়ছে প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা। এতে আমাদের চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে। কারণ যে মানুষ নিরীহ পশুপাখির ওপর নৃশংস হতে পারে, তার পক্ষে পরবর্তীতে মানুষের ওপর নিষ্ঠুর হওয়া খুব কঠিন হয় না। নৃশংসতায় তার অভ্যস্ততা তৈরি হয়।
রাজবাড়ীতে একটি ঘোড়ার ৪ পা বেঁধে পায়ুপথে ও মূত্রনালিতে বাঁশের লাঠি ঢুকিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। শত্রুতা ছিল ঘোড়ার মালিকের সঙ্গে, কিন্তু মরতে হলো ঘোড়াটিকে। একইভাবে হত্যা করা হয়েছিল বগুড়ার কাহালু এবিসি টাইলস কারখানায় রাসেলকে ও রুবেলকে। খুলনায় শিশু রাকিব ও নারায়ণগঞ্জে শিশু সাগর বর্মণকে একইভাবে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
মানুষ কেন পশুপাখির প্রতি নির্মম আচরণ করে, কেন তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে, এর কোনো যুক্তি পাওয়া যায় না। মানুষ বুঝতেই পারে না যে এই হত্যা করার মাধ্যমে সে তার নিজের বেঁচে থাকার পথকে ধ্বংস করছে। পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা যে একটা অপরাধ, তাও তারা জানে না। কারণ এই অপরাধে কাউকে তারা শাস্তি পেতে দেখে না।
প্রতিটি ধর্মেই পাখি, মাছ, বিড়াল, পিঁপড়া, কুকুর, গৃহপালিত পশুসহ যেকোনো প্রাণীকে নিপীড়ন করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মেও তাই। কারণ এই প্রাণীগুলোও আল্লাহর সৃষ্টি। কেউ যদি কোনো পশুপাখি পালে, তাহলে সেই পশুপাখির যত্ন নেওয়া তার জন্য অবশ্য কর্তব্য। পশুপাখি কথা বলতে পারে না বলে অভিযোগ জানাতে পারে না, তা কিন্তু নয়। তারাও তাদের দুঃখ সৃষ্টিকর্তাকে জানাতে পারে।
অনেকেই বলে, ইসলামে কুকুরকে শত্রু হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু এটাও একটা ভুল তথ্য। হাদিসে আছে, আল্লাহর রাসুল (স.) বলেন, 'এক ব্যক্তি একটি কুয়ার নিকটবর্তী হয়ে তাতে অবতরণ করে পানি পান করল। অতঃপর উঠে দেখলো, কুয়ার পাশে একটি কুকুর (পিপাসায়) জিহ্বা বের করে হাঁপাচ্ছে। তার প্রতি লোকটির দয়া হলো। সে তার পায়ের একটি (চর্ম-নির্মিত) মোজা খুলে (কুয়াতে নেমে তাতে পানি ভরে এনে) কুকুরটিকে পান করালো। ফলে আল্লাহ তার এই কাজের প্রতিদান স্বরূপ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করালেন।' প্রসঙ্গত উল্লেখ যে পবিত্র কোরআনের কোথাও কুকুর পাপী এবং কুকুরকে পিটিয়ে মারা ন্যায়সঙ্গত—এ কথা বলা হয়নি।
লোকেরা বলল, 'হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! জীবজন্তুর প্রতি দয়া প্রদর্শনেও কি আমাদের সওয়াব আছে?' তিনি বললেন, 'প্রত্যেক সজীব প্রাণবিশিষ্ট জীবের (প্রতি দয়া প্রদর্শনে) সওয়াব বিদ্যমান।' তিনি বলেন, 'দুর্ভাগা ছাড়া অন্য কারো (হৃদয়) থেকে দয়া ছিনিয়ে নেওয়া হয় না।'
কিছু মানুষ কিন্তু ঠিক এর বিপরীত কাজটাই করে। খাবার খুঁজতে খুঁজতে একটি মেছো বাঘ খালের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। গ্রামের সবাই একজোট হয়ে ধাওয়া করে তাকে পিটিয়ে মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, নিরীহ মেছোবাঘটির মরদেহ ঝুলিয়ে রেখেছিল গাছের ডালে। এরপর কাঁধে তুলে পুরো গ্রাম চক্কর দিয়ে উল্লাস করেছে গ্রামের কিছু তরুণ। ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে প্রচার করেছে বাঘটা মেরে তাদের বীরত্বের গল্প।
নিরীহ পশুপাখির প্রতি এমন বিভীষিকাময় আচরণ করবেন না এবং এইরকম আচরণকে সমর্থনও করবেন না। এই পাপের বোঝা একদিন মানুষকেই বইতে হবে। আজকে যে প্রকৃতি বিরূপ হয়ে উঠেছে আমাদের প্রতি, তা মানুষের অপকর্মেরই ফল। আসুন আমরা বিশ্বাস করতে চেষ্টা করি, 'জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর'।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments