গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি: গন্তব্য যখন আমদানি বাজার…

নববর্ষের উপহার!
বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্মেলনের রেশ কাটেনি এখনো। সরকারপক্ষে বলা হচ্ছে, এই সম্মেলন আমাদের বিনিয়োগের এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অন্যায্য শুল্কযুদ্ধ যখন গোটা পৃথিবীর অর্থনীতি ও বাণিজ্যকে অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতার দিকে ঠেলছে, ঠিক তখনই এই বিনিয়োগ সম্মেলন দেশের মাটিতে স্বস্তি ও সুস্থিরতার পরিবেশ আনার চেষ্টা করেছে বলে দাবি করা হয়েছে কর্তৃপক্ষের বরাতে।
কিন্তু এই 'সুস্থিরতা'র রেশ থাকতে থাকতেই নতুন বাংলা বছরের শুরুতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) দেশে গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়িয়ে এক বিরল নজির সৃষ্টি করল। বিইআরসি শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রে (ক্যাপটিভ) ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৩১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে এক লাফে ধার্য করেছে ৪২ টাকা। আর শিল্প–সংযোগে গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করেছে ৪০ টাকা। বিইআরসির এই সিদ্ধান্তে নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ল ৩৩ শতাংশ, পুরনো শিল্পে বাড়তি ব্যবহারে নতুন দাম যুক্ত হলো। গ্যাসের এই বাড়তি দাম ঘোষণার দিন ১৩ এপ্রিল ২০২৫ থেকেই কার্যকর হয়েছে।
বাংলা নতুন বছরের শুরুতেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত এক অর্থে জাতির জন্য নববর্ষের উপহারই বটে! কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই বাড়তি গ্যাসের দাম আমাদের নিজস্ব শিল্প আর নিজস্ব উৎপাদনকে কতটা প্রতিযোগিতাহীন করে দেবে? এই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির চাপ আমাদের ভোক্তাসমাজ মোকাবিলা করবেই বা কী করে?
চাহিদা ও যোগানের ফারাক
দেশে গ্যাসের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটে দেশে উৎপাদিত নিজস্ব গ্যাস ও আমদানি করা গ্যাসের মাধ্যমে। দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে পেট্রোবাংলার আওতাধীন মোট তিনটি গ্যাস উৎপাদন কোম্পানি যথাক্রমে গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল), সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (সিজিএফএল), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) এবং দুটি আন্তর্জাতিক গ্যাস উৎপাদন কোম্পানি (আইওসি) শেভরন ও তাল্লোর মাধ্যমে নিজস্ব গ্যাস আহরণ করা হয়।
অর্থাৎ দেশের গ্যাস উত্তোলন করে বাপেক্সের মাধ্যমে দেশের নিজস্ব কোম্পানি। আবার দেশের গ্যাস উত্তোলন করে আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে নিয়োজিত বিদেশি তেল কোম্পানিগুলো। তাদের উৎপাদিত গ্যাস চড়া দামে কিনে ভোক্তাদের সরবরাহ করা হয়। অন্যদিকে দেশের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় গ্যাস, আসে এলএনজি হিসেবে।
দেশে উৎপাদিত গ্যাস ও আমদানি করা এলএনজি রি-গ্যাসিফাইড করে পেট্রোবাংলার আওতাধীন সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএলের (গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড) মাধ্যমে সঞ্চালন করা হয়। এই গ্যাস পেট্রোবাংলার আওতাধীন ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি যথাক্রমে তিতাস, বাখরাবাদ, জালালাবাদ, কর্ণফুলী, পশ্চিমাঞ্চল ও সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানির মাধ্যমে আট শ্রেণীর গ্রাহকের কাছে সরবরাহ করা হয়। বিদ্যুৎ, সার, শিল্প, ক্যাপটিভ পাওয়ার, সিএনজি, বাণিজ্যিক, গৃহস্থালি ও চা-বাগান হচ্ছে এই আট শ্রেণীর গ্রাহক।
দেশে গ্যাসের চাহিদা যে হারে বাড়ছে, সেই হারে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন হচ্ছে না। ফলে প্রতিনিয়ত গ্যাস আমদানি বাড়ছে।
গ্যাস আমদানি করা হয় মূলত দেশের বাইরে থেকে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানির মাধ্যমে। গ্যাসের বর্তমান চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যাপক ঘাটতি আছে। বর্তমানে আটটি গ্রাহক শ্রেণীতে অনুমোদিত লোড পাঁচ হাজার ৩৫৬ এমএমসিএফডি। প্রতিদিন গ্যাসের স্বাভাবিক চাহিদা প্রায় তিন হাজার ৮০০ থেকে চার হাজার ২০০ এমএমসিএফডি। এই চাহিদার বিপরীতে দেশে উৎপাদিত গ্যাস ও আমদানিকৃত এলএনজি মিলিয়ে সরবরাহ করা হয় গড়ে প্রায় দুই হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার এমএমসিএফডি। প্রতিদিনই ঘাটতি থাকে গড়ে প্রায় এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ এমএমসিএফডি গ্যাস।
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আট গ্রাহক শ্রেণীতে স্বাভাবিক চাহিদা তিন হাজার ৮০০ থেকে চার হাজার এমএমসিএফডি গ্যাসের বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে গড়ে প্রায় দুই হাজার ৪৯৩ এমএমসিএফডি গ্যাস।
২০২২-২৩ অর্থবছরের হিসাব বলছে, দেশে যে গ্যাস ব্যবহার করা হয় তার ৪২ শতাংশ বিদ্যুতে, ১৯ শতাংশ শিল্পে, ১৮ শতাংশ ক্যাপটিভ পাওয়ারে, ১১ শতাংশ গৃহস্থালিতে, পাঁচ শতাংশ সারে, ৪ শতাংশ সিএনজিতে এবং এক শতাংশ বাণিজ্যিক ও চা-বাগানে ব্যবহৃত হয়।
জ্বালানি রাজনীতি ও এলএনজি বাণিজ্য
বর্তমানে দেশে সরবরাহকৃত গ্যাসের মধ্যে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদনের পরিমাণ ৭৫ শতাংশ এবং আমদানিকৃত এলএনজির পরিমাণ প্রায় ২৫ শতাংশ। পেট্রোবাংলা গ্যাসের দাম বাড়ানোর আবদার নিয়ে বিইআরসিতে যে প্রস্তাবনা দেয় সেই শুনানিতে লিখিতভাবে বলেছে, ২০৩০-৩১ সালে এই অবস্থা উল্টে যাবে। অর্থাৎ ২০৩০-৩১ সালে সরবরাহকৃত গ্যাসের মধ্যে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদনের পরিমাণ হবে প্রায় ২৫ শতাংশ এবং আমদানিকৃত এলএনজির পরিমাণ হবে প্রায় ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ ওই সময়ে বাংলাদেশ গ্যাস আমদানিকারক একটি দেশে পরিণত হবে।
কেন এই বিপুল পরিমাণ এলএনজি আমদানির প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে? কেননা, দেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হচ্ছে না। নতুন কূপ খননের নানান গল্প শোনা গেলেও বাস্তবে দেশের প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে শক্তিশালী করার কোনো কার্যকর উদ্যোগই নেওয়া যায়নি।
বাপেক্স শক্তিশালী হলে এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমে যাবে, আমদানির বাজার সংকুচিত হবে—সেটাই এর পেছনে বড় কারণ বলে দিন দিন প্রতীয়মান হচ্ছে।
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সময় বিইআরসি তার আদেশেও এই কথা বলেছে। বিইআরসি তার নির্দেশনা ১০.৩-এ সুস্পষ্টভাবে বলেছে, 'দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।'
অন্যদিকে এলএনজি সরবরাহের জন্য আমেরিকার লুইজিয়ানাভিত্তিক আর্জেন্ট এলএনজি কোম্পানির সঙ্গে একটি বড় চুক্তি করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই চুক্তির আওতায় প্রতি বছর ৫০ লাখ টন (৫ মিলিয়ন টন) এলএনজি কিনবে বাংলাদেশ।
এই চুক্তির পরে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী মিডিয়াকে জানিয়েছেন, এই চুক্তি শুধু বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান শিল্পে নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহই নিশ্চিত করবে না, এটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের কৌশলগত অংশীদারত্বকেও শক্তিশালী করবে।
দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের কাছে গ্যাস রপ্তানির আরও ব্যবসা চায় আরেক মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেটর এলএনজি। সেজন্য কোম্পানিটির বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রতিনিধি ও সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছেন।
আমদানিই গন্তব্য…
এলএনজির জন্য পেট্রোবাংলা বা সরকারের নীতিগত অবস্থান, সরকারের এলএনজি চুক্তির আগ্রহ, এ বিষয়ক বিইআরসির নির্দেশনা ও মার্কিন কোম্পানিগুলোর অতি তৎপরতা প্রমাণ করে, বাংলাদেশে গ্যাস আমদানিই এখন জ্বালানি রাজনীতির প্রধানতম অভিমুখ।
আইএমএফ নির্দেশনা হচ্ছে, ভর্তুকি কমানোর নামে গ্যাসের দাম বাড়ানো হোক। আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসন যে শুল্কযুদ্ধ শুরু করেছে, সেখানেও বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আমেরিকা থেকে আমদানি বাড়ানোকেই বাংলাদেশের কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে। সেই আমদানির বড় অংশ পাবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি।
শুধু তাই নয়, জ্বালানিখাতে চুরি, লুণ্ঠনমূলক ব্যয়, লুণ্ঠনমূলক মুনাফা, বৃহৎ দুর্নীতি, অদক্ষতা, অন্যায্য চুক্তি, এই খাতে অর্থপাচার বন্ধ করার কার্যকর কোনো উদ্যোগই আলোর মুখ দেখেনি এই সরকারের আমলে। এমনকি জ্বালানিখাতে একটি সংস্কার কমিশনের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেনি সরকার। বরং আগের সরকারের প্রতিযোগিতাহীন কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার আয়োজনেই ব্যস্ত থেকেছে।
বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে জ্বালানিখাতের পাহাড়সম অপরাধকে বালিশচাপা দিয়ে পথচলার এই নীতির উপজাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আমদানি নির্ভরতা।
ফলে, যেকোনো মূল্যে জ্বালানি চাহিদা মেটানোর কৌশল হিসেবে এলএনজি আমদানিকেই সমাধান মনে করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কেননা, আমাদের উন্নয়নমন্ত্র হচ্ছে—
১. পাবলিক খাতকে প্রাইভেট খাতের হাতে ছেড়ে দেওয়া।
২. নিজস্ব সক্ষমতা না বাড়িয়ে সরাসরি আমদানির বাজার বিস্তৃত করা।
৩. সকল পাবলিক খাতকে সেবাখাতের বদলে বাণিজ্য খাতে পরিণত করা।
ফলে, এই উন্নয়নদর্শন বাস্তবায়ন করতেই বাংলাদেশ এখন জ্বালানি আমদানির দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত সেই নীতিরই অন্যতম উদ্যোগ।
শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, প্রকৌশলী, জ্বালানি বিষয়ক লেখক
Comments