ডিসেম্বরে কী খেলা হবে

'আগামী ১০ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়; এর বাইরে আর কারো কথায় দেশ চলবে না।'

'আগামী ১০ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়; এর বাইরে আর কারো কথায় দেশ চলবে না।'

সম্প্রতি এই কথা বলে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান। তার সঙ্গে একই সুরে কথা বলেছেন বিএনপির আরও একাধিক নেতা। যদিও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে বলেছেন, 'খেলা হবে ডিসেম্বরে।'

তার মানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ— ২ দলই ডিসেম্বরে খেলার কথা বলছে।

ডিসেম্বরে আসলে কী খেলা হবে, কারা খেলবে, কতগুলো পক্ষ থাকবে এবং সেই খেলায় কারা জিতবে? সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে স্মরণ করা যেতে পারে, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৪ বছর আগে ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল ঘোষণা করেছিলেন, ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সরকারের পতন ঘটানো হবে। তার হাতে ট্রাম্প কার্ড রয়েছে। যদিও সেই ৩০ এপ্রিল সরকারের পতন হয়নি।

আব্দুল জলিলের সেই ট্রাম্প কার্ড কী ছিল— তা নিয়ে ওই সময়ে রাজনীতির মাঠে নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের মনেও দারুণ কৌতূহল তৈরি হয়। পরে যেটি শোনা যায় এবং নানা ফোরামে আলোচনায়ও যে বিষয়টি উঠে এসেছিল তা হচ্ছে, ওই সময়ে দেশে যেহেতু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছিলো এবং এ কারণে সরকারের জনসমর্থনও কমছিল, ফলে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সরকার পতনের সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করতে চাইছিল। যার ধারাবাহিকতায় ৩০ এপ্রিল রাজধানীতে একটি বিশাল গণজমায়েতের পরিকল্পনা করা হচ্ছিলো, যেখানে অন্তত ১০ লাখ মানুষকে জড়ো করা হবে। সারা দেশ থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের বাইরে একটি এনজিওর তরফে তাদেরকে কয়েক লাখ লোক দেওয়ার বিষয়ে আলোচনাও হয়েছিল। কিন্তু যে কারণেই হোক, এই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হয়নি।

২০০৪ সালে আব্দুল জলিল যে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় ৩০ এপ্রিলের ওই তত্ত্ব দিয়েছিলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে তার বেশ মিল রয়েছে। যেমন: দেশে এ মুহূর্তে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ; শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেওয়ার ৬ মাসের মধ্যে দেশে ভয়াবহ লোডশেডিং; বিদ্যুৎখাতের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে আসছে। এমনকি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এমন অনেকেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন।

পর্যাপ্ত গ্যাস না থাকায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আবার রিজার্ভে টান পড়ায় বেশি টাকা দিয়ে এলএনজি আমদানি করেও সংকট মেটানো যাচ্ছে না বলে হতাশা ব্যক্ত করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা।

সরকারের বিভিন্ন কেনাকাটা ও উন্নয়ন প্রকল্পের নামে হাজারো কোটি টাকা লুটপাট; সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নজিরবিহীন দুর্নীতিও নিয়মিত গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি জনগণের এই অসন্তোষকে কাজে লাগাতে চাইছে; ২০০৪ সালে যে পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু ঠিক যে কারণে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল ৩০ এপ্রিলের কথা বলেছিলেন, বিএনপি নেতাদের ১০ ডিসেম্বর তত্ত্বের পেছনে কি সেরকম কোনো কারণ রয়েছে?

শোনা যাচ্ছে, আগামী ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে চলমান আন্দোলনকে একটি চূড়ান্ত রূপ দিতে চায় বিএনপি। এজন্য তারা ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণজমায়েত করবে। সেখানে কয়েক লাখ লোক জড়ো করে ঢাকায় শো-ডাউনের মধ্যে দিয়ে নিজেদের সক্ষমতা জানান দিতে চায়।  পরিকল্পনা অনুযায়ী এই গণজমায়েত কর্মসূচিতে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কগুলোতে অবস্থান নিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দেওয়ার পাশাপাশি ঢাকার রাজপথ দখলে নেওয়ার টার্গেটও রয়েছে তাদের। গত ৮ অক্টোবর রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের ৪৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনায় আমান উল্লাহ আমান নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, প্রস্তুতি নিন, কর্মসূচি আসছে; কাঁচপুর, টঙ্গী ব্রিজ, মাওয়া রোড, আরিচা রোড, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া— সারা বাংলাদেশ বন্ধ করে দেবেন। এ বাংলাদেশ চলবে না।

এই অনুষ্ঠানেই তিনি বলেন, ১০ ডিসেম্বরের পরে দেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়।

দেখা যাচ্ছে, ২০০৪ সালের ৩০ এপ্রিল তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ যেমন জনঅসন্তোষ কাজে লাগিয়ে রাজধানীতে একটি বিশাল গণজমায়েতের আয়োজন করে সেটিকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ দিতে চেয়েছিল, বর্তমান বিরোধী দল বিএনপিও আগামী ১০ ডিসেম্বর সেরকম একটি ঘটনা ঘটাতে চায়। কিন্তু সেটি কতটা সম্ভব?

প্রসঙ্গত, আমান উল্লাহ আমান যেদিন এই ঘোষণা দিলেন, তার ৪ দিন পরে ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামের সমাবেশে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিনও বলেন, আগামী ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে খালেদা জিয়ার সরকার চলবে।

এর ২ দিন আগে ১০ অক্টোবর লক্ষ্মীপুরে একই হুঁশিয়ারি দেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী। বলেন, খুব শিগগির তারেক রহমান যুক্তরাজ্য থেকে দেশে আসবেন। দাবি জানান, ১০ ডিসেম্বরের আগে সংসদ ভেঙে দিতে হবে। এরপর দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশ চলবে।

এদিন নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অধ্যাপক মামুন মাহমুদও বলেন, ১১ ডিসেম্বর তারেক রহমান বীরের বেশে ফিরে আসবেন। তাকে বিমানবন্দর থেকে এগিয়ে নিয়ে বঙ্গভবন ও গণভবনে বসানো হবে। তাকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে তারপর রাজপথ ছাড়বে বিএনপি।

এই নেতার কথায় যে পরিমাণ আবেগ আছে, বাস্তবতা নেই তার সিকি ভাগও। কারণ তিনি নিজেও জানেন, এটা অসম্ভব। বিমানবন্দর থেকে একজন নেতাকে নিয়ে সরাসরি বঙ্গভবন ও গণভবনে বসাবেন— এটি তখনই সম্ভব, যখন দেখে একটা গণঅভ্যুত্থান হয়। যা সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় হয়েছে। বাংলাদেশে এখনই বা আগামী ডিসেম্বরেই সেরকম পরিস্থিতি তৈরির শঙ্কা যথেষ্ট কম। তাছাড়া তারেক রহমান ১১ ডিসেম্বর দেশে ফিরবেন এবং তারপরে তার কথায় দেশ চলবে— এরকম কথাবার্তা মাঠের রাজনীতিতে নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের উজ্জীবিত করার জন্য বলা হলেও যতক্ষণ না নিয়ে এ বিষয়ে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে, অর্থাৎ দলের চেয়ারম্যান কিংবা মহাসচিবের তরফে কোনো ঘোষণা আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটি ভাবার কোনো কারণ নেই যে তারেক রহমান ১১ ডিসেম্বর দেশে আসবেন।

প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারেক রহমান গ্রেপ্তারের পরের বছর চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি নিয়ে যান যুক্তরাজ্যে। চিকিৎসা শেষ হলেও গত ১৪ বছরে তিনি ফেরেননি দেশে। এর মধ্যে বিদেশে অর্থপাচার, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা এবং বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তির মামলায় তার সাজা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড হয়েছে গ্রেনেড হামলা মামলায়। সুতরাং আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি ঢাকায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার হবেন।

দ্বিতীয় অপশন হচ্ছে, দেশে এমন পরিস্থিতি যদি তৈরি হয় যে, রাজনীতির মাঠ পুরোপুরি বিএনপির দখলে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই, তখন তারেক রহমান দেশে এলে হয়তো গ্রেপ্তার হবেন না। কিন্তু সেরকম পরিস্থিতি কি তৈরি হচ্ছে বা আওয়ামী লীগের মতো শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে বিএনপি এবং তাদের শরিকরা কি রাজনীতির মাঠ পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারবেন? যদি না পারেন, তাহলে ভোটের ফলাফলও তাদের অনুকূলে যাবে না। কারণ রাজনীতির মাঠ দখলে না থাকলে ভোটে জেতা যায় না। অতীত অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। প্রশ্ন হলো, রাজনীতির মাঠ শেষ পর্যন্ত কার দখলে থাকবে? তারও উত্তর দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

গত ২৩ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের ওসমানী স্টেডিয়ামে জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে খেলা হবে। ভোট চুরি ও ভোট জালিয়াতির বিরুদ্ধে খেলা হবে। দুর্নীতি লুটপাটের বিরুদ্ধে খেলা হবে। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে খেলা হবে।

পরিশেষে, আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আব্দুল জলিলের ৩০ এপ্রিলের ট্রাম্পকার্ড যেমন ফাঁকাবুলিতে পরিণত হয়েছিল, বিএনপির কতিপয় নেতার ১০ ডিসেম্বরের ট্রাম্পকার্ড, বিশেষ করে ১১ ডিসেম্বর তারেক রহমান দেশে আসবেন— এই তত্ত্বও যে ভুল প্রমাণিত হবে, সেটি সম্ভবত বিএনপির সিনিয়র নেতারাও জানেন। কারণ স্বাভাবিক পন্থায় হলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখনও ১ বছরের বেশি সময় বাকি। আর যদি রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেন, তাহলে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু সংসদ ভেঙে দেওয়ার মতো দুর্বার আন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থান কি বিএনপি ঘটাতে পারবে?

এটা ঠিক যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট এবং সর্বোপরি দুর্নীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে যথেষ্ট ক্ষোভ আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের গত ৩ মেয়াদে অবকাঠামো খাতে দৃশ্যমান উন্নয়নও হয়েছে ব্যাপক। সেই উন্নয়নের সুফল দেশবাসী ভোগ করছে। একটি দল যখন দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকে, তখন তার অনেক সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি হয়, যারা নিজেদের সুবিধাগুলো অব্যাহত রাখতে সরকারের জন্য সব ধরনের চেষ্টা করে।

দেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় সরকারের প্রতি মানুষের অসন্তোষ যেমন আছে, তেমনি যে দলটি টানা ৩ মেয়াদে ক্ষমতা আছে, তারাও যে জনসমর্থনশূন্য হয়ে গেছে, বিষয়টা এমন নয়। বরং রাজপথে বিএনপি ও তাদের শরিকদের মোকাবিলা করার যথেষ্ট শক্তি আওয়ামী লীগের রয়েছে।

সুতরাং ১০ ডিসেম্বরের পরে দেশ খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশে চলবে— এই জাতীয় বায়বীয় বক্তব্য না দিয়ে বিএনপির উচিত তাদের আন্দোলনকে আরও যৌক্তিক করতে জনগণকে সম্পৃক্ত করা। তাদের মূল দাবি যে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার, সেটি আদায়ের জন্য যে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে, সেই ইস্যুতে জনমত গড়ে তোলাই তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরও উচিত, গত ৩ মেয়াদে যে উন্নয়ন হয়েছে, সেগুলো যে গ্যাস ও বিদ্যুতের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে; অনেক উন্নয়ন যে দুর্নীতির যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে, সেখান থেকে কীভাবে দ্রুত উত্তরণ ঘটানো যায়; কীভাবে দেশবাসীকে স্বস্তি দেওয়া যায়, সেই চেষ্টা করা। ১০ ডিসেম্বর কিংবা ৩০ এপ্রিল নিয়ে সাধারণ মানুষের অত মাথাব্যথা নেই।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments