‘নাম বললে খবর আছে’

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবাই ছাত্রলীগের পৃষ্ঠপোষক। তাদেরকে অপরাধমূলক কাজ থেকে দূরে রাখার বা অপরাধে সম্পৃক্ত হলে শাস্তি দেওয়ার কেউ নেই।

ভোর ৪টায় যখন ডেকে তোলা হলো, তখন তিনি গভীর ঘুমে। নিয়ে যাওয়া হলো তৃতীয় তলার 'নির্যাতন কক্ষে'। সেখানে আরও ২ জনকে ডেকে নেওয়া হয়েছে। তাদেরকে ইতোমধ্যেই মারধর করা হয়েছে। তিনিসহ সেখানে এখন ৩ জন এবং পরবর্তীতে আরও একজনকে নিয়ে আসা হয়। তাদেরকে মারধর করার জন্য আছেন ১৫ থেকে ২০ জন।

তাকে স্ট্যাম্প, পাইপ ও লাঠি দিয়ে নির্দয়ভাবে পেটানো শুরু হলো। ৪ জনকেই পিটিয়ে আহত, ক্ষত-বিক্ষত করা হলো। একজন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হলো। চিকিৎসা দিয়ে রেখে আসা হলো তার নিজের রুমে।

এটা কোনো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বর্ণনা নয়। এটা বাংলাদেশের একটি প্রসিদ্ধ মেডিকেল কলেজের হলে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা, যেখানে ভর্তি হতে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর প্রতিযোগিতায় নামেন।

ঘটনাটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের। সেখানে ৪ জন শিক্ষার্থীকে হলের তৃতীয় তলার একটি 'নির্যাতন কক্ষে' নিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২ জনকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে আইসিইউতে।

এই ৪ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির করেন। নির্যাতন যারা করেছেন, তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ করেন।

বুয়েটশিক্ষার্থী আবরারকে বুয়েটের একটি হলের 'নির্যাতন কক্ষে' সারা রাত আটকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। চট্টগ্রাম মেডিকেলের এই ঘটনা এবং আবরার হত্যার ঘটনা হুবহু একই রকম। পার্থক্য শুধু এখানে যে, নির্যাতনে আবরারের মৃত্যু হয়েছিল। এই ৪ জনের কেউ মারা যায়নি।

আমরা এখন এমন একটি দেশ বা সমাজে বাস করি, যেখানে এ ধরনের নির্যাতনে মৃত্যু বা হত্যার ঘটনা ঘটলেই কেবল গণমাধ্যমে একটু হইচই হয়। সেই হইচই সমাজের ভেতরে একটু নাড়াচাড়া তৈরি করে, প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভেতরে এমন একটা ভাব তৈরি হয়, যেন বাংলাদেশে এমন ঘটনা এই প্রথম ঘটল এবং যারা ঘটাল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তড়িঘড়ি করে ছাত্রলীগ তাদের বহিষ্কার করে, অনেক সময় আবার পক্ষও নেয়।

আবরারকে হত্যার পর যতটা প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, এই ৪ জনকে নির্যাতনের পর ততটা প্রতিক্রিয়া হয়নি। কারণ এই ৪ জনের কেউই মারা যাননি। আইসিইউতে আছেন, ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন, আবার হয়তো সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। যেন এটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় না, কেবলই ছাত্রলীগের একটি কাজ বা ভুল।

পুলিশ বলছে, নির্যাতন করা হয়েছে বলে শুনেছি, কিন্তু কারা করেছে, তা জানি না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও প্রথমে একই বক্তব্য দিয়েছিল। এখন একটি তদন্ত কমিটি করেছে। বাংলাদেশের তদন্ত কমিটিগুলোর তদন্তে যে কী হয়, সেটা নিয়ে মন্তব্য না করাই ভালো।

'শিবির' করে, অভিযোগ এনে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের এই ৪ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ আনা হয়েছে এই ভিত্তিতে যে, তারা ছাত্র শিবির নিয়ন্ত্রিত রেটিনা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেন। সুতরাং তারা শিবির করেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, শিবির নিয়ন্ত্রিত যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, তার কোনোটি তো বাংলাদেশে নিষিদ্ধ নয়। নির্বিঘ্নে সেগুলো চলছে। তেমন একটি কোচিং সেন্টারে যদি কেউ ক্লাস নেন, তাহলেই তিনি 'শিবির' করেন, বলা যাবে?  তাকে বা তাদেরকে ছাত্রলীগ নির্যাতন করতে পারবে?

জামায়েতে ইসলামীর দিগন্ত টেলিভিশনের টকশোতে অংশ নিয়েছেন আওয়ামী লীগের বহু নেতা। এই চ্যানেলের টকশোতে অংশ নেওয়ায় তারা কি সবাই জামায়েতের অনুসারী হয়ে গেছেন?

জামায়াত পরিচালিত ইসলামী ব্যাংক (২০১৬ সালের আগে) থেকে ঋণ নিয়েছেন আওয়ামী লীগের বহু লোকজন। তারা সবাই কি জামায়াত বা জামায়াতের অনুসারী হয়ে গেছেন?

তারচেয়েও মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, এই ৪ শিক্ষার্থী যদি শিবিরের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েও থাকেন, সেটা দেখার দায়িত্ব কার? ছাত্রলীগের? কে দিলো ছাত্রলীগকে এই দায়িত্ব? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নাকি সরকার?

উত্তর আমরা জানি না।

ছাত্র শিবিরের রাজনীতি ছাত্রলীগ পছন্দ করবে না, সেই অধিকার অবশ্যই তাদের আছে। শিবিরের সঙ্গে ছাত্রলীগের সাংঘর্ষিক অবস্থাও তৈরি হতে পারে। যা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়।

কিন্তু, 'শিবির করে' এই সন্দেহে বা অভিযোগে আবরারকে হত্যা, এই ৪ শিক্ষার্থীকে এভাবে নির্যাতন করা যায়? ছাত্রলীগ নির্যাতন করতে পারে, সেই অধিকার তাদের আছে?

ছাত্ররাজনীতিতে এখন যেহেতু তাদের একক আধিপত্য, নেই কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে তারা ধরেই নিয়েছে যে, তাদের এই অধিকার আছে।

তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যদি গত ১০-১২ বছরে কেউ করে থাকে, ছাত্রলীগ একাই সেটা করছে। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় তারা নিজেরাই এখন নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী।

এখানে বলে রাখা দরকার যে, ২০২১ সালের ৩০ অক্টোবর এই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগের ২ গ্রুপের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল। এই ২ গ্রুপের একটি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী, অপরটি চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছিরের অনুসারী। তাদের সংঘর্ষে আকিব নামে এক শিক্ষার্থীর মাথার খুলি ভেতরে ঢুকে যায়, সেটা আশা করি আমরা এখনো পুরোপুরি ভুলে যাইনি।

এই ঘটনার পর সেখানে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের মতো করে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এই ৪ শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করা হয়েছে ছাত্রলীগ নেতা অভিজিত দাশের নেতৃত্বে। অভিজিত শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী গ্রুপের নেতা। গণমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অভিজিত দাশ সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা শিবির করে। সেই কারণে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। নির্যাতন করা হয়নি।

বিষয়টি একবার ভেবে দেখুন, শুধু জিজ্ঞাসাবাদেই ২ জন আইসিইউতে। এখানেই শেষ নয়। আইসিইউতে ঢুকে চিকিৎসাধীন ২ শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা হুমকি দিয়েছেন, 'খুব আরামে আছ। একটু মারধর করেছি, সেটি নিয়ে নাটক শুরু করেছ। নাম বললে কিন্তু খবর আছে।' (আজকের পত্রিকা ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)

সাধারণ শিক্ষার্থীদের যেন এটাই নিয়তি হয়ে গেছে যে, ছাত্রলীগের নিপীড়ন ও নির্যাতন সহ্য করেই তাদের হলে থাকতে হবে, শিক্ষা জীবন পার করতে হবে এবং সারাদিন স্রষ্টার নাম জপতে থাকবেন এই ভেবে যে, কখন এই শিক্ষা জীবন শেষ হবে। এটাই এখন বাংলাদেশের ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চিত্র।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবাই ছাত্রলীগের পৃষ্ঠপোষক। তাদেরকে অপরাধমূলক কাজ থেকে দূরে রাখার বা অপরাধে সম্পৃক্ত হলে শাস্তি দেওয়ার কেউ নেই।

[email protected]

Comments