রাষ্ট্রপতি, রাষ্ট্রপতিত্ব ও গণতন্ত্র

আমরা জানি, আমাদের দেশের সব সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী নিজেই নেন। সংসদের নেতা ও সরকারপ্রধান হিসেবে সংবিধান তাকে সেই ক্ষমতা দেয়, এমনকি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার ক্ষেত্রেও। কিন্তু দলের নেতা নির্বাচন আর রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মাঝে পার্থক্য থাকা উচিত নয় কি?

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে সর্বপ্রথমে যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে তা হলো, তিনি সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন না, এমনকি যে রাজনৈতিক দল থেকে তিনি আসেন, যে দলটি তাকে নির্বাচিত করে, তাদেরও প্রতিনিধিত্ব করেন না। তিনি বৃহত্তর পরিসরে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি দেশের মানুষ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করেন। তবে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল ছাড়া বাকি সবাই এটা মনে রাখি। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপিও এটা মনে রাখেনি এবং আওয়ামী লীগও মনে রাখছে না।

একজন রাষ্ট্রপতি কীভাবে তাকে নির্বাচিত করা দল এবং যে জাতির তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন, এই দুইয়ের মাঝে স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রাখেন? যে দল তাকে নির্বাচিত করেছে তাদের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে একজন রাষ্ট্রপতি কীভাবে গণতন্ত্রের সেবা করতে পারেন? তার কি কেবল ক্ষমতাসীন দলের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটানো উচিত? তাহলে জাতির প্রত্যাশার কী হবে? এটাও কি ক্ষমতাসীন দলের দখলে থাকা আর দশটি পদের মতোই একটি পদ হওয়া উচিত? করদাতাদের অর্থ ব্যয়ের কথা যদি নাও বলি, এ পদের জন্য আনুষঙ্গিক সব জৌলুস, জাঁকজমক ও প্রটোকল কি কেবল ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতা আরও বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়?

এমন প্রশ্নের শেষ নেই এবং দুঃখজনকভাবে উত্তরগুলোও পক্ষপাতমূলক। এসব প্রশ্ন করা হলে, প্রশ্ন উত্থাপনের জন্যই শাসক দল আমাদের দোষী সাব্যস্ত করবে। তবে নিশ্চই অপরপক্ষ এমন দৃষ্টান্তমূলক সাংবাদিকতার জন্য প্রশংসা করবে। তবে সেটাও ততক্ষণই, যতক্ষণ না তারা ক্ষমতাসীন হচ্ছে। কোনো নিয়ম নেই, নৈতিকতা নেই, এমনকি কোনো বৃহত্তর কল্যাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গিও নেই, আছে শুধু দলীয় পক্ষপাতমূলক বিবেচনা—এভাবেই আমরা রাষ্ট্রপতির কার্যালয়সহ আমাদের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছি।

সদ্য সমাপ্ত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আমরা দেখেছি, জাতীয় সংসদের মোট ৩৫০ সদস্যের মধ্যে ৩০৫ জন নিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী মনোনীত করার ক্ষমতা দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীও ঠিক সেটাই করেছেন। তিনি নিজেই প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন এবং মনোনীত প্রার্থীর নাম কাউকে জানাননি। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী অল্প কয়েকজন কাছের মানুষকে এ বিষয়ে জানান, এমনকি এই অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যে প্রার্থী নিজেও ছিলেন না। নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মনোনয়নপত্রে সই করার আগ পর্যন্তও তিনি কিছুই জানতেন না।

আমরা জানি, আমাদের দেশের সব সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী নিজেই নেন। সংসদের নেতা ও সরকারপ্রধান হিসেবে সংবিধান তাকে সেই ক্ষমতা দেয়, এমনকি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার ক্ষেত্রেও। কিন্তু দলের নেতা নির্বাচন আর রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মাঝে পার্থক্য থাকা উচিত নয় কি?

দলীয় ত্রৈবার্ষিক কাউন্সিলে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে মনোনয়ন দিতে কাউন্সিলর ও প্রতিনিধিরা দলীয় প্রধানকে সর্বময় কর্তৃত্ব দেন। রাষ্ট্রপতি প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগের সংসদীয় দল একই কাজ করেছে। দলীয় পদে মনোনয়ন দেওয়া এবং দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদের জন্য যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচন করা কি একই প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত? এটা কি এতটাই খামখেয়ালিপূর্ণ ও ব্যক্তিগত ইচ্ছা নির্ভর হওয়া উচিত?

রাষ্ট্রপতি আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান। সংবিধানের ৪৮(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, তিনি সকল বিষয়ে অগ্রাধিকার পান। সংসদের প্রতিটি কার্যক্রম, আইন, চুক্তি, সাংবিধানিক নিয়োগ, প্রতি বছরের বাজেট নির্ধারণসহ প্রতিটি বিষয় কার্যকর হওয়ার আগে শেষ ধাপ হিসেবে রাষ্ট্রপতির সইয়ের জন্য পাঠানো হয়। যদি এই 'আলংকারিক' পদটি এতটাই 'গুরুত্বপূর্ণ' হয়ে থাকে, তাহলে কেন এই পদের জন্য প্রার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আরও সতর্কতা অবলম্বন করা হবে না?

এরপর রয়েছে রাষ্ট্রপতির 'নৈতিক' কর্তৃত্বের প্রশ্ন। এই পদের তেমন কোনো নির্বাহী ক্ষমতা না থাকলেও অসংজ্ঞায়িত ও সবকিছুর সমন্বয়ে 'নৈতিক কর্তৃত্ব' রয়েছে। এই পদের অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য উপকরণ এটি। মর্যাদা, অনবদ্য যোগ্যতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং প্রশ্নাতীত গ্রহণযোগ্যতার একটি পদ এটি। সেখান থেকে নৈতিক কর্তৃত্বও যদি কেড়ে নেওয়া হয় তাহলে আর কী অবশিষ্ট থাকবে, তা এক রহস্য। কাজেই আমরা যখন রাষ্ট্রপতি পদের জন্য প্রার্থী নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে তুচ্ছজ্ঞান করি, তখন আমরা সেই 'নৈতিক কর্তৃত্ব'কেই প্রকারান্তরে তুচ্ছজ্ঞান করি এবং গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান—'নৈতিক রাষ্ট্রপতিত্ব' হারাই।

একটি সরকার সবসময় নৈতিকতা বজায় রাখতে পারে না, কিন্তু একজন রাষ্ট্রপতিকে অবশ্যই সবসময় নৈতিকতা বজায় রাখতে হয়। রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়া যেকোনো সরকারের জন্যই এক নিরন্তর বাস্তবতা। কিন্তু এমন কিছু কখনোই রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে হতে পারে না। তার মানে এই নয় যে রাষ্ট্রপতির কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই বা থাকবে না। বেশিরভাগ রাষ্ট্রপতিরই তা থাকে। কিন্তু সেটা কখনোই তার একমাত্র পরিচয় হতে পারে না। 'সর্বোচ্চ প্রোটোকলের' এই অবস্থান এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন তা রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকে এবং প্রয়োজনের সময়ে রাষ্ট্রপতি যেন 'বড় সমঝোতাকারীর' ভূমিকা পালন করতে পারেন। এই কাজ তিনি তখনই করতে পারবেন, যখন তিনি সব দলের কাছে আস্থা, বিশ্বাস ও 'গ্রহণযোগ্যতা' পাবেন।

রাষ্ট্রপতি পদের এই 'রাজনীতির ঊর্ধ্বে' থাকার বৈশিষ্ট্য হারানোর জন্য কেবল বর্তমান সরকারই দায়ী নয়। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরীর পরিবর্তে জাতীয় সংসদের স্পিকার মোহাম্মদউল্লাহকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করার পর থেকেই এই প্রক্রিয়ায় পচন ধরতে শুরু করে। সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকারের সময়কাল বাদ দিয়ে পরবর্তী সময়কালের আলোচনা করলে ১৯৯১ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি পদে নিযুক্ত করেন আবদুর রহমান বিশ্বাসকে। অথচ, তিনি আজীবন রাজনীতি করেছেন, অসংখ্য নির্বাচিত পদে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং দলের একজন অনুগত সদস্য ছিলেন।

১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি পদের প্রথাগত নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনতে দলীয় তীব্র বিরোধিতার মধ্যেও বেছে নেন স্বৈরাচার থেকে গণতন্ত্রে রূপান্তরের সময়কালের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সাবেক প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ। এটি ছিল সাহসী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত। এমন সিদ্ধান্তে আমাদের রাষ্ট্রপতির পদ এবং হয়তোবা রাজনীতিরও প্রকৃতি বদলে যেতে পারতো। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্তের আর অনুসরণ করা হয়নি।

অপরদিকে, বিএনপি এই পদে দলীয় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে নিজ দল থেকে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে সংসদে বিতর্কিত করে, অপমান করে এবং পরিশেষে তাকে এমন কোনো দায় দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করে, যা কখনোই জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। এর ফলে ভবিষ্যতে নির্দলীয় রাষ্ট্রপতি নিয়োগের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়, যা শেখ হাসিনার উদ্যোগে বাস্তবায়নের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।

জেনারেল এরশাদের পতন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর গত ৩২ বছরে আমরা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ব্যর্থ হয়েছি। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, স্বাধীন সংবিধান পর্যবেক্ষক সংস্থা, স্বাধীন গণমাধ্যম থেকে শুরু করে গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে পারে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা পর্যায়ক্রমে ধ্বংস বা অকার্যকর করে দিয়েছি। এক কথায় বলতে গেলে, আমাদের পুরো শাসন ব্যবস্থায় কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই।

এটা আগেও লিখেছি এবং আবারো লিখছি, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যর্থতা হচ্ছে সংসদের ব্যবহারিক অকার্যকারিতা। আজ জনগণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন উত্থাপনের পরিবর্তে সংসদকে ব্যবহার করা হচ্ছে জনগণের টাকায় সরকারের প্রচারণা ও বিরোধী দলগুলোকে অবমাননা করার জন্য। যদিও সেখানে এখন বিরোধী দল খুঁজে পাওয়া কঠিন।

অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সংকুচিত হওয়ায় আমরা কেবল নির্বাচন নির্ভর গণতন্ত্রে পরিণত হয়েছি। সেই নির্বাচনও চূড়ান্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় ওইটুকুও আমরা হারিয়ে ফেলেছি। নির্বাচনের মাধ্যমে কিছুটা হলেও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যেত।

দ্য ডেইলি স্টারের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার এবার অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের দিকে যেতে পারে। আমরা সত্যিই সেটাই প্রত্যাশা করি। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় আমাদের নতুন রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন করা হয়েছে এবং দীর্ঘদিন দলের পাশে থাকা ও দলের প্রতি অবিচল বিশ্বস্ততাসহ তাকে নিয়োগ দেওয়ার যেসব কারণ আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে, তাতে এই সম্ভাবনাও বড় আকারে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments