রোজার আগেই নির্বাচন ও ভোটের অঙ্ক

ভিজ্যুয়াল: রেহনুমা প্রসূন

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তা ছিল, সেটি সম্ভবত অনেকখানি কেটে গেলো প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের একটি ব্রিফিংয়ের মধ্য দিয়ে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে রমজান মাস শুরুর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে এবং এজন্য ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

প্রেস সচিব জানান, প্রায় দুই ঘণ্টা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে মিটিং হয়েছে। সেখানে প্রধান উপদেষ্টা অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি নির্বাচন ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সব প্রস্তুতি ডিসেম্বরের আগে শেষ করতে বলেছেন।

যারা প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ১৬ বছর মানুষ কোনো ভোট দেখেনি। ভোটারের স্মৃতিতে আছে ভোটকেন্দ্রে মারামারি, ভোটচুরি। আগামী নির্বাচনে ভোটারদের যেন একটা ভালো অভিজ্ঞতা হয়, একটা সুন্দর স্মৃতি থাকে। প্রথমবার ভোট যারা দেবেন, এটা তাদের জন্য গৌরবের। তারা যেন ভালো অনুভব করেন।

প্রশ্ন হলো, নতুন ভোটারদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে কেন? পৃথিবীর কোনো দেশে এটা হয়? বড় জোর নারী-পুরুষের জন্য আলাদা বুথ থাকতে পারে। সুতরাং, নতুন ভোটারের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখার বিষয়ে যে প্রশ্ন ও সংশয়ের জন্ম হয়েছে, সেটি সরকার, বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনকে পরিষ্কার করতে হবে।

গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পরে যে যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করা হয়, সেখানে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও সেখানে প্রধান উপদেষ্টা কিছু শর্ত আরোপ করেছেন যে, যদি সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা যায় এবং যদি বিচার ও সংস্কারে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হয়। এই 'যদি কিন্তু'র ঘেরাটোপ থাকলেও রাজনৈতিক পরিসরে ফেব্রুয়ারি একটি বিশ্বাসযোগ্য ডেডলাইন হিসেবে অনেকের কাছেই গৃহীত হয়েছে। যেমন: গত ৭ জুলাই সিলেট সফরে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেন, সরকার ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন দেবে এবং নির্বাচনের মাধ্যমেই দেশ সঠিক পথে অগ্রসর হবে।

রোজার আগে সত্যিই নির্বাচন হবে?

যতক্ষণ না নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা বলার সুযোগ নেই যে, রোজার আগে নির্বাচন হচ্ছে। এমনকি তফসিল ঘোষণার পরেও নির্বাচনের বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত হবে না। কেননা অতীতেও দেখা গেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তফসিল পিছিয়েছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনের আগে এরকম নানা নাটকীয়তা ঘটেছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে নবম সংসদ নির্বাচন-পূর্ববর্তী পরিস্থিতির অনেক মিল রয়েছে।

রাজনীতিতে অনেক কিছু যেমন পূর্বানুমান করা যায়, তেমনি এমন অনেক কিছুই ঘটে যা মানুষের ধারণারও অতীত। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তন সেরকমই একটি ঘটনা। ওই ঘটনার পরে অনেকেই এখন এটা মনে করেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগামী ৫ আগস্ট কী ঘটবে সেটিই যেখানে বলা কঠিন, সেখানে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে—সে বিষয়ে সাত মাস আগে কোনো উপসংহারে পৌঁছানো যাবে না। কেননা, বড় দলগুলোর মধ্যে শুধু বিএনপিই আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ব্যাপারে বিশ্বাসী এবং তারা কোনোভাবেই এই ডেডলাইন পেছানোর পক্ষে নয়।

কিন্তু এই মুহূর্তে রাজনীতিতে ফ্যাক্টর অন্যান্য দল—যেমন: জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ—এখনও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে হবে বা হবে—এমন কোনো শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেনি। বরং নির্বাচন ইস্যুতে তাদের অবস্থান সরকারের মতোই—যদি বিচার ও সংস্কারে পর্যাপ্ত অগ্রগতি হয়।

অনেকে বলেন 'কাঙ্ক্ষিত সংস্কার'। কিন্তু এই পর্যাপ্ত বা কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের মানদণ্ডটি পরিষ্কার নয়। অর্থাৎ বিচারের কোন পর্যায়কে পর্যাপ্ত বা কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি বলা হবে এবং সংস্কারের কোন বিষয়গুলো সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এনসিপি বা জামায়াত নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহী নয়—তা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা আছে।

এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের মতো দলগুলোর তত সুবিধা। কারণ সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান, অতীতের নির্বাচনী ফলাফল, রাজনৈতিক দলগুলোর জনভিত্তি ও সর্বোপরি পারসেপশন—ইত্যাদির আলোকে এটি বিশ্বাস করা মানুষের সংখ্যাই বেশি যে, এই মুহূর্তে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, রাষ্ট্রীয় প্রভাবমুক্ত, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হলে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করবে এবং তারা সরকার গঠন করবে।

যদি তাই হয়, তাহলে জামায়াত, এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলনের মতো দলগুলোর কী লাভ? বিশেষ করে এনসিপি গঠিত হয়েছে যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা তরুণদের নেতৃত্বে, নির্বাচনের পরে যদি বিএনপি সরকার গঠন করে, তাহলে তাদের (এনসিপি) ভাষায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও বিচারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে কি না—সেটি নিয়ে এনসিপি সন্দিহান। সন্দিহান বলেই তারা বারবারই বলছে, বিচার ও সংস্কারের আগে নির্বাচন হবে না।

যদি এনসিপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের মতো দলগুলো সত্যিই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ব্যাপারে একমত না হয়, তাহলে কি রোজার আগে নির্বাচন হবে? যেহেতু সেনাপ্রধান প্রথমে বলেছিলেন ১৮ মাসের মধ্যে (ফেব্রুয়ারি) নির্বাচন হওয়া উচিত এবং পরে তিনি ডিসেম্বরের কথা বলেছেন—ফলে এই ইস্যুতে সেনাবাহিনীর ভূমিকাও বিবেচনার বিষয়।

নির্বাচন হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে?

এই প্রশ্ন করাও সঙ্গত যে, নির্বাচন হলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে? তা হয়তো হবে না। কিন্তু এখন যে ধরনের সরকারহীনতা এবং সরকারের ভেতরে অনেকগুলো ছায়া সরকার তৈরির ফলে কোনো প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো কাজ করছে না এবং কোথাও কোনো সিস্টেম নেই—অন্তত সেই পরিস্থিতির অবসান হবে।

দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি জনপরিসরে আছে তা হলো, আগামী নির্বাচনে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মব কতটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে? উত্তর হলো, সেনাবাহিনী যদি মবের বিরুদ্ধে কার্যত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে, তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হবে।

তৃতীয় প্রশ্ন, যারাই ক্ষমতায় আসুক, তারা ঠিকমতো দেশ চালাতে পারবে? বা কতদিন টিকবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে নির্বাচনটি যত দ্রুত সম্ভব হয়ে যাওয়া দরকার। এর কোনো বিকল্প নেই।

বাস্তবতা হলো, বিচার ও সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া। বিচারের অগ্রগতিও বেশ দৃশ্যমান। বিচারের প্রক্রিয়াটি বেশ ভালোই এগোচ্ছে। নির্বাচনের পরে যারাই সরকার গঠন করুক না কেন, তারা এই বিচারিক প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নেবে এবং আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করবেন বা করতে পারবেন—এটিই জনপ্রত্যাশা। কিন্তু বিচার ও সংস্কারে পর্যাপ্ত বা কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি বলতে কী বুঝানো হচ্ছে—সেটি যদি পরিষ্কার করা না হয় এবং পর্যাপ্ত অগ্রগতি হয়নি অজুহাত তুলে নির্বাচনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করা হয়, তার মধ্য দিয়ে বস্তুত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য বাড়বে। বিশেষ করে বিএনপি ও তার মিত্রদের সঙ্গে অন্যান্য দল ও সরকারের দূরত্ব বাড়বে—যা দেশকে আরও বড় সংকটের দিকে ঠেলে দেবে।

ভোটের অঙ্ক

নির্বাচন না হলে কার লাভ কার ক্ষতি—সেটি বোঝার মতো কাণ্ডজ্ঞান দেশবাসীর আছে। কিন্তু সঠিক নির্বাচন হলে কোন দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হবে, সে বিষয়ে কিছু ধারণা করা গেলেও সবসময় সব ধারণা সত্যি নাও হতে পারে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর যে জনপ্রিয়তা বা ভোটের অনুপাত হিসাব করা হয়, সেটি নির্ধারণ করা হয় মূলত ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে। এমনকি ২০০৮ সালের নির্বাচনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হলেও ওই নির্বাচনটিও যে শতভাগ ত্রুটিমুক্ত ছিল না—তা এখন নানা আলোচনায় আসছে। কেননা, এর আগের তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আসনে যে পার্থক্য ছিল, ২০০৮ সালের নির্বাচনে তার কোনো মিলই ছিল না। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় ২৩০টি আসনে, আর বিএনপি মাত্র ৩০টি আসনে। এই দুটি দলের আসনের পার্থক্য ২০০ কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। যে কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনও দেশের এই বড় দুটি দলের জনপ্রিয়তার মানদণ্ড নয়। বরং এর আগের তিনটি নির্বাচনকেই মানদণ্ড হিসেবে ধরতে হয়। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন হয়েছে যেহেতু একতরফা, ফলে এই তিনটি নির্বাচনের ফলাফলও কোনো রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের নিক্তি নয়।

তার মানে ২০০১ সালের পরে যে দুই যুগ সময় পার হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে দেশের বড় দলগুলোর জনপ্রিয়তা তথা ভোটের হিস্যা আসলেই কেমন, অর্থাৎ কোন দলের ভোট কত—সেটি ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

এই সময়ের মধ্যে যে প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে; যারা কোনোদিন ভোট দেয়নি বা দিতে পারেনি, তারা কাদেরকে ভোট দেবে, সেটি কারো পক্ষে বলা সম্ভব নয়। অতএব অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেই বিএনপি ক্ষমতায় আসবে আর বাকি সব দল রাজনীতি থেকে হাওয়া হয়ে যাবে, অঙ্কটা এত সহজ নাও হতে পারে।


আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments

The Daily Star  | English

Economist Abul Barkat held in corruption case

Prof Abul Barkat was the chairman of state-owned Janata Bank PLC

44m ago