অপচয় নিয়ে দুটি কথা

বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে নানা ধরনের আবর্জনা ফেলা হয়। স্টার ফাইল ছবি

আসুন সবাই মিলে অপচয়টা একটু কম করি। এই অপচয় কিন্তু শুধু টাকা কম খরচের ক্ষেত্রে না। এই ধরুন, তিনতলা থেকে নামবেন। হাতে কিছুটা সময় থাকলে লিফট ব্যবহার না করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়ুন। শরীরের জন্য এটা কিন্তু ভালো একটি ব্যায়াম।

প্রতিদিন কিছু না কিছু খাবার অপচয় হয়ে যাচ্ছে? পরিমাণের থেকে একটু কম রান্না করুন। একটু কম খেলে ভালো বৈকি মন্দ নয় কিন্তু। অথবা প্রতিবেশী, কেয়ারটেকার কিংবা বাসার সাহায্যকারীকে খাবার রান্না হওয়ার পর বাটিতে করে একটু দিয়ে আসুন। দেখবেন তিনিও খুব খুশি হবেন, আর আপনার মধ্যেও অসাধারণ ভালোলাগা আর আত্মতৃপ্তি আসবে। খাবার রান্নার পর ঠান্ডা করে বাটিতে ভরে ফ্রিজে তুলে রাখুন। আরেকদিন সময় বেঁচে যাবে কিংবা হুট করে মেহমান আসলে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ঘামতে হবে না।

আজকাল বাসায় কাপড়ের চেয়ে যেন পলিথিন বেশি। ছোট, বড়, লাল, নীল, সবুজ, কালো আর সাদা। বাজারে গেলে একটি চাইলে দোকানদার খুশি মনে আপনাকে তিনটি দিয়ে দেবেন। আরে ভাই, একটু ভাবুন! পলিথিনের ক্ষতিকার প্রভাব আমরা কে না জানি? আমাদের সবার একটু একটু খামখেয়ালিপনা আর উদাসীনতা আমাদের ভয়ানক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ভাবছেন, আপনার সময়ে পার পেয়ে যাবেন। হয়তো তাই। কিন্তু দায়িত্ববোধের প্রশ্নে নিজের কাছে উত্তর দিতে পারছেন তো? ভালো কিছু না পারি, কিন্তু আমাদের ছোট ছোট উদ্যোগ আর সচেতনতা যদি এই অপচয় কমাতে পারে তাহলে মন্দ কী বলুন তো?

বাজারে যাওয়ার আগে বড় থেকে মাঝারি সাইজের নির্দিষ্ট ব্যাগ নিয়ে যাওয়ার অভ্যাস করুন। বার বার ভুলে যাচ্ছেন? অসুবিধা নেই। আগের দিন ব্যাগটি গুছিয়ে রাখুন কিংবা মূল দরজার আশপাশে রাখুন, যাতে বের হবার সময় খুঁজতে গিয়ে ব্যাগ নেওয়ার প্রতি অনীহা তৈরি না হয়। এটা কিন্তু খুবই ভালো একটি চর্চা। আপনাকে দেখে আরেকজনও তাই করবেন।

দোকানদারকে বলুন আপনার ব্যাগে জিনিসগুলো গুছিয়ে দিতে। কাঁচা সবজি আর মাছ-মাংস বাজারের জন্যও আলাদা ব্যাগ ব্যবহার করুন, যেটা কি না ধুয়ে পুনরায় ব্যবহার করতে পারবেন।

দুধ, নুডুলস, বিস্কুট, সেমাই, চানাচুর এবং আরও অনেক কিছুর প্যাকেট আমরা গুছিয়ে রাখতে পারি। ফ্রিজে মাছ-মাংস রাখতে নতুন পলিথিন ব্যবহার না করে এগুলো কাজে লাগান। 

দেশের বাইরে ওয়ানটাইম ইউজের (একবার ব্যবহার করা যায়) জন্য গ্লাস, প্লেট ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। ওদের ময়লা আবর্জনা ব্যবস্থাপনা খুবই চমৎকার। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা তারা কল্পনাই করতে পারেন না। এটা আসলে অন্যায়। নিজের ময়লা টিস্যু পর্যন্ত ফেলেন না তারা। কোক বা পানি খাওয়ার শেষে প্লাস্টিকের ছোট বোতল তো না-ই।  পকেটে/ব্যাগে এক কোণায় রেখে দেয়। পরে জায়গা মতো ফেলে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আমি একবার গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। একবার খেয়াল করলাম বাড়ির পাশের পুকুরে অনেকগুলো সাদা রঙের ওয়ানটাইম প্লেট খাওয়া শেষে সবাই ফেলে দিয়েছেন। খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম। এই দৃশ্য এখন হয়তো অহরহ দেখা যায়। শহর কিংবা গ্রাম সবখানে। কোথাও কোনো সচেতনতা নেই।

পুকুর কিংবা খাল তো আর ডাস্টবিন নয়। ওখানে অনেক প্রাণী বাস করে। মাছ, ছোট জীব এবং পানির নিচের গাছপালা। এরা পরিবেশে অনেক গুরুত্ব বহন করে। আপনি পরিবেশ ধ্বংসে অবদান রাখছেন না তো? এটা তো পাপ, তাই না? এই যে চারদিকে এখন এত মশা, মাছি আর তেলাপোকা। ডেঙ্গু থেকে শুরু করে বিভিন্ন জ্বরের প্রাদুর্ভাব। এই সব অপচয় আর অপরিচ্ছন্নতার ফলাফল। আসুন, এরকম করা থেকে বিরত থাকি এবং অন্যকেও এ বিষয়ে সচেতন করি।     

টার্কির (তুরস্ক) ইস্তানবুলের বসফরাসে বহু লোক প্রতিদিন জাহাজ কিংবা ক্রুজে করে বেড়াতে যান। অসংখ্য পর্যটকের আনাগোনা প্রতিদিন। অজস্র রেস্টুরেন্ট বসফরাসের তীর ঘেঁষে। আমি বেড়াতে গিয়েছিলাম কয়েকবার। কোনো ময়লা না দেখে কৌতূহলী হয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম, তারা সপ্তাহ অন্তর জাহাজ দিয়ে মেশিনের সাহায্যে পানি থেকে বিভিন্ন ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করেন। তাই তো বসফরাস এত সুন্দর! আমাদের বুড়িগঙ্গা আর পতেঙ্গা সৈকতের কথা মনে করে আমি মাথা নিচু করে হাঁটছিলাম, বসফরাসের তীর ঘেঁষে।

আরেকটি উদাহরণ দিই। আপনি আগে শুনেছেন হয়তো। ইউরোপ-আমেরিকায় সবাই গৃহপালিত পশু, যেমন কুকুর-বিড়াল অনেক পছন্দ করেন। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে কিংবা বিদেশ ভ্রমণে ওদের সঙ্গে নিয়ে যান। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে কুকুর-বিড়াল যদি মলত্যাগ করে, সেটা মালিক টিস্যু বা পলিথিনে মুড়িয়ে পকেট কিংবা ব্যাগে তুলে নেন। পরে নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলে দেন। এটাই তাদের সংস্কৃতি, ভদ্রতা আর দায়িত্ববোধ। আপনি এতে যদি নাক সিটকান সেটা আপনার দুর্বলতা। তারা মনে করেন পরিবেশ নোংরা করা ঘোরতর অন্যায় আর অভদ্রতা। 

আরও অনেক কিছু নিয়ে আলাপ করা যায়। জানি যে আরও অনেক বড় কিছুর অপচয় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিজ নিজ জায়গা থেকে আজ যদি এই ছোট বিষয়গুলো (আসলে ছোট নয়, প্রভাব অনেক বেশি) নিয়ে চিন্তা করি, সচেতন হই তাহলে একদিন বড় বিষয়গুলো এমনিতেই হয়তো ম্যানেজ হয়ে যাবে। আমাদের ছোট পুকুরগুলো রোদের আলোয় চকচক করবে, বুড়িগঙ্গায় সবাই পরিবার নিয়ে বেড়াতে যাবেন, পতেঙ্গা আর কক্সবাজার হবে বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণ। 

অপচয় রোধ করুন, সুস্থ আর সুন্দরভাবে বাঁচুন।

তাহমিনা হক: সমাজ ও মানবাধিকার উন্নয়নকর্মী

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Made with US cotton? Pay less at US customs

US customs will apply a tariff rate only to the non-American portion of a product's value

10h ago