কার্বন দূষণ রোধ করবে ‘বেকিং সোডা স্পঞ্জ’

ক্যালিফোর্নিয়ার এক দল বিজ্ঞানী বেকিং সোডা দিয়ে এমন একটি স্পঞ্জ তৈরি করেছেন, যার মাধ্যমে বাতাস থেকে কার্বন শুষে নেওয়া যাবে।
কার্বন দূষণ। ছবি: রয়টার্স

বাতাসে দিনদিন বাড়ছে কার্বন দূষণ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীবনযাপন ও পরিবেশ। তবে বিজ্ঞানীরা এর একটা সমাধান খুঁজে বের করেছে। এতে করে দূষণ সম্পূর্ণ রোধ না করা গেলেও, অনেকটাই কমিয়ে আনা যাবে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ।

পৃথিবী নামের প্রাণশক্তিতে ভরপুর এই গ্রহের উত্তাপ দিনদিন বাড়িয়ে দিচ্ছে কার্বন। প্রকৃতি অবশ্য প্রতিনিয়তই কার্বন শোষণের দায়িত্ব পালন করে চলেছে। বৃক্ষ করছে, সমুদ্র করছে। কিন্তু মানুষের উৎপাদিত কার্বনের পরিমাণ এতটাই বেশি যে প্রকৃতিও হাঁপিয়ে উঠেছে! আবারও তাই শরণাপন্ন হতে হলো মানুষেরই আবিষ্কারের কাছে। কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে প্রযুক্তি।

বছরের পর বছর ধরে গবেষকরা এমন একটি প্রযুক্তি তৈরি করতে চাইছিলেন, যা চিমনি বা কলকারখানার পাইপ থেকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার আগেই কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নিতে পারবে এবং অন্য কোথাও তা মজুত করা যাবে। সম্প্রতি এ অপেক্ষার অবসান ঘটার সম্ভাবনা দেখা গেছে।

নতুন আবিষ্কৃত এ প্রযুক্তিতে সাহায্য করবে একটি অত্যন্ত পরিচিত খাদ্য উপকরণ। ক্যালিফোর্নিয়ার এক দল বিজ্ঞানী বেকিং সোডা দিয়ে এমন একটি স্পঞ্জ তৈরি করেছেন, যার মাধ্যমে বাতাস থেকে কার্বন শুষে নেওয়া যাবে।

উদ্ধারে 'বেকিং সোডা'

ইতোমধ্যেই বিজ্ঞানীরা বেকিং সোডা দিয়ে তৈরি মাইক্রোক্যাপসুল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন এবং তারা মনে করছেন, বর্তমানে যে কার্বন দূষণরোধী প্রযুক্তি রয়েছে, তার চেয়ে শক্তি ও অর্থ, উভয় হিসেবেই অন্তত ৪০ শতাংশ কম খরচে এটিকে কাজে লাগানো সম্ভব। এই মাইক্রোক্যাপসুলে কার্বন আনাগোনার জন্য একটি পলিমার খোলসের ভেতর রাখা হয়েছে নির্দিষ্ট পরিমাণে সোডা অ্যাশ বা সোডিয়াম কার্বনেট।

ছোট ছোট এই নীল বলগুলো একটি জলীয় দ্রবণে রাখা হয়, যেন একটি অপরটির সঙ্গে লেগে না যায়।

যখন ক্যাপসুলগুলো কার্বন ডাই অক্সাইডের সংস্পর্শে আসে, তখন রঙ বদলে হলদে বাদামি হয়ে যায়। আর ক্যাপসুলে থাকা সোডিয়াম কার্বনেট, এ গ্যাসের সঙ্গে বিক্রিয়া করে তৈরি করে সোডিয়াম বাই কার্বনেট, অর্থাৎ রান্নায় ব্যবহৃত 'বেকিং সোডা'।

লিভারমোর নিবাসী গবেষক জশুয়া স্টোলার্ফ বিশ্বাস করেন, 'অনেক সময় বড় বড় সমস্যার সমাধান আমাদের চোখের সামনেই থাকে, শুধু চোখে পড়ে না। ঠিক যেমন পৃথিবীর রক্ষাকর্তা হিসেবে বেকিং সোডার আবির্ভাব।'

বর্তমানে কলকারখানা বা অন্য জায়গা থেকে কার্বন নিঃসরণের যে প্রযুক্তি আছে, তাতে ব্যবহৃত হয় মনো-ইথানোলামাইন, যা আরও নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে। একইসঙ্গে এই পদ্ধতিটি বিষাক্ত ও ব্যয়বহুল। বিকল্প হিসেবে তাই নতুন এই আবিষ্কার অনেক বেশি সহজ। 'সায়েন্স অ্যাডভান্সেস' শীর্ষক জার্নালে প্রকাশিত এ বিষয়ক একটি গবেষণা ছাপা হয়েছে সম্প্রতি।

গবেষকরা বলছেন, সঠিক ব্যবহারে বর্তমান 'কার্বন ক্যাপচার' প্রযুক্তি থেকে এটি ৩ গুণ বেশি কার্যকর হতে পারে। এর আরেকটি বড় সুবিধা হচ্ছে, প্রাপ্ত বেকিং সোডা দ্রবণ উত্তপ্ত করার মাধ্যমে শোষিত কার্বনকে আরও বিশুদ্ধ করা সম্ভব। এর ফলে বাণিজ্যিক কাঁচামাল হিসেবে বিশুদ্ধ কার্বনের ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ করা যাবে।

সীমাবদ্ধতা

এ পদ্ধতিতে তৈরি হওয়া বিশাল পরিমাণ সোডিয়াম বাই কার্বনেটকে একটু একটু করে সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়ার কথাও চিন্তা করা হচ্ছে। এ নিয়ে আবার চিন্তায় পড়েছেন আরেক গবেষক স্টুয়ার্ট হ্যাসজেলডাইন। তিনি এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের 'কার্বন ক্যাপচার অ্যান্ড স্টোরেজ' বিষয়ের এই অধ্যাপক গবেষণায় ব্যবহৃত রাসায়নিক ফর্মুলাকে সাধুবাদ জানান এবং সেইসঙ্গে বলেন, 'এত বিশাল পরিমাণে সোডিয়াম বাই কার্বনেট সমুদ্রে নিষ্ক্রমণকে আইনগতভাবেই "দূষণ" বলা যেতে পারে, যা কিনা আন্তর্জাতিক সব চুক্তিতে নিষিদ্ধ।'

তা ছাড়াও সমস্যা আছে মাইক্রোক্যাপসুল উৎপাদনের সীমাবদ্ধতায়। কেননা বর্তমানে ১ দিনে মাত্র ১ কেজি ক্যাপসুলই শুধু উৎপাদন করা যাচ্ছে। ফলে, প্রকল্পটির অনেক দীর্ঘমেয়াদি হয়ে যাচ্ছে।

এসব সীমাবদ্ধতার পরও যথেষ্ট আশাবাদী সংশ্লিষ্ট গবেষকেরা। লেহাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক অরুণ সেনগুপ্তর মতে, এই আবিষ্কারটি ইতোমধ্যেই ল্যাব থেকে বাইরে নিয়ে পরীক্ষা শুরু করে দেওয়া উচিত। তিনি বলছেন, 'বিশ্বের অন্তত ২-৩ জায়গায় এটি ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। অন্যরাও এতে যুক্ত হোক, এর ভুল খুঁজে বের করুক, আবিষ্কারটির আরও উন্নয়ন হোক এবং সেভাবেই এগোনো যাক।'

তথ্যসূত্র: বিবিসি ও সিএনএন

Comments