২৮ অক্টোবর: বিএনপির পক্ষে সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব ছিল?

‘নির্বাচনের মাস দুয়েক আগে বিএনপি আর সহিংসতাহীন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অবস্থান ধরে রাখতে পারল না। আর তাতেই ক্রমশ মনোবল হারানো আওয়ামী লীগ মনোবল ফিরে পেয়েছে।’

যা জানা গেল, যা দেখা গেল, তারচেয়েও হয়তো বেশি কিছু অদৃশ্য থেকে গেল। বলছি ২৮ অক্টোবরের কথা।

এদিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুটি বড় রাজনৈতিক দলের পরিপক্বতা, দূরদর্শিতা ও কৌশলের পার্থক্য বোঝা গেল।

বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বা সরকার পতনের জন্য যে আন্দোলন করছে, দিন দিন সে আন্দোলন মোকাবিলা করা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছিল। শত উসকানি সত্ত্বেও বিএনপি সহিংসতার পথে যায়নি। আন্দোলন—বিশেষ করে জনসভাগুলোতে বিপুল লোকসমাগম ঘটিয়েছে। কোনো প্রকার সহিংসতা ছাড়া আন্দোলন এগিয়ে নিয়েছে।

সরকার নানাবিধ প্রতিকূলতা সৃষ্টি করেও বিএনপির সমাবেশে মানুষের অংশগ্রহণ ঠেকাতে পারেনি। ২৮ অক্টোবরও জনস্রোত ঠেকাতে পারেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির দাবির যৌক্তিকতা আরও বেশি জোরালো হয়ে উঠছিল। একইসঙ্গে জোরালো হচ্ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন বিষয়ে বিদেশিদের চাপ।

ফলে সরকার প্রতিনিয়ত কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল। সরকার তা মুখে প্রকাশ না করলেও, আচরণে বোঝা যাচ্ছিল। মনোবল হারাচ্ছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।

আওয়ামী লীগ সরকার বারবার বলার চেষ্টা করছিল যে বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল, তারা দেশের মানুষের জানমালের ক্ষতি করে।

অবশেষে নির্বাচনের মাস দুয়েক আগে ২৮ অক্টোবর বিএনপি তাদের আন্দোলনকে আর অহিংস রাখতে পারল না। সহিংস রূপ নিল বিএনপির আন্দোলন।

সাধারণ রাজনৈতিক কার্যক্রম বা কর্মসূচি ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলনের কর্মসূচির বৈশিষ্ট্য এক হয় না। আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক নেতাদের অত্যন্ত দূরদর্শী হতে হয়, সতর্ক থাকতে হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই একাধিক বিকল্প ভেবে রাখতে হয় এবং সম্ভাব্য কী হলে তার পরিপ্রেক্ষিতে কী কর্মসূচি দেওয়া যেতে পারে, সেগুলো ভাবনা বা পরিকল্পনার মধ্যে থাকতে হয়।

কিন্তু ২৮ অক্টোবরের এত বড় জনসমাবেশ থেকে বিএনপি কী অর্জন করতে চায়, সারা দেশ থেকে আগত নেতাকর্মীরা তা জানত না। কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছেও পরিষ্কার ছিল বলে মনে হয়নি। বিএনপি বসে পড়তে চায়—আওয়ামী লীগের চালানো এ প্রচারণায় বিএনপি নেতাকর্মীরা বিভ্রান্ত হয়েছে।

বিএনপি যদিও বারবার বলেছে যে তাদের বসে পড়ার কোনো পরিকল্পনা নেই বা তারা কোনো সহিংসতা করবে না। কিন্তু, ঢাকার বাইরে থেকে আসা তৃণমূলের নেতাকর্মীরা পরিষ্কার কোনো নির্দেশনা পায়নি।

এ ছাড়া, যেকোনো ধরনের উসকানিতেও কোনো অবস্থায় সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে যাওয়া যাবে না, তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের এমন নির্দেশনাও স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়নি।

সরকার দলীয় নেতাদের 'সংঘর্ষে জড়ানোর ইঙ্গিতপূর্ণ' বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেও বিএনপি নেতারা সতর্ক হননি।

বিএনপি নেতাকর্মীরা ঢাকার প্রবেশমুখে পুলিশের তল্লাশির নামে হয়রানির শিকার হয়েছেন, গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঢাকায় ঢুকতে কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি।

আওয়ামী লীগের সমাবেশে কর্মীদের 'লাঠি' হাতে অংশ নিতে বলা হয়েছিল। এ নির্দেশের পর রাজধানীর বেশকিছু মোড়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের লাঠি হাতে দেখা গেছে।

২৮ অক্টোবর সংঘর্ষের শুরু কাকরাইল মোড়ে। প্রথমাবস্থায় যতদূর জানা গেছে, বিএনপি কর্মীরা সেখানে আওয়ামী লীগ কর্মীদের বহনকারী একটি বাসে প্রথমে হামলা করেছে। একদিন পরে ২৯ অক্টোবর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু ভিডিওচিত্র ঘুরছে। সেখানে দেখা যায়, লাঠিধারী কিছু তরুণ একটি ব্যক্তিগত গাড়ি ভাঙচুর করছে। তাদেরকে আবার পুলিশের আশেপাশেও দেখা যায়।

কাকরাইল মোড়ের বাসে বিএনপি কর্মীরা হামলা করেছে, গণমাধ্যম এমন সংবাদ প্রকাশ করেছে। ব্যক্তিগত গাড়ি ভাঙচুর করা তরুণদের পরিচয় কী? পুলিশ আশেপাশে থাকলেও তাদের ধরল না কেন? গণমাধ্যম এই প্রশ্ন তোলেনি। বিএনপি হয়তো তুলবে বা তুলতে পারে। তুললেও প্রথমে হামলা করার দায় থেকে মুক্ত হওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলায়ও বিএনপি নেতাকর্মীরা অংশ নিয়েছে—গণমাধ্যম এ সংবাদ প্রকাশ করেছে।

পুলিশের ওপর আক্রমণ ও একজন কনস্টেবলকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির পক্ষে কি অস্বীকার করা সম্ভব যে তারা হামলা করেনি?

কমপক্ষে ১৭ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। আহত সাংবাদিকরাও বলেছেন, তাদেরকে বিএনপি নেতাকর্মীরা মারধর করেছে। সাংবাদিকদের ওপর বিএনপি নেতাকর্মীদের ক্ষোভ থাকতে পারে। ক্ষোভ যদি শতভাগ যৌক্তিকও হয়, তাহলেও কি মারধর করতে হবে?

সাংবাদিকদের মেরে কী অর্জন হলো বিএনপির? পুলিশের ওপর আক্রমণের অর্জনই বা কী? বিএনপি কি জামায়াতের সেই পুলিশ মারধরের ঘটনা ভুলে গেছে? যুদ্ধাপরাধের বিচার চলাকালীন পুলিশকে আক্রমণ করতে শুরু করেছিল জামায়াত-শিবির। তাতে জামায়াত-শিবিরের কিছু অর্জন হয়নি, বিসর্জন হয়েছে বহু কিছু। বিএনপির মনে রাখা দরকার ছিল যে কর্মসূচি যার, সহিংসতার দায় তার।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দলের আরও অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেকে আত্মগোপন করে আছেন গ্রেপ্তার আতঙ্কে।

এ অবস্থায় করণীয় কী, জানেন না কর্মীরা। বিএনপির ডাকে মোটামুটিভাবে একটি হরতাল পালিত হলো। হরতালের সমর্থনে প্রায় কোথাও বিএনপি নেতাকর্মীদের দেখা যায়নি। কিন্তু বাস-ট্রাকে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। 'হরতাল সমর্থকরা বাসে আগুন দিয়েছে' এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিএনপি মাঠেই থাকল না, আগুন দিল কীভাবে? আগুনের এই ঘটনা যে ঘটতে পারে এবং দায় বিএনপির ওপর পড়বে, তা কি নেতাদের ভাবনায় ছিল?

আজ থেকে সারা দেশে তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি। এটি আরেকটি অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত।

এই অবরোধকে কেন্দ্র করে দেশের বেশ কিছু স্থানে ইতোমধ্যে সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়েছে।

এসব সাংঘর্ষিক অবস্থার দায়ও নিতে হবে বিএনপিকে। অবরোধ জামায়াতও ডেকেছে। দায়মুক্ত থাকার কৌশল বিএনপির চেয়ে অনেক বেশি ভালো জানে জামায়াত। ২৮ অক্টোবরের কোনো দায় তাদের নিতে হয়নি। বিএনপিকে জনসভার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, জামায়াতকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। অনুমতি না নিয়েও সমাবেশ জামায়াতই করেছে, বিএনপিকে করতে দেওয়া হয়নি। রাজনীতির এই সমীকরণ নিয়ে বিএনপির ব্যাখ্যা কী, আদৌ কিছু আছে কি না, কর্মীরা তা জানে না।

মিয়া আরেফি নামক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কথিত উপদেষ্টার আবিষ্কারক বিএনপির কোনো নেতা? বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয়ে দলীয় কার্যালয়ে মিয়া আরেফির সংবাদ সম্মেলনের মতো হাস্যকর ও অপরাধমূলক কর্ম বিএনপি কীভাবে করতে পারল?

সহিংসতাহীন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ছিল বিএনপির এবারের আন্দোলনের সবচেয়ে বড় শক্তি।

নির্বাচনের মাস দুয়েক আগে তারা আর সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারল না। আর তাতেই ক্রমশ মনোবল হারানো আওয়ামী লীগ মনোবল ফিরে পেয়েছে। ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক পরিপক্বতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে বিএনপির জন্যে ফাঁদ তৈরি করেছে। অপরিপক্বতা ও অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে বিএনপি সেই ফাঁদে পড়েছে।

এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, যে প্রক্রিয়ায় ঘটনাক্রম এগিয়েছে, যে পুলিশি অ্যাকশনে টিয়ারশেল আর কয়েক হাজার সাউন্ড গ্রেনেড মেরে বিএনপির জনসভা পণ্ড করে দেওয়া হলো, বক্তব্য ও লাঠি হাতে আওয়ামী লীগের উসকানি, তাতে বিএনপির পক্ষে কী করা সম্ভব ছিল? সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব ছিল? যা কিছুই ঘটুক, বিএনপিকে শান্ত থাকতেই হবে—বিএনপির কাছ থেকে এমনটাই কি প্রত্যাশা করা হচ্ছে? হয়তো কিছুটা করা হচ্ছে। পুলিশি তৎপরতা ও লাঠি হাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অলি-গলিতে যেভাবে বিএনপি খুঁজেছে, তাতে এটাও অনুমিতই ছিল যে, শেষ পর্যন্ত বিএনপির কর্মসূচির সমাপ্তি শান্তিপূর্ণভাবে করতে দেওয়া হতো না। তবে বিএনপি নেতৃত্ব সতর্ক থাকলে পুরোপুরি না হলেও সংঘর্ষের অনেক কিছুই এড়ানো সম্ভব ছিল।

[email protected]

Comments