গ্রিন ফ্যাক্টরির দেশে গুলিবিদ্ধ শ্রমিক

বেতন বাড়ানোর দাবিতে রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী এলাকায় যেদিন (৩১ অক্টোবর) পোশাক শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে যুবলীগের এক নেতার আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়ার ছবি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল, তার এক সপ্তাহ পরেই ঢাকার অদূরে গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় বিক্ষোভরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে নিহত হন পোশাকশ্রমিক আঞ্জুয়ারা খাতুন। এর তিনদিনের মাথায় ১১ নভেম্বর নিহত হন আরেক শ্রমিক জালাল উদ্দিন।

নূন্যতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে চলমান আন্দোলনে এ পর্যন্ত অন্তত চার পোশাক শ্রমিকের প্রাণ হারানোর খবর পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে, এটি গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় শ্রমিক অসন্তোষ। আন্দোলনকারী শ্রমিকদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার পুলিশের সংঘর্ষ এবং কিছু পোশাক কারখানায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।

বর্তমানে পোশাক শ্রমিকদের নূন্যতম বেতন মাসে ৮ হাজার ৩০০ টাকা। সরকারের নিয়োগ করা মজুরি বোর্ড সর্বনিম্ন বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা করার ঘোষণা দিলেও শ্রমিকরা তা মানতে নারাজ। তাদের দাবি, জীবনযাপনের ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, তাতে এখন সাড়ে ১২ হাজার টাকায় সংসার চালানো কঠিন।

পোশাকশ্রমিকদের আন্দোলনে গাজীপুরে কারখানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও শ্রমিক পুড়ে মৃত্যুর ঘটনায় ১৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ১০৭ জনের নাম উল্লেখ করা হলেও অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে ১২ হাজারের বেশি, যাদের অধিকাংশই পোশাকশ্রমিক।

অথচ এই পোশাক শ্রমিকদের ঘাম ও রক্তের বিনিময়ে সারা বিশ্বের বাজারে জ্বল জ্বল করে 'মেড ইন বাংলাদেশ'। এই পোশাক শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিতে বাংলাদেশে গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কিছু গ্রিন ফ্যাক্টরি। শুধু তাই নয়, সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশেই গ্রিন ফ্যাক্টরি বা সবুজ কারখানার সংখ্যা বেশি। অথচ সেই গ্রিন ফ্যাক্টরির দেশেই বেতন বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিককে রাস্তায় নামতে হয়। গুলি খেয়ে মরতে হয়।

দেশের প্রায় ৮০ ভাগ রপ্তানি আয় আসে যে খাত থেকে, সেই খাতের শ্রমিকরা কাজের পরিবেশ, বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দাবিতে রাস্তায় নামলেই মালিকরা কারখানা বন্ধে হুমকি দেন। বন্ধ করেও দেন। সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষের ফলে তিন শতাধিক পোশাক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সেইসঙ্গে সব কারখানায় নিয়োগ বন্ধ এবং কাজ না করলে বেতন বন্ধেরও সিদ্ধান্ত হয়। তার মানে শ্রমিকদের প্রত্যাশিত মজুরি বৃদ্ধির দাবি উপেক্ষা করতে সব ধরনের পন্থা ব্যবহার করছেন কারখানা মালিকরা।

মুদ্রার অন্য পিঠও আছে। বিজিএমইএর হিসাবে, করোনা মহামারির কারণে দেশে ২০২০-২১ সালে ৩১৭টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আর করোনা-পরবর্তী সময়ে প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে না পারাসহ নানা কারণে বন্ধ হয়েছে আরও ২৬০টি কারখানা।

সুতরাং শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর দাবি যেমন ন্যায়সঙ্গত, তেমনি পোশাক খাত এ মুহূর্তে যে নানাবিধ সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, সেই বাস্তবতাটিও শ্রমিকদের উপলব্ধি করা জরুরি। কারণ কারখানা চালু থাকলে তারা অন্তত খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারবেন। আন্দোলন কিংবা অব্যাহত লোকসানের মুখে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকদের না খেয়ে থাকতে হবে। বিকল্প কাজের সন্ধানে যেতে হবে। বিকল্প কাজের সুযোগ খুবই কম। কেননা দেশের শ্রমবাজারের অবস্থা যথেষ্ট সংকটাপন্ন।

গত বছরের ৯ অক্টোবর বাংলা ট্রিবিউনের একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল: 'বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ পোশাক কারখানা বাংলাদেশে।' কিন্তু এর ঠিক দুই সপ্তাহের মাথায় ২২ অক্টোবর প্রথম আলোর সংবাদ শিরোনাম: 'গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে ৬০ ভাগ বস্ত্রকল ঝুঁকিতে।'

বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলীকে উদ্ধৃত করে খবরে বলা হয়, ২০২২ সালের মার্চে গ্যাসের সংকট শুরু হয়। জুলাইয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। আর আগস্ট থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, নরসিংদীর মাধবদী, ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার-আশুলিয়া, গাজীপুরের শ্রীপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বস্ত্রকলগুলো গ্যাস–সংকটের কারণে দিনে গড়ে ১২ ঘণ্টা বন্ধ থাকছে। এতে করে কারখানাগুলো উৎপাদনক্ষমতার মাত্র ৩০-৪০ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে।

ফলে যে প্রশ্নটি এখন সামনে আসছে তা হলো, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরে দেশের বদলে যাওয়া বা আমূল পাল্টে যাওয়া পোশাক কারখানায় কি তবে এখন শঙ্কার পদধ্বনি? এরকম প্রশ্নের মধ্যেই গত বছরের ১৪ নভেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপারেল ফেডারেশনের (আইএএফ) আয়োজনে ৩৭তম আইএএফ বিশ্ব ফ্যাশন সম্মেলনে বক্তারা বলেন, পরিবেশের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত না করলে বাংলাদেশের পক্ষে ইউরোপের বাজার ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে।

তার মানে শুধু উৎপাদনের প্রধান শর্ত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করাই নয়, বরং পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টিও বাংলাদেশের পোশাক খাতের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। যদিও পরিবেশের ইস্যুটি যে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই নিশ্চিত করতে পারছে, তার প্রমাণ বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ এবং সবুজ পোশাক কারখানার দেশ হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের (আইটিসি) সর্বশেষ প্রকাশনায় এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই আশাব্যঞ্জক খবরের মধ্যেই বেতন বাড়ানোর দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষে অস্থির দেশের তৈরি পোশাক খাত।

প্রশ্ন হলো, যে শ্রমিকদের কারণে সারা বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশে উৎপাদিত পোশাকের কদর; যে দেশ গ্রিন ফ্যাক্টরির জন্য সারা বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে, সেই দেশের শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবিতে রাস্তায় নামতে হবে কেন? পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিতে হবে কেন? হাজার হাজার শ্রমিককে আসামি করে মামলা দেওয়া হবে কেন?

এই প্রশ্নের মধ্যে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এই বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, শ্রমিকের অধিকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। তিনি বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিক আন্দোলনের নেতা কল্পনা আক্তারের কথা উল্লেখ করে বলেন, 'কল্পনা জানিয়েছেন ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস তার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। পরামর্শকের ভূমিকা রেখেছে। আর এ জন্য তিনি (কল্পনা) এখনো বেঁচে আছেন।' (প্রথম আলো ১৭ নভেম্বর ২০২৩)। তার এই কথায় এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পোশাক খাতের আন্দোলন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ওয়াকিবহাল এবং এই খাতে শ্রমিকবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

অস্বীকার করা যাবে না, শ্রমিক অসন্তোষজনিত সহিংসতার কারণে কারখানার মালিকরা বিদেশি অর্ডার সরবরাহে ব্যর্থ হলে তার ফলে সাধারণ শ্রমিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কেননা ভবিষ্যতে অর্ডার হারালে কারখানায় উৎপাদন কমে যাবে। এমনকি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। সুতরাং শ্রমিকদের বুঝতে হবে যে, তাদের অধিকার আদায়ের জন্য এমন কোনো আন্দোলন করা যাবে না, যা এ খাতকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

সাম্প্রতিক আন্দোলনে যে শ্রমিকরা নিহত হলেন, তারা কি কোনো ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন? তারা যদি সংসারের একমাত্র উপাজর্নকারী ব্যক্তি হন, তাহলে এই পরিবারগুলোর ভবিষ্যৎ কী? যারা বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাদের ভবিষ্যৎ কী?

আবার মালিকদেরও এটি মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে পোশাক রপ্তানিতে তৃতীয় শীর্ষ দেশ বাংলাদেশ। পোশাক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত মৎস্য, চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিক পণ্যসহ নানা ধরনের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। সুতরাং মার্কিন প্রশাসন যে নীতির কথা বলছে তাতে বাংলাদেশের পোশাক খাতসংশ্লিষ্টদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। তাছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দল তথা সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েনও এখন স্পষ্ট। সুতরাং এই টানাপোড়েনের সঙ্গে পোশাক খাতের অস্থিরতা যুক্ত হলে সেটির পরিণাম কী হবে—তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলেরই চিন্তা করতে হবে। ঘোলা পানিতে কেউ মাছ শিকারের চেষ্টা করছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। মনে রাখতে হবে, দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার হাতছাড়া হয়ে গেলে দেশের অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়বে দীর্ঘমেয়াদী—যা অনেক বড় রাজনৈতিক সংকটের চেয়েও জটিল।

দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাক খাতকে পাটের পরিণতি বরণ করতে হয় কি না, সে বিষয়েও সরকার, রাজনৈতিক দল, কারখানা মালিক ও শ্রমিকদের সতর্ক থাকতে হবে। কেননা শুধু লোকসান কিংবা শ্রমিকদের শোষণজনিত ক্ষোভ নয়, বরং বাংলাদেশ থেকে পাটশিল্প গায়েব করে দিতে পারলে যাদের লাভ, তারা এর পেছনে ইন্ধন দিয়েছে বলে শোনা যায়। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের পোশাকশিল্প ধ্বংস করতে পারলে যাদের লাভ, এবার তারাও সক্রিয় কি না—সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
child victims of July uprising Bangladesh

Child victims of July uprising: Of abandoned toys and unlived tomorrows

They were readers of fairy tales, keepers of marbles, chasers of kites across twilight skies. Some still asked to sleep in their mother’s arms. Others, on the cusp of adolescence, had just begun to dream in the language of futures -- of stethoscopes, classrooms, galaxies. They were children, dreamers of careers, cartoons, and cricket.

11h ago