ইভিএম, নির্বাচন কমিশন ও জনগণের অর্থের অপচয়

প্রথম যে প্রশ্নটি আমাদের সামনে আছে তা হলো, কেন আমরা ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে ইভিএম কিনেছি? বলা হয়েছিল, আমাদের ইভিএমগুলোর কারিগরি সক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি এবং এগুলোতে এমন কিছু ফিচার আছে যা অন্যদের ইভিএমে নেই।
গত বছরের জুনে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে ইভিএম প্রস্তুত করছেন কর্মকর্তারা। ফাইল ছবি: টিটু দাস/স্টার

গত ২৩ এপ্রিল দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তিন হাজার ৮২৫ কোটি টাকা মূল্যমানের মোট দেড় লাখ ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মধ্যে এক লাখ ৫০০ মেশিন 'ব্যবহারের অনুপযোগী' হয়ে পড়েছে।

২০১৮ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে প্রতিটি মেশিন দুই লাখ ৩৫ হাজার টাকা দরে কেনা হয়েছিল, যা ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের চেয়ে ১১ গুণ বেশি। ইভিএমগুলোর আয়ুষ্কাল হওয়ার কথা ১০ বছর। কেনার সময় দেওয়া গ্যারান্টি অনুযায়ী, এই যন্ত্রগুলো অন্তত ২০২৮ পর্যন্ত কার্যকর থাকার কথা ছিল।

প্রতিবেশী দেশ ভারতে ইভিএমের গল্পটা অনেকটাই ভিন্ন। দেশটিতে ৯৬ কোটি ৯০ লাখ ভোটার নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় নির্বাচন শুরু হয়েছে গত ১৯ এপ্রিল। সাত ধাপে এই নির্বাচন চলবে ছয় সপ্তাহ জুড়ে এবং প্রায় ১০ লাখেরও বেশি ভোটকেন্দ্রে ভোট নেওয়া হবে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হবে ৪ জুন। ভারতের প্রায় ১০০ কোটি ভোটারের সবাই দেশজুড়ে স্থাপিত ৫৫ লাখ ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দেবেন।

ইভিএমের ব্যবহারে দুই প্রতিবেশী দেশের চিত্রে এত আকাশ-পাতাল তফাত কেন? ভারতে ১৯৯৮ সালে রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার শুরু হয়। সেখানে বেশ কয়েক বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে নির্বাচনে ইভিএমের শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। অপরদিকে আমরা ছয় বছরেরও কম সময় পরে এসেই আমাদের ইভিএমগুলোকে নর্দমায় ছুড়ে ফেলে দেওয়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি করেছি। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ভবিষ্যতের কোনো নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সম্ভাবনাকে আরও অনেক দূরে ঠেলে দিচ্ছি এবং আমরা জানিও না তা কত বছরের জন্য পেছাবে। অথচ, আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার আধুনিকায়নে এটি একটি অত্যাবশ্যক বিষয়।

ইভিএম ব্যবহারের এই উদ্যোগ কেন মুখ থুবড়ে পড়ল?

অবশ্যই এখানে সন্দেহ ও ঘৃণার রাজনীতি এবং বিরোধীপক্ষ যা-ই করুক না কেন, সেটা কখনোই মেনে না নেওয়ার সংস্কৃতির ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া, কারিগরি দিক বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, এই প্রকল্পের পরিকল্পনা, মূল্যায়ন ও নিরীক্ষায় কিছু মৌলিক ত্রুটি ছিল। এর ফলে এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

প্রথম যে প্রশ্নটি আমাদের সামনে আছে তা হলো, কেন আমরা ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে ইভিএম কিনেছি? বলা হয়েছিল, আমাদের ইভিএমগুলোর কারিগরি সক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি এবং এগুলোতে এমন কিছু ফিচার আছে যা অন্যদের ইভিএমে নেই।

তবে ভোটাররা সেই বিশেষ ফিচারগুলো সম্পর্কে কখনোই জানতে পারেনি। নির্বাচন কমিশন কি এগুলো সম্পর্কে জানতো? যদি এর উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে তারা কি এর অনুমোদন দেওয়ার আগে পূর্ণাঙ্গ কারিগরি মূল্যায়ন করেছিল?

ভারতের ইভিএমের একটি ফিচার ছিল পেপার ট্রেইল। এর মাধ্যমে যখন কোনো ভোটার ভোট দেয়, তখন সিরিয়াল নম্বরসহ স্লিপ প্রিন্ট হয়, যেখানে প্রার্থীর নাম ও প্রতীক উল্লেখ থাকে এবং সাত সেকেন্ডের জন্য তা দেখা যায়। তারপর এটা সিল করা বাক্সে চলে যায়।

প্রথমত, এটা ভোটারকে নিশ্চয়তা দেয় যে মেশিন সঠিকভাবে তার ভোটটি গ্রহণ করেছে। দ্বিতীয়ত, একটি প্রিন্ট করা রেকর্ড রয়ে যায়, যার মাধ্যমে পরবর্তীতে ফলাফল নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠলে তা যাচাই করা সম্ভব হয়। এই ফিচারটি ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণের পুরো প্রক্রিয়ায় জনগণের আস্থা অর্জনে সহায়তা করে এবং আমাদের দেশে এর অনুপস্থিতি পুরোপুরি বিপরীত ফল এনেছে। নির্বাচন কমিশন কেন এই ফিচারের জন্য জোরালো দাবি জানায়নি, তা আমাদের বোধগম্য নয়।

ভারতের ইভিএমের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দাম দিয়ে কেনার পরও কি নির্বাচন কমিশন ইভিএমগুলো গ্রহণের আগে যথাযথভাবে পরীক্ষা করেনি?

আরও যে প্রশ্নটি রয়েছে সেটি হলো, নির্বাচন কমিশন কি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে জনগণের আস্থা অর্জনে যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছে?

জনমনে যে ধারণাটি রয়েছে এবং অনেকেই যে কথাটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন তা হচ্ছে, ইভিএমে কারসাজি করা যায়। নির্বাচন কমিশনের বোঝা উচিত ছিল যে ভোট দেওয়াকে মানুষ গুরুত্বপূর্ণ অধিকার এবং দেশের নাগরিক হিসেবে নিজের ক্ষমতা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে দেখে। পুরোপুরি আস্থা অর্জন করা না পর্যন্ত মানুষ এই যন্ত্রের মাধ্যমে নিজের অধিকার ও ক্ষমতা প্রকাশে অনীহা দেখাবে।

নির্বাচন কমিশন কি সত্যিই জনগণের আস্থা অর্জনে যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছে? ইভিএমের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে জনমানুষের মনে বাড়তে থাকা সন্দেহের মেঘ দূর করতে আরও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দল, তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের কেন সম্পৃক্ত করা হয়নি? জনসম্মুখে আরও বড় পরিসরে এই যন্ত্রের কার্যকারিতা প্রদর্শন এবং এর সক্ষমতা নিয়ে উন্মুক্ত বিতর্কের আয়োজন করা উচিত ছিল।

জনগণের আস্থা অর্জনের উদ্যোগ না নিয়ে এতগুলো ইভিএম কেনা উচিত হয়নি নির্বাচন কমিশনের। সীমিত সংখ্যক ভোটার ও ইভিএম নিয়ে আরও অনেকগুলো পাইলট প্রকল্প পরিচালনা করতে হতো এবং কেবল এর মাধ্যমেই সন্তোষজনক ফল পাওয়া সম্ভব ছিল। ইভিএম যদি ভারতের ভোটারদের মন জয় করতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না?

সম্ভবত এই পুরো প্রকল্পের সবচেয়ে ক্ষতিকর এবং একেবারে অদ্ভুত বিষয়টি হলো, ইভিএম যখন ব্যবহৃত হবে না, তখন সেগুলোকে যথাযথভাবে সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না রাখা। এর চেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে?

২০১৮ সালে যখন ২৫ হাজার ইভিএমের প্রথম চালান এসে পৌঁছায়, তখনই নির্বাচন কমিশনের ভাবা উচিত ছিল যে এগুলো কোথায়, কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব পাওয়ার আগেই নির্বাচন কমিশন আরও ইভিএমের অর্ডার দেয় এবং পরপর দুই বছর—২০১৯ ও ২০২০ সাল—জুড়ে দেড় লাখ ইভিএম আনে।

সাদামাটা ভাবে বলতে গেলে, প্রতিবেশী দেশের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে কেনা ইভিএমগুলো যখন ব্যবহার হচ্ছিল না, তখন সেগুলোকে এমন গুদামে ফেলে রাখা হয়, যা এই ধরনের কারিগরিভাবে জটিল যন্ত্র সংরক্ষণের জন্য কোনোভাবেই উপযুক্ত নয়। এসব যন্ত্র সংরক্ষণের পূর্বশর্ত হচ্ছে তাপমাত্রা, ধুলা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এর কোনোটিই নিশ্চিত করা হয়নি। সংশ্লিষ্টরা ভালো করেই জানতেন যে এসব যন্ত্র খুব শিগগির ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যাবে এবং সেটাই হয়েছে। এই পুরো বিষয়ে এতটা অপরিপক্বতার কোনো ব্যাখ্যাই নেই।

আইনের শাসনে পরিচালিত একটি সমাজে এতটা হেলাফেলায় জনগণের অর্থ অপচয়ের জন্য আমরা কি কাউকেই দায়ী করতে পারি না? যারা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যারা মূল্যায়ন করেছিলেন বা যারা অনুমোদন দিয়েছেন—কারা এর জন্য দায়ী? এক অর্থে সবাইকেই দায়ী করা উচিত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দায়ী কেউ না।

আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থাটা এমনভাবে বানোনো হয়েছে, যেখানে কোনো ব্যর্থতায় কাকে দায়ী করা হবে, তা স্পষ্ট করা যায় না। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কাউকে, কখনো দায়ী না করার চর্চা। যার ফলে কোনো ধরনের জবাবদিহির কথা না ভেবে জনগণের অর্থ খরচ করার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।

প্রতি বছর গণমাধ্যমে জনগণের অর্থ অপচয় নিয়ে হাজারো প্রতিবেদন ছাপা হয়। কিন্তু তাতে কিছুই হয় না। বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয় থেকে প্রতি বছর মানসম্পন্ন ও গবেষণালব্ধ হাজারো প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়, যেখানে উঠে আসে জনগণের অর্থ অপচয়ের অসংখ্য উদাহরণ। কিন্তু এই প্রতিবেদনগুলোর ফাইলে কেবল ধুলো জমতে থাকে। কোনো কর্মকর্তাকে কখনোই দায়ী করে শাস্তি দেওয়া হয়নি—বিশেষত, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের। যার ফলে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, যা কার্যত দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। এই চর্চা একইসঙ্গে ধনী ও ক্ষমতাবানদের জবাবদিহির বাইরে রাখার সংস্কৃতিকেও আরও বলিষ্ঠ করেছে।

কীভাবে ইভিএম বিপর্যয় ঘটল এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো যায়—এসব বিষয়ে কি নির্বাচন কমিশনের তদন্ত করা উচিত না?

ভারত তাদের প্রায় ১০০ কোটি ভোটারের শতভাগ ভোট ইভিএমের মাধ্যমে নিতে পারলেও আমরা মাত্র ১২ কোটি ভোটার নিয়ে সেটা পারছি না। আর ইভিএম পরিত্যাগের ফল হিসেবে আমাদের নির্বাচনে ভোট কারচুপি, রাতের ভোটসহ নানা বিতর্ক রয়েই যাবে।

ইভিএম নিয়ে এই বিপর্যয়ের ফলে অদূর ভবিষ্যতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়েও জনসাধারণের মনে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

 

Comments